Published : 12 Aug 2024, 10:25 AM
গণঅভ্যুত্থানকে শেষ পর্যন্ত সফল বিপ্লবের মুকুট পরানো যাবে কি না, না কি বিপ্লব বেহাত হয়ে যাবে, তা নির্ভর করছে যারা অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা কতটা নিষ্ঠার সঙ্গে জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করতে পারছেন, কতটা দৃঢ়তার সঙ্গে দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারছেন, তার উপর। পুরোপুরি না হলেও, মানুষের প্রত্যাশার কাছাকাছিও যদি এই অভ্যুত্থানের নায়কেরা যেতে পারেন, তাহলে বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থেই সর্বত্র বিপ্লব ঘটে যাবে। সকল ক্ষেত্রে যদি সুনীতি প্রতিষ্ঠা পায়, শৃঙ্খলা ফিরে আসে; যদি মননের দিক থেকে মানুষ নিজেকে পাল্টাতে শুরু করে, অসৎ উপায়ে অর্থকড়ি সঞ্চয়ের পথ থেকে সরে আসে, তাহলে এই বিপ্লব বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। কাজটি কঠিন, কেননা অভ্যুত্থানের পর কিছুটা সময় ধৈর্য্য ধরে রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে নিরলস কাজ করে যেতে হয়।
আমরা জানি, বিপ্লব, গণঅভ্যুত্থান শুধু রাজপথ বা রাষ্ট্রীয় দফতরই দখল করে না, শিল্পসাহিত্য ও দৃশ্যমাধ্যমকেও প্রভাবিত করে। সেটাই আমরা প্রত্যক্ষ করছি ৫ অগাস্টের পর থেকে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের সময় বাংলাদেশ পেয়েছিল এক ঝাঁক কবি-সাহিত্যিককে। পেয়েছিল অগ্নিঝরা দেয়াল-লিখন বা চিকা। একবিংশ শতকের চব্বিশে এসে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থানেও দেশের মানুষ একধরনের কাব্য পেয়েছে, তবে তা সুরে সুরে। বলছিলাম র্যাপসংয়ের বাংলা সংস্করণের কথা। স্বৈরাচারী শাসনের অবসান চেয়ে অনেক র্যাপ গান মুক্তি পেতে দেখেছি আমরা এবার। বাণী প্রধান এসব গান অনেকটা বাংলার ছড়াগানের মতোই। সত্তরের দশকে আফ্রিকান-আমেরিকান ও ল্যাটিনো সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত এই গানের সংস্কৃতি দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তকে অনেক আগে প্রভাবিত করলেও, বাংলাদেশে এই অভ্যুত্থানকালে এর প্রভাব ব্যাপকহারে দেখা গেছে। আন্দোলনের সময় র্যাপাররা এতটাই প্রভাব বিস্তার করছিলেন যে প্রশাসন পর্যন্ত নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছিল। আমরা জানি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে উজ্জীবিত করতে ‘আওয়াজ উডা’র্যাপ গান রচনা ও গাওয়ার জন্য গ্রেপ্তার করা হয় র্যাপার হান্নান হোসাইন শিমুলকে। ১৩ দিন কারাগারে ছিলেন তিনি। শুধু একটি গান লেখার দায়ে! এ শুধু ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রেই সম্ভব।
র্যাপ গান ছাড়া আরো একটি স্বতন্ত্র জিনিসের দেখা মিলেছে এই অভ্যুত্থানের অব্যবহতি সময়ে। রাজধানীর প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেয়াল, শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সীমানাপ্রাচীরকে আমরা দেখছি গ্রাফিতি, চিত্র ও ক্যালিগ্রাফি দিয়ে সজ্জিত হয়ে উঠছে। সেখানে প্রচার করা হচ্ছে স্বৈরাচারবিরোধী স্লোগান, আন্দোলনে শহীদদের স্মরণ এবং ভবিষ্যতের দেশ গঠনের মন্ত্র। নব্বইয়ের দশকে রাজনৈতিক কর্মীরা দেয়ালে দেয়ালে চমৎকার সব চিকা মারতেন। এবার দেখা গেল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা রঙের ডিব্বা হাতে উৎসব মুখর হয়ে সাজিয়ে তুলছে শহর, ছড়িয়ে দিচ্ছে তাদের প্রাণে প্রস্ফূটিত রক্তজবার কাব্য। রাজপথ ও রাষ্ট্রযন্ত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজ তো তারা করছেনই।
এই অভ্যুত্থান চলাকালে এবং চূড়ান্ত দাবি সফল হওয়ার পর আরো একটি বিষয় আমরা পেয়েছি বিপুল হারে। সেটা হলো দৃশ্যমাধ্যমের আধেয়। অজস্র-অর্বুদ সেসব আধেয়তে আন্দোলনকারীদের নানামুখী তৎপরতার দেখা যেমন আমরা পেয়েছি, তেমনি পেয়েছি কাজী নজরুল ইসলামের বিভিন্ন সঞ্জীবনী সঙ্গীতের ব্যবহারে, একনায়কতন্ত্র হটানোর আন্দোলনে তরুণদের সামিল হওয়ার আহ্বান। ছোট ছোট নাটিকার দেখাও মিলেছে আন্দোলনের পক্ষে। এই আধেয়গুলো সম্ভব হয়ে উঠেছে, কোনো সন্দেহ নেই, তরুণ সমাজ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে স্বল্পদৈর্ঘ্যের আধেয় বা কন্টেন্ট তৈরিতে পারদর্শী হয়ে উঠেছিল বলেই। ভাবতে অবাক লাগে, কয়েক সেকেন্ডের বিজ্ঞাপন বানাতে যেখানে বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর একগাদা লোকের দরকার হয়, সেখানে এরা একাই স্ক্রিপ্টিং-শুটিং-এডিটিং-এক্টিং করে কয়েক সেকেন্ডে বুঝিয়ে দিতে পারেন নিজের বক্তব্য।
সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের কাজে এসব শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এসব কাজ মানুষের ভেতর মতামত গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে কাজের কাজ হবে যদি এই সৃজনশীল, তারুণ্যের শক্তিতে ভরপুর শিক্ষার্থীদের আমরা রাষ্ট্রগঠনে সরাসরি সুযোগ করে দিতে পারি। এমন হতে পারে— শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই প্রত্যেকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে কাজ করবেন। মেয়াদ শেষে কাজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটি সুপারিশপত্র জমা দেবেন। সেই আলোকে পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা সাজানো হবে। তাদেরকেও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ধন্যবাদসূচক কিছু একটা দেওয়া যেতে পারে। এতে করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে জবাবদিহিতার একটি সুন্দর ব্যবস্থা তৈরি হবে। তখন বড়রা চাইলেই দুর্নীতি, লুটপাট, চুরিচামারি করতে পারবেন না। আর সম্মিলিত শক্তি হিসেবে শিক্ষার্থীরা যেহেতু প্রমাণিত, তাই তাদের উপস্থিতিতে অনিয়ম করার সাহস সহজে কেউ পাবেন না।
এই শিক্ষার্থীরা কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী বা ক্যাডার নন। কিন্তু আমার বিবেচনায় সত্যিকারের রাজনীতিটা এরাই করছেন, এরাই শিখিয়ে দিচ্ছেন রাজনীতির মূল কাজ কি হওয়া উচিত— সেটি হলো দেশসেবা, দেশের মানুষের সেবা। নিঃস্বার্থভাবে, ঘরের খেয়ে রাজপথে এসে যেভাবে তারা অভ্যুত্থান পরবর্তী দেশকে ঢেলে সাজানোতে মনোযোগ দিয়েছেন, তা থেকে যদি তথাকথিত রাজনীতিবিদরা কিছু না শেখেন, তাহলে তাদের জন্য ভবিষ্যতে বাংলাদেশে রাজনীতি করা কঠিন হয়ে পড়বে। টিকে থাকতে হলে, আখের গোছানোর রাজনীতি তাদের ভুলে যেতে হবে।
গত কয়েক দশক ধরে রাষ্ট্রের শিরা-উপশিরায় দুর্নীতি দেখতে দেখতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভেতর বিবমিষা জেগে উঠেছিল, তারা কিছুটা হতাশও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই প্রজন্ম, যাদেরকে জেন-জি বলে সম্বোধন করা হচ্ছে, তারা অন্ধকার টানেলের শেষ প্রান্তে আশার আলো দেখাল। এটা ঠিক, বাংলাদেশের অনেকেই এই অভ্যুত্থানের আগে-পরে ভেবেছেন, আমরা কি কেবল ফুটন্ত কড়াই আর জ্বলন্ত উনুনের ভেতর পর্যায়ক্রমিকভাবে স্থানান্তরিত হতে থাকব? কিন্তু তরুণদের এই আত্মনিয়োগ, দেশের প্রতি তাদের জানবাজি রাখা ভালোবাসা, সেই দোলাচল থেকে আমাদের রক্ষা করার আশা জাগিয়ে তুলছে। দিনরাত যেভাবে তারা কষ্ট স্বীকার করে কাজ করে যাচ্ছেন, তা অভূতপূর্ব, অসাধারণ।
শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সকলে যে শিক্ষা নিচ্ছেন, তা অবশ্য নয়। যেমন রাস্তাঘাটে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, রোদ-বৃষ্টির ভেতর বাচ্চারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করে যাচ্ছে, আর পাশেই পুরোনো রাজনৈতিক দলের জায়গা দখল করে, আরেক রাজনৈতিক দল ব্যানার টাঙিয়ে বসেছেন। সেখানে বসে অকর্মণ্যগণ চা-বিড়ি পান করে চলেছেন, আর নজর রাখছেন বাচ্চাদের দিকে। এরা ভাবছেন, কখন পোলাপানগুলো পড়ার টেবিলে ফিরে যাবে, আর তখনই তারা জলদি জলদি আবার চাঁদাবাজি আর উছৃঙ্খলতা শুরু করে দেবে। তাদের এই আশায় গুড়ে বালি!
আমার মনে হয়, ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। সেবারও ট্রাফিক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে তারা হাতেকলমে কাজ করেছিলেন। কিন্তু সড়ক ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আগের নৈরাজ্যে ফিরে গিয়েছিল রাজধানী। তাই এবার আর সহজে রাজপথ ছেড়ে যাচ্ছেন না তারা। এবার রাস্তায় শৃঙ্খলা তো আনবেনই, পাশাপাশি বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ে যে নয়ছয় খেলা হচ্ছিল, সেটারও বিহিত করে ছাড়বেন। মানুষের দম আটকে যাচ্ছিল জিনিসপত্রের লাগামহীন দামের জন্য। এবার বোধহয় কিছুটা স্বস্তি নেমে আসবে। যেখানেই দুর্নীতি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের শঙ্কা আছে, সেখানেই শিক্ষার্থীরা দল বেঁধে নিয়ম করে হানা দিচ্ছেন। অথচ ভেবে দেখুন এসব করার জন্য কত হাজার কোটি টাকা খরচ করে সরকারের তরফ থেকে শতশত মনিটরিং কমিটি, হেনতেন তৈরি করা হয়েছিল। এরা এতদিন কিছুই করেনি, বা করতে পারেনি। মাঝখান থেকে লাভবান হয়েছে মুনাফাখোরেরা, আর ভুক্তভোগী হয়েছে জনগণ।
আরেকটু পিছিয়ে গেলে দেখব, ২০১৫ সালেও কিন্তু শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে এসেছিল ক্ষোভ জানাতে, বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ব্যয়ভারের ওপর ১০ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করেন। শিক্ষার্থীরা তখন শুরু করেন ‘নো ভ্যাট অন এডুকেশন’ আন্দোলন। সেই আন্দোলনও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছিল। তারপরও সেটি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের মতো দাবিতে গড়ায়নি। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনও রাজপথ থেকে সরিয়ে দিতে পেরেছিল সরকার।
কিন্তু এবার যে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এক দফায় গিয়ে ঠেকেছে, তার পেছনের মূল কারণটি ছিল আন্দোলন দমনে শতশত ছাত্রকে হত্যা, আর ছিল বিগত দেড় দশকে সাধারণ মানুষের মনের জমা হওয়া পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। বলতে গেলে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থাই আদতে নিজের কবর খুঁড়েছে নানা সময়ে শোষণ ও বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে। শিক্ষার্থীরা বারবার রাজপথে নামতে বাধ্য হয়েছেন এবং এই আন্দোলন করতে করতেই তারা শিখেছেন কেমন করে স্বৈরাচারকে বিদায় জানাতে হয়। আশা রাখি, এবার অন্তত বড়রা উচিত শিক্ষা গ্রহণ করবেন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে।