Published : 08 Feb 2023, 07:40 PM
চার্লস রবার্ট ডারউইন চিকিৎসক হবেন, এমনটাই চেয়েছিলেন তার বাবা। কিন্তু কিশোর বয়স থেকেই ডারউইনের আগ্রহ ছিল প্রকৃতির তত্ত্ব তালাশে। যদিও তিনি শেষমেশ অ্যাকাডেমিক পড়া শেষ করেন থিওলজি বা ধর্মতত্ত্বে। এরপর ১৮৩১ সালে ২২ বছর বয়সে অভিযাত্রায় বেড়িয়ে পড়লেন এ ব্রিটিশ তরুণ।
অনুসন্ধিৎসু ডারউনের সংগ্রহে জমা হতে থাকে ফসিল- খুলি, উরুর অস্থি, ঘোড়ার সমান স্তন্যপায়ী প্রাণি। ব্রাজিল, রেইন ফরেস্ট, আন্দিজ পর্বতমালা, আর্জেন্টিনা, পেরু ঘুরে ১৮৩৫ সালে তিনি এলেন ইকুয়েডরের কাছে গরম হলকার দ্বীপপুঞ্জ গ্যালাপাগোসে। এখানে দেখলেন গুইসাপ বা ইগুয়েনা, বড় বড় কচ্ছপ। এরমধ্যে কয়েকটি দ্বীপ ঘুরে কয়েক ধরনের হরবোলা পাখি বা চড়ুই আকারের মকিং বার্ড দেখেছিলেন তিনি। সেবার অভিযাত্রী দলটি কয়েকটি পাখির নমুনা নিয়ে ফেরে। তাতে পাখির চঞ্চুর আকার ও আকৃতিতে ভিন্নতা দেখা যায়; কোনোটি মোটা ও খাটো, কোনোটি একটু লম্বা ও তীক্ষ্ণ, আবার কোনোটি বাঁকানো। ১৪টি প্রজাতির পাখি পরে ‘ডারউইন ফিঞ্চ’ নামেও পরিচিতি পায়। এদের গায়ের রঙ, বাসস্থান, আকার প্রায় একই হলেও, মূল ভিন্নতা ছিল চঞ্চুতে। সময়ের সাথে সাথে চঞ্চুর গড়নে এই ভিন্নতা এসেছিল তাদের খাদ্যাভ্যাস থেকে; যারা শস্যদানা-ফল খায় এবং যারা পোকামাকড় খায় তাদের চঞ্চুর আকার ভিন্ন ভিন্ন। ডারউইনের সেই পাখির নমুনা সংরক্ষিত রয়েছে লন্ডনের দ্য ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে।
প্রকৃতিবিদ ডারউইন ওই অভিযানে শতাধিক পাতার ডায়েরি লিখেছিলেন, টুকেছিলেন আরও শত শত নোট। সংগ্রহ করা মৃতদেহ, হাড়, চামড়ার কয়েক হাজার নমুনাকে কয়েক ভাগে ভাগ করেছিলেন। ফিরে আসার পর সেসব নিয়ে গবেষণায় বসেন। প্রাণী শরীর ব্যবচ্ছেদ করেন, কবুতর পুষে তাদের বংশ বৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ করেন, বীজের অঙ্কুরোদগম নিরীক্ষা করেন। অভিযানের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ডায়েরি থেকে জার্নাল প্রকাশ পায় ১৮৩৯ সালে; যা ডারউইনের পরিচিতিকে বাড়িয়ে তোলে। ১৮৫৯ সালে ডারউইনের বই ‘অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিস বাই মিনস অব ন্যাচারাল সিলেকশন’ প্রকাশ পায়। ১৮৭১ সালে ডারউইনের ‘দ্য ডিসেন্ট অব ম্যান অ্যান্ড সিলেকশন ইন রিলেশন টু সেক্স’ বইটির প্রথম সংস্করণ ছাপা হয়।
দার্শনিক ফ্রিডরিক এঙ্গেলস ডারউইনের বই পড়ে কার্ল মার্কসকে চিঠিতে লেখেন, “...ঐতিহাসিক বিবর্তন প্রক্রিয়া বর্ণনা করে এর আগে এত বিষদ প্রয়াস কখনও দেখা যায়নি...।” ডারউইনের বিশ্লেষণ মূল্যায়নে মার্কস একে ‘যুগ সৃষ্টিকারী কর্ম’ বলেছিলেন।
মোটা দাগে ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্ব নিয়ে কী জানা যায়?
প্রথমত, প্রকরণ বা ভ্যারিয়েশন অর্থ্যাৎ পৃথিবীতে একই প্রজাতির দুটো জীবও অবিকল একে অপরের মত হবে না।
দ্বিতীয়ত, বংশবৃদ্ধি করা জীবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। একই প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যে প্রজনন ঘটে থাকে।
তৃতীয়ত, অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম এবং যোগ্যতমের টিকে থাকা; যাকে বলে একজিসটেন্স এবং সারভাইভাল বফ দ্য ফিটেস্ট।
চতুর্থত, প্রাকৃতিক নির্বাচন ও নতুন প্রজাতির জন্ম।
ইভোল্যুশন বা বিবর্তন শব্দটি অবশ্য ডারউইনের অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিস বইতে একবারের জন্যও আসেনি। এই বইতে ডারউইন নিজের মতবাদকে বরং ’থিওরি অব ন্যাচারাল সিলেকশন’ নামেই চেনাতে চেয়েছেন। একদম শেষে ’ইভোলড’ শব্দটি রয়েছে, তা অবশ্য বিবর্তন তত্ত্ব প্রসঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে নয়। ভ্রমণ, নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা থেকে পাওয়া পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে লেখা ডারউইনের বইতে ন্যাচারাল সিলেকশন, স্ট্রাগল ফর একজিসটেন্স, ভ্যারিয়েশন নিয়ে আলাদা অধ্যায় রয়েছে। উদাহরণ টানতে গিয়ে ঘাস, ফল, গম, উদ্ভিদ, কাঠঠোকরা পাখি, ছোট শিংওয়ালা গবাদিপশুর কথা টেনেছেন। বহুবার অ্যানিমেল ও প্লান্ট শব্দের উল্লেখ রয়েছে। বইটিতে মডিফিকেশন, ডাইভারজেন্স অব ক্যারেক্টার কথাটি এসেছে।
অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিস বইটিতে মাংকি, প্রাইমেট, হোমো, হোমিনিন, হোমিনিড হোমো সেপিয়েন্স, জিন, জেনেটিক, সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট – এমন কোনো শব্দবন্ধ নেই। তবে দ্য ডিসেন্ট অব ম্যান অর্থাৎ মানব প্রজাতির উদ্ভব বইতে মাংকি, প্রাইমেট, সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট –এর উল্লেখ রয়েছে।
জিনিয়ালজিকাল (অর্থাৎ বংশগতি) শব্দটি কয়েকবার এসেছে দুটি বইতেই। জিন ও জেনেটিক শব্দের ব্যবহার এই দুই বইতে না এলেও জীবের ’বংশগতি’ বৈশিষ্ট্য নিয়ে ডারউইনের ব্যাখ্যা পথ করে দেয় জিনতত্ত্বের। জিনতত্ত্ব নিয়ে জেনেটিক্সের জনক বিজ্ঞানী গ্রেগর জোহান মেন্ডেলের বইটি প্রকাশ পায় ১৮৬৬ সালে। অন্যদিকে ডিএনএ প্রথম শনাক্ত হয় ১৮৬৯ সালে এবং ডাবল হেলিক্স মডেল আবিষ্কৃত হয় ১৯৫৩ সালে।
'মানবজাতির উদ্ভব' বইটিতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের পাশাপাশি নতুন একটি তত্ত্বে আলো ফেলেন ডারউইন – সেক্সুয়াল সিলেকশন বা যৌন নির্বাচন অথবা সঙ্গী বাছাই তত্ত্ব।
ইউভাল নোয়া হারারির ‘স্যাপিয়েন্স’ বইটির কিছু কথা মানবজাতির ইতিহাস জানার এই প্রস্তুতি পর্বে সহায়ক হবে। ইউভাল নোয়া হারারি লিখেছেন (অনুবাদ: সুফিয়ান লতিফ, শুভ্র সরকার, রাগিব হাসান), “... প্রাগৈতিহাসিক মানুষ সম্পর্কে জানার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে তা হলো, তখন মানুষ খুবই গুরুত্বহীন একটা প্রাণী ছিল। বনমানুষ, মাছি বা পেঙ্গুইনের থেকে পৃথিবীর উপর বেশি প্রভাব মানুষের ছিল না। ... ... জীবজগতের অন্য প্রাণীদের মতো মানুষও অনেকগুলো গণ বা জাতি নিয়ে গঠিত পরিবারের অংশ। আশ্চর্যজনক ভাবে, এই নিতান্ত সাধারণ ব্যাপারটিকে অদ্ভুত কারণে মানুষ বারবার গোপন করতে চেয়েছে। হোমো স্যাপিয়েন্স নামের এই প্রাণীটি বরাবরই নিজেদেরকে বাকি প্রাণীজগৎ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেখতে চায়, দেখে এসেছে।”
ডারউইন মানুষের এই জাত্যাভিমান ভেঙে তাদের জীবজগতের আর সব প্রাণীদের কাতারে দাঁড় করিয়েছেন। ব্যাখ্যা করেছেন মানুষের শারীরিক কাঠামো, ভ্রণ, কান, গায়ের রঙ, কণ্ঠস্বর, ভাষা, যুদ্ধ, বিবাহপ্রথা, মন- অন্য প্রাণীর সাপেক্ষে। আরও যে বিশেষ দিক তিনি তুলে ধরেছেন – (১) মানুষের শারীরিক গঠন অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর গড়নের মতো, (২) মানুষের ভ্রুণকে প্রাথমিক অবস্থায় মেরুদণ্ডী প্রাণীর ভ্রুণ থেকে আলাদা করে চেনা অসম্ভব অর্থাৎ ভ্রুণ বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে সাদৃশ্য রয়েছে, (৩) একই জাতের দুজন মানুষের মধ্যেও অমিল বা বৈসাদৃশ্য রয়েছে। শরীরের ভেতরের অংশগুলো (ভিসেরা) বাইরের অংশের চেয়ে বেশি পরিবর্তনশীল। বিভিন্ন পেশা ও অভ্যাসগত কারণে শরীরের নানা অংশের আনুপাতিক পরিবর্তন ঘটে, (৪) গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু ও পাখি এবং কৃষি থেকে উৎপন্ন উদ্ভিদের প্রজনন ক্ষমতা প্রকৃতির মুক্ত অবস্থায় থাকা প্রজাতির চেয়ে বেশি। সভ্য মানুষের প্রজনন ক্ষমতাও অসভ্য মানুষের চেয়ে বেশি, (৫) পৃথিবীতে আবির্ভূত হওয়ার পর থেকে সব রকম প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকা প্রমাণ করে মানুষ সবচেয়ে প্রবল প্রাণী, (৬) শ্রেণিবিন্যাসে মানুষের মস্তিষ্কের বিপুল উন্নতি খুব বেশি তাৎপর্য রাখে না, (৭) নৈতিকগুণ সম্পন্ন প্রাণী একমাত্র তাকেই বলা যায় যে তার অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে চিন্তা করে ভালো ও মন্দ দিক চিহ্নিত করতে পারে।একমাত্র মানুষের এই বিশেষ সক্ষমতা রয়েছে। জীবজগতের অন্যান্য প্রাণীর সাথে মানুষের বিভিন্ন পার্থক্যের মধ্যে এই পার্থক্যটি বিশেষ গুরুত্ব রাখে, (৮) উপযুক্ত সঙ্গী নির্বাচন করতে পারলে মানুষ তার সন্তানের শারীরিক গড়ন, মনন এবং নৈতিক গুণাবলী উন্নত করতে পারে, (৯) সমস্ত প্রাণীজগতে নারীকে দখল করার জন্য পুরুষের তৎপরতা চলে, (১০) স্ত্রী প্রাণীদের তুলনায় পুরুষ প্রাণীদের মধ্যে পরিবর্তন ঘটেছে বেশি, (১১) বিশেষ কোনো একটি লিঙ্গের সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রবণতা অন্য সব বৈশিষ্ট্যের মতো উত্তরাধিকার সূত্রেই আসে, (১২) নারী-পুরুষ এমন উভয় লিঙ্গের প্রাণীর সমান সংখ্যায় জন্ম দেওয়া বা একটি লিঙ্গের প্রাণী বেশি সংখ্যায় জন্ম দেওয়ার প্রবণতা কোনো প্রজাতির জন্য অন্য প্রজাতির থেকে বেশি সুবিধোজনক হবে না, (১৩) শক্ত খোলসের প্রাণীদের মানসিক ক্ষমতা যতটা থাকা সম্ভব বলে মনে হয়, বাস্তবে তাদের মানসিক সক্ষমতা বেশিই থাকে।
সার্বিকভাবে বিবর্তনবাদ কিংবা প্রাকৃতিক নির্বাচন কিংবা যৌন নির্বাচন নিয়ে নিজের মতবাদ প্রসঙ্গে ডারউইনের ভাষ্য (অনুবাদ প্রকাশনা: দীপায়ন, কলকাতা), ”এখানে যে সমস্ত মত অভিব্যক্ত হয়েছে, তারমধ্যে অনেকগুলো নিছকই অনুমানভিত্তিক, এবং কোনো কোনোটা ভুল বলেও প্রমাণিত হবে। তবে গোটা বইতে আমি যখনই কোনো একটি বিশেষ মতের পক্ষে দাঁড়িয়েছি, তখন প্রত্যেক ক্ষেত্রেই কেন আমি সেই মত সমর্থন করছি তার কারণও দেখানোর চেষ্টা করেছি।”
প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বে ডারউইনের সাথে কাজ করেন এ আর ওয়ালেস। ডারউইনের এক হাজার বছর আগে ইরাকের দার্শনিক আল জাহিজ তার ‘দ্য বুক অব অ্যানিমেলস’ বইতে যে ধারণা দিয়েছিলেন তা অনেকটাই মিলে যায় ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের সাথে। এদিকে ডারউইন আবার প্রভাবিত হয়েছিলেন জীববৈজ্ঞানিক শ্রেণিবিন্যাসের জনক ক্যারোলাস লিনিয়াস দ্বারা, পিতামহ ইরাসমাস ডারউইন দ্বারা। ’জুনোমিয়া’ বইতে ইরাসমাস ডারউইনের ব্যাখ্যা সারভাইল অব দ্য ফিটেস্ট–এর কথা বলে। তার লেখা দ্য ইকোনমি অব ভেজিটেশন, দ্য লাভস অব দ্য প্লান্টস, দ্য টেম্পল অব নেচার কাব্যগ্রন্থের কবিতাকে বিবর্তনবাদের কাব্য বা পোয়েম অব ইভোল্যুশন বলা হয়।
ডারউইনের তত্ত্ব নিয়ে পাল্টা বক্তব্য থাকলেও বিজ্ঞান তাকে খারিজ করতে পারেনি। কারণ ডারউইনের তত্ত্বের কারণে জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, জিনতত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে। পৃথিবীতে জীবজগতের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, সভ্যতার ইতিহাস আলাপ করতে গেলে ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন কিংবা যৌন নির্বাচন প্রক্রিয়া এড়ানো যায় না।
পৃথিবীর আয়তন বর্ধনশীল নয়। অধিক হারে প্রজনন ঘটতে থাকলে খাদ্য ও বাসস্থান সেই সাপেক্ষে সীমিত হতে থাকে। ফলে ভিন্ন অথবা একই প্রজাতির সাথে টিকে থাকার লড়াইয়ে নামে জীব। খাদ্য শেকলে ঘাসফড়িংয়ের ঘাস খাওয়া, ব্যাঙের ঘাসফড়িং খাওয়া, সাপের ব্যাঙ খাওয়া এবং বাজপাখির সাপ খাওয়াতেও অস্তিত্বের সংগ্রাম আছে। প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকার সংগ্রাম করে জীব; নয়তো বিলুপ্ত হয়। যেমন পৃথিবীর শীতল তাপমাত্রার দিনে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়। ভূমি সংস্কার, দাবানল ইত্যাদি কারণে অস্ট্রেলিয়াতে বিপন্ন প্রাণীতালিকায় যুক্ত হয়েছে কোয়ালা। উপযোগী পরিবেশ ও প্রজনন না হলে ২০৫০ সালের মধ্যে বিলুপ্তি ঘটতে পারে এই প্রাণীটির। চীন গত কয়েক দশক ধরে বাঁশবন তৈরি করে পান্ডার সংখ্যা বাড়িয়েছে; নয়তো পান্ডা বিপন্ন হয়ে উঠেছিল। ওদিকে নগরায়নের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াতে উন্মুক্ত প্রকৃতি কমে কৃত্রিম আলো, কীটনাশক, দূষণ বেড়ে যাওয়ায় ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে জোনাক পোকা। একশ বছর আগে, ১৯০০ সালের দিকেও পৃথিবীতে এক লাখ বাঘ ছিল। এখন পৃথিবীতে বাঘের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের কম।
প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে প্রজাতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য দরকার হয়। প্রজাতির সংজ্ঞা কী? জীবজগতের ক্রমধারার একটি একক প্রজাতি। জীবন (লাইফ) -> অধিজগৎ (ডোমেইন; ) -> জগৎ (কিংডম) -> পর্ব (ফাইলাম) -> শ্রেণি (ক্লাস) -> বর্গ (অর্ডার) -> পরিবার (ফ্যামিলি) -> গণ (জিনাস) -> প্রজাতি (স্পিশিস); এভাবে উল্টো পিরামিডে সাজানো হয় জীবজগতকে।
জীবের দ্বিপদ নামকরণ বা বাইনোমিয়াল নোমেনক্লেচার অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক নামের প্রথম অংশ হয় গণ এবং দ্বিতীয় অংশ হয় প্রজাতি। আধুনিক মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম হোমো স্যাপিয়েন্স; লাতিন ভাষায় এর অর্থ বিচক্ষণ ব্যক্তি। প্রজাতি স্যাপিয়েন্স হলে, গণ হচ্ছে হোমো, পরিবার হচ্ছে হোমিনিড, বর্গ হচ্ছে প্রাইমেট, শ্রেণি হচ্ছে ম্যামালিয়া। মানুষ যখন স্তন্যপায়ী, তখন সেই স্তরে তিমি মাছও থাকে, বানরও থাকে। মানুষ যখন মেরুদণ্ডী প্রাণী, তখন একই স্তরে কুকুর, ছাগলও থাকে। হোমো প্রজাতির পূর্বজদের আবির্ভাব হয় আনুমানিক ২৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ বছর আগে। এভাবে শ্রেণিবিন্যাসের উপরের দিকে গেলে জানা যাবে হোমোর ইতিহাস।
১৯৭৪ সালে ইথিওপিয়া থেকে খণ্ড খণ্ড আকারে ৩২ লাখ বছর আগের যে ফসিল মিলেছিল, তা জুড়ে মিলল এক নারী অবয়ব। বিজ্ঞানীরা ওর নাম দিলেন লুসি। লুসি হচ্ছে হোমিনিড। হোমিনিড আবার প্রাইমেট অথবা গ্রেট এপস স্তরের প্রাণী। বৈশিষ্ট্যের মিলে এই স্তরে শিম্পাঞ্জি, গরিলা, ওরাং-ওটাং এবং মানুষও রয়েছে। হোমিনিডের পরবর্তী স্তরে আসে হোমিনিন; এতে মানুষ ও আদি মানবরা অন্তর্ভূক্ত। হোমিনিড লুসি ছিল মূলত অস্ট্রালোপিথেকাস গণের। লুসিকে খুঁড়ে পাওয়ার আরও আগে, ১৯২৫ সালে রেমন্ড ডার্ট অস্ট্রালোপিথেকাস গণের প্রাথমিক সংজ্ঞা দাঁড় করান একটি ২০ লাখ থেকে ৩০ লাখ বছর পুরনো ফসিল (শিশুর খুলি) থেকে।
প্রাইমেট ও হোমিনিড হলেও অস্ট্রালোপিথেকাস থেকে কিছু ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ফসিল মেলে ১৯৬০ সালে। ফসিলের আশেপাশে প্রস্তর খণ্ডের অস্ত্র মেলায় ধারণা করা হয় তারা দক্ষ প্রাণীগোষ্ঠী ছিল। ফলে এদের নামকরণ হলো হোমো হ্যাবিলিস। এরা ১৫ লাখ থেকে ২৪ লাখ বছর আগে পৃথিবীতে বাস করতো। এদের মগজের ওজন অস্ট্রালোপিথেকাস থেকে বেশি ছিল, ফলে খুলির পূর্বজদের চেয়ে গোলাকার দেখা যায়। এদের চোয়ালের গড়ন অস্ট্রালোপিথেকাসদের থেকে খাটো ছিল। দাঁত ছিল অস্ট্রালোপিথেকাস থেকে তুলনামূলক ছোট এবং ধনুকের মতো সাজানো; যা অনেকখানি আজকের মানুষের মতোই। তবে বিজ্ঞানীদের এক অংশ অন্যান্য বৈশিষ্ট্যে এদের সাথে অস্ট্রালোপিথেকাসের মিল বেশি দেখার দাবি করেন। এজন্য তারা হোমো হ্যাবিলিসের বদলে অস্ট্রালোপিথেকাস হ্যাবিলিস বলতে চান।
হোমো ইরেক্টাস (বা হোমো এরগ্যাস্টার) প্রজাতির সাথে হোমো সেপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষের বৈশিষ্ট্যের সর্বাধিক মিল পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এরা হোমিনিন। ১৫ লাখ বছর আগেও এদের অস্তিত্ব ছিল। লুসির উচ্চতা সাড়ে তিন ফুটের কিছু বেশি ছিল।হোমো ইরেক্টাস ফলিস বলছে এরা আরেকটু লম্বা।
১৯৮০ সালে তিব্বতের মালভূমিতে যে ফসিল (চোয়ালের হাড়) মেলে, তার ভিত্তিতে বিজ্ঞানীরা ডেনিসোভা প্রজাতির খোঁজ পান। এই হোমিনিনরা ১৬ লাখ বছর আগে বাস করত।
একটি ত্রিপদী নামের প্রজাতি রয়েছে– হোমো স্যাপিয়েন্স স্যাপিয়েন্স; এরা হোমো স্যাপিয়েন্সের উপজাতি। জার্মানির নিয়ান্ডারথাল উপত্যকা থেকে এই উপজাতির ফসিল পাওয়া যায়; তাই নামকরণ হয় নিয়ান্ডারথাল। এদের বলা হয় মানুষের ঘনিষ্ট আত্মীয়, যারা ৪০ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হয়েছে।
প্রাচীন এক হাড় থেকে নিয়ানডার্থালদের জিনবিন্যাস উন্মোচন করে ২০২২ সালে নোবেল পান সুইডিশ বিজ্ঞানী সোয়ান্তে প্যাবো। তিনি জানুয়ারিতে দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ”সম্ভবত নিয়ান্ডারথাল প্রজাতির ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ জিন মানুষের মধ্যে পাওয়া যাবে। এর অর্থ নিয়ান্ডারথাল আদতে বিলুপ্তই হয়নি, তারা আমাদের ভেতরেই রয়ে গেছে।”
নিয়ান্ডারথাল প্রজাতির নাম দুয়েকবার নিলেও অস্ট্রালোপিথেকাস, হোমো ইরেক্টাস প্রজাতির বিষদ ছাড়াই পূর্বপুরুষদের ইতিহাস দেখতে পেয়েছেন ডারউইন। এরপর আজকের বিজ্ঞান প্রযুক্তির ছোঁয়াতে ফসিলে পূর্বজের চেহারা ফুটিয়ে তুলছে। ফলে দেখা যাচ্ছে লুসি দেখতে কেমন ছিল। বিজ্ঞান ফসিলকে শ্রেণিবিন্যাসের স্তরে স্তরে বসাচ্ছে; তাতে স্পষ্ট হচ্ছে পূর্বজদের বংশগতি; হোমো, হোমিনিন, হোমিনিড, প্রাইমেট।বিজ্ঞান এমন এক শাস্ত্র যা মনে জাগা প্রশ্নের উত্তর খোঁজে, উত্তর দেয়, প্রমাণ করে এবং থেমে না গিয়ে অন্বেষণ বহাল রাখে। জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ পৃথিবী সৃষ্টির মুহূর্ত দেখার পথে অনেকখানি এগিয়েছে। ১৩০০ কোটি বছর আগের মহাবিশ্ব দেখে ফেলেছি আমরা এই টেলিস্কোপের চোখে। আলোর গতিতত্ত্বের উপর ভর করে আজকে মানুষ পৃথিবী থেকে মহাকাশ জয় করে ফেললেও, সার্ন কিন্তু এই গতিকে ছাড়িয়ে যাওয়া আলোক কণার খোঁজে নিরীক্ষা করছে। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও আলবার্ট আইনস্টাইন বোসন জাতের কণা নিয়ে বলেন। এরপর পদার্থবিজ্ঞানী পিটার হিগস বস্তুর ভর সৃষ্টিকারী কণার কথা বলেন, যা মহাবিশ্বের জন্মে ভূমিকা রেখেছিল। এসব শুধু তত্ত্বে সীমাবদ্ধ থাকেনি; ২০১২ সালে হিগস বোসনের অনুরূপ একটি কণার দেখা পায় সার্ন। ঠিক এভাবে ডারউইনের তত্ত্বও বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় একটি অধ্যায় হয়ে আছে।
বিজ্ঞান যেমন উত্তর খোঁজে, শিশুদের উৎসুক মনে তেমনি উচ্চারিত হয় প্রশ্ন। সে কারণে ছোট বয়স থেকেই বিজ্ঞানের নানা মতবাদের গোড়াপত্তন নিয়ে সহজ কথায় এবং ধাপে ধাপে জানা জরুরী। কোভিড টিকা উদ্ভাবক বিজ্ঞানীদের একজন অধ্যাপক সারা গিলবার্ট বাংলাদেশে এসেছিলেন এই বছর। বিজ্ঞানী সোয়ান্তে প্যাবোকেও বাংলাদেশে আনা দরকার। স্টাডি ট্যুরের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে লন্ডনের দ্য ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে সংরক্ষিত বিভিন্ন জীবাশ্মের একটি ভার্চুয়াল ট্যুর আয়োজন করা গেলে ডিজিটাল বাংলাদেশে তা হবে অনন্য সংযোজন। তাতে গড়পড়তা ’এইম ইন লাইফ’ রচনা থেকে বেরিয়ে এসে শিশুরা কেউ জীবাশ্মবিজ্ঞানী, কেউ জিনবিজ্ঞানী, কেউ জীববিজ্ঞানী, কেউ ট্যাক্সনমিস্ট, কেউ প্রকৃতিবিদ অথবা নৃবিজ্ঞানী হতে চাইবে; তবেই তো জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগোবে বাংলাদেশ।
এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তুষারপাত বাড়ছে, বরফ গলছে, উষ্ণায়ন বেড়েছে, বৃষ্টিপাত বেড়েছে, বন্যা বাড়ছে, খরা বাড়ছে, ভূমিকম্প বাড়ছে, বৈশ্বিক শরণার্থীও বাড়ছে। জীবজগৎ কীভাবে মোকাবেলা করবে? কীভাবে টিকে থাকবে? কারা বিলুপ্ত হবে এই প্রতিকূল পরিবেশে? প্রকৃতি কীভাবে করবে সেই নির্বাচন?
প্রাইমেট, হোমিনিড, হোমিনিন অথবা হোমো নিয়ে এখনও অনেকখানি তথ্য অনুদঘাটিত রয়ে গেছে। আমাদের সবুজ-অবুঝ-কাঁচা প্রজন্ম প্রস্তুতি নিক সেই ফসিল খোঁড়ার।