Published : 12 May 2025, 06:28 PM
অভ্যুত্থান দমাতে ‘গুম, খুন, পুড়িয়ে মানুষ হত্যা, গণহত্যা, বেআইনি আটক, অমানবিক নির্যাতন, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ, সন্ত্রাসী কার্য ও মানবতাবিরোধী অপরাধের’ জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন দল আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর সব কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার।
সদ্য সংশোধিত সন্ত্রাসবিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮(১) ধারার আওতায় এই নিষেধাজ্ঞা জারি করে সোমবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ।
এর অর্থ হল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ আপাতত কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি বা প্রচার চালাতে পারবে না।
দলটিকে এখন জুলাই আন্দোলন দমনে ‘মানবতাবিরোধী’ অপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। সেজন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ইতোমধ্যে সংশোধন করা হয়েছে।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে দলটির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যায়। নিষেধাজ্ঞার প্রজ্ঞাপন আসায় এখন নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের নিবন্ধন নিয়েও সিদ্ধান্ত নেবে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে–
যেহেতু ২০০৯ সালে ৬ জানুয়ারি সরকার গঠনের পর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার গনঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সকল অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্য ও ভিন্নমতের মানুষের উপর হামলা, গুম, খুন, হত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণসহ বিভিন্ন নিপীড়নমূলক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সারাদেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে; এবং
যেহেতু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সকল অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের বিরুদ্ধে গত ১৫ জুলাই থেকে ০৫ আগস্ট ২০২৪ খ্রি. পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে গুম, খুন, পুড়িয়ে মানুষ হত্যা, গণহত্যা, বেআইনি আটক, অমানবিক নির্যাতন, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ, সন্ত্রাসী কার্য ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে এবং এসব অভিযোগ দেশী ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; এবং
যেহেতু উল্লেখিত অপরাধসমূহের অভিযোগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সকল অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং দেশের ফৌজদারি আদালতে বহুসংখ্যক মামলা বিচারাধীন রয়েছে; এবং
যেহেতু এসকল মামলার বিচারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি, বাংলাদেশের সংহতি, জননিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার লক্ষ্যে গত ০৫ আগস্ট ২০২৪ খ্রি. পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সকল অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন কর্তৃক গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতার উপর হামলা, উস্কানিমূলক মিছিল আয়োজন, রাষ্ট্রবিরোধী লিফলেট বিতরণ এবং ভিনদেশে পলাতক তাদের নেত্রীসহ অন্য নেতাকর্মী কর্তৃক সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অপরাধমূলক বক্তব্য প্রদান, ব্যক্তি ও প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তির ক্ষতিসাধনের প্রচেষ্টাসহ আইন-শৃঙ্খলা বিরোধী কর্মকান্ড পরিলক্ষিত হয়েছে; এবং
যেহেতু এসকল কর্মকান্ডে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা হমকির মুখে পড়েছে, দলটি এবং এর সকল অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার বাদী ও সাক্ষীদের মনে ভীতির সঞ্চার করা হয়েছে ও এভাবে বিচার বিঘ্নিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং সার্বিকভাবে দেশের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হওয়ার আশংকা সৃষ্টি হয়েছে; এবং
যেহেতু সরকারের নিকট যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সকল অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল ও অকার্যকর করার লক্ষ্যে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত থাকাসহ জনমনে ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসী সংগঠনের ন্যায় বিভিন্ন বেআইনি কার্যকলাপ ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে; এবং
যেহেতু, সরকার যুক্তিসংগতভাবে মনে করে সন্ত্রাস বিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ এবং সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯ এর ধারা-১৮(১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সকল অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটি এবং এর সকল অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা সমীচীন;
সেহেতু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সকল অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং এর সকল অঙ্গসংগঠন, সহযোগী সংগঠন ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন কর্তৃক যে কোনো ধরনের প্রকাশনা, গণমাধ্যম, অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে কোনো ধরনের প্রচারণা, মিছিল, সভা-সমাবেশ, সম্মেলন আয়োজনসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো।
এই সিদ্ধান্ত অবিলম্বে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে প্রজ্ঞাপনে।
যেভাবে নিষিদ্ধ হল আওয়ামী লীগ
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। দলটির নেতা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান।
তার তিন দিনের মাথায় মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। জুলাই-অগাস্টের অভ্যুত্থানের সময় হতাহতের ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপিসহ বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ডজন ডজন মামলা হতে থাকে।
আওয়ামী লীগের সময়ে যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে শীর্ষ জামায়াত নেতাদের একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল, সেই একই ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ তার সহযোগীদের বিচারের উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। অভ্যুত্থান দমাতে গিয়ে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হয়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি ছিল অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের। তবে ওই দাবিতে জোরালো আন্দোলন শুরু হয় গত সপ্তাহের শেষে।
বৃহস্পতিবার রাতে সরকারপ্রধানের বাসভবন যমুনার সামনে শুরু হওয়া এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ। জামায়াতে ইসলামী, এবি পার্টি, ইসলামী ছাত্রশিবির, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, হেফাজতে ইসলাম এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা এ কর্মসূচিতে সংহতি প্রকাশ করেন।
শুক্রবার জুমার পর তারা মিন্টো রোডের প্রবেশ মুখে মঞ্চ বানিয়ে সেখানে সমাবেশ করেন। সন্ধ্যায় সেখান থেকে গিয়ে তারা শাহবাগ অবরোধ করে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থানের ঘোষণা দেন।
শনিবার বিকালে সেখানে গণজমায়েত করে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করাসহ তিন দফা দাবি তারা তুলে ধরেন। এক পর্যায়ে দাবি পূরণের জন্য সরকারকে এক ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
সেদিন রাতেই রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠক বসে। পরে সংবাদ সম্মেলনে এসে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত জানান।
সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধনের গেজেট জারি হয় রোববার।
আইনের দুটি ধারায় এই সংশোধনের মধ্য দিয়ে সম্ভাব্য মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত রাজনৈতিক দল বা সংগঠন, তার অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন বা সমর্থক গোষ্ঠীর বিচারের সুযোগ তৈরি করার পাশাপাশি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয় ট্রাইব্যুনালকে।
সংশোধিত আইনের বলা হয়, কোনো সংগঠন যেমন রাজনৈতিক দল বা তার সহযোগী কোনো সত্তা যদি এ আইনের আওতাভুক্ত কোনো অপরাধে জড়িত থাকে বলে ট্রাইব্যুনালের কাছে প্রতীয়মান হয়, তাহলে ওই সংগঠনের কার্যক্রম স্থগিত বা নিষিদ্ধ করা, নিবন্ধন বা লাইসেন্স বাতিল এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালের থাকবে।
গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের মুখে ২০১৩ সালে ট্রাইব্যুনাল আইনে যে সংশোধনী আনা হয়, সেখানে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনের বিচারের সুযোগও রাখা হয়। কিন্তু সংগঠনের সাজা কী, সেটি উল্লেখ করা ছিল না।
একাত্তরের ভূমিকার জন্য দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করতে সে সময় আইনটি আবারও সংশোধন করবে বলেছিল শেখ হাসিনার সরকার। কিন্তু এক দশক ঝুলিয়ে রেখেও আওয়ামী লীগ সরকার তা করেনি।
এখন ট্রাইব্যুনাল আইনে সেই সংশোধনী এনে দল হিসেবে খোদ আওয়ামী লীগের বিচারের পথ তৈরি করা হল।
একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতকে নিষিদ্ধ না করলেও আওয়ামী লীগ সরকার তাদের মেয়াদের শেষ সময়ে এসে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সহিংসতার অভিযোগে গত ১ অগাস্ট জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির এবং তাদের সহ অঙ্গ সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়।
সেই সঙ্গে ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুযায়ী জামায়াত এবং এর সকল অঙ্গ সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী সত্তা’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
তার চার দিনের মাথায় আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২৮ অগাস্ট জামায়াতের আবেদনে সেই নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেওয়া হয়।
নয় মাসের মাথায় এখন সেই সন্ত্রাসবিরোধী আইনেই নিষিদ্ধ হল আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন গঠিত আওয়ামী লীগ নানা উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে ৭৫ বছর অতিক্রম করেছে। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দলটি বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় ছিল প্রায় সিকি শতাব্দী।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে এবং ২০০৭ সালে তার মেয়ে শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হলে বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছিল আওয়ামী লীগ।
সেসব কাটিয়ে উঠে দলটি রাষ্ট্র ক্ষমতায় ফিরতে পারলেও এবার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ল দলটি।