Published : 11 Jun 2025, 09:07 PM
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত নতুন সরকারের অংশ হওয়ার কোনো আগ্রহ তার নেই। নির্বাচনের মাধ্যমে সফল ও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিশ্চিত করাই তাদের কাজ।
বুধবার লন্ডনের রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সে (চ্যাথাম হাউস) বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার পর প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি এ কথা বলেন।
বাসস লিখেছে, এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বলেন, “কোনোভাবেই না, একেবারেই না। আমি মনে করি, আমাদের উপদেষ্টা পরিষদের কোনো সদস্য সেটা করতে আগ্রহী হবেন না’।
অনুষ্ঠানে একজন সাংবাদিক জানতে চান, অধ্যাপক ইউনূস গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত পরবর্তী সরকারের অংশ হতে আগ্রহী কি না?
উত্তরে ইউনূস বলেন, তাদের দায়িত্ব হল- যে রূপান্তর চলছে সেটা ঠিকমত শেষ করা এবং যখন তারা নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন, তখন জনগণ যেন সন্তুষ্ট থাকে।
“আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে নির্বাচনটি সঠিকভাবে সম্পন্ন হবে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।”
আলোচনা অনুষ্ঠানের সভাপতি চ্যাথাম হাউজের পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ব্রনওয়েন ম্যাডক্স নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চান। ইউনূসের কাছে তার প্রশ্ন, ‘‘এই নির্বাচন অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। আপনি কয়েকদিন আগে বলেছেন– গণতান্ত্রিক নির্বাচন হবে এপ্রিলের শুরুতে। কিন্তু অনেকেই চায় সেটা এই বছরের শেষের আগেই হোক। আপনি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেছেন, যারা অন্যতম বড় দল। তাই অনেকে বলছে এই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। আপনি কী বলবেন?”
জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমি বারবার বলেছি– এই নির্বাচন হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন। সময়টা এখন উপযুক্ত, মানুষ প্রস্তুত। প্রায় ১৭ বছর পর আমরা সত্যিকারের নির্বাচন করতে যাচ্ছি। এই দীর্ঘ সময়ে যে তরুণরা ভোট দেওয়ার বয়সে পৌঁছেছে, তাদের কারও প্রথম ভোট দেওয়ার সুযোগ হয়নি। সেই তরুণদের উত্তেজনা আমরা কাজে লাগাতে চাই– তারা অপেক্ষা করেছে, তাদের কণ্ঠস্বর কখনো স্বীকৃত হয়নি।
“এই নির্বাচন কেবল সরকার পরিবর্তনের জন্য না—এটা নতুন বাংলাদেশ গড়ার একটি সুযোগ। নতুন বাংলাদেশ মানে কী? আমরা দায়িত্ব নেওয়ার সময় প্রতিজ্ঞা করেছি, তরুণদের স্বপ্নকে সম্মান জানাবো– তাদের যারা রক্ত দিয়েছিলেন সেদিন। আমরা পুরোনো বাংলাদেশকে বিদায় দিতে চাই।''
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নতুন বাংলাদেশ তিনটি স্তম্ভের উপর দাঁড়াবে। সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন নিয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন তিনি।
সংস্কার বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা সেসব প্রতিষ্ঠানকে ফিরিয়ে আনতে চাই না যেগুলো এ অবস্থার জন্য দায়ী। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা কমিশন গঠন করেছি। তারা প্রতিবেদন দিয়েছে, সুপারিশ দিয়েছে। নির্বাচন, সংসদ, সংবিধান, প্রশাসন সব কিছুতেই মৌলিক পরিবর্তনের পরামর্শ এসেছে।
বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যারা এই নৃশংসতা চালিয়েছে—সরাসরি রাস্তায় গুলি করে মানুষ হত্যা করেছে, নিখোঁজ করেছে তাদের বিচার হবে। কে আদেশ দিয়েছিল, কেন এই নরক হয়ে উঠল বাংলাদেশ এসব জানতে হবে। আর এ নিয়ে বিশদ ডকুমেন্টেশন এখন আছে।”
নির্বাচন নিয়ে তিনি বলেন, “উপযুক্ত সময়, প্রস্তুত দেশ। এই নির্বাচনের ভিত্তি হবে জুলাই সনদ– সব রাজনৈতিক দলগুলো একমত যে সুপারিশগুলোতে একমত হয়েছে, সেগুলো নিয়ে তৈরি হবে এই চার্টার। সব দল তাতে স্বাক্ষর করবে। এরপর সেই ভিত্তিতেই নির্বাচন হবে।”
সঞ্চালক প্রধান উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করেন, যে জুলাই সনদ হচ্ছে, সমালোচকরা বলছেন, অনেক রাজনৈতিক দলকে এর বাইরে রাখা হচ্ছে, যারা এই সনদের সঙ্গে একমত নয়, যেমন আওয়ামী লীগ; তাদের জন্য কোনো জায়গা রাখছেন না। সুতরাং, মানুষকে কোনো বিকল্প দেওয়া হচ্ছে না। তারা বলছে, এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়, এটা অনেক সুন্দর শব্দে মোড়ানো এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী পদক্ষেপ, যা বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক।
উত্তরে ইউনূস বলেন, “হ্যাঁ, এটা নিয়েও বিতর্ক আছে। বিতর্ক হচ্ছে—আওয়ামী লীগ কি আদৌ রাজনৈতিক দল? যদি তারা রাস্তায় তরুণদের গুলি করে হত্যা করতে পারে, মানুষকে গুম করতে পারে, টাকা চুরি করতে পারে, তাহলে আপনি কি এটাকে এখনো রাজনৈতিক দল বলবেন? এটাই বিতর্ক। এটা কোনো সিদ্ধান্ত নয়।”
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসন অবসানের ঘটনাপ্রবাহ মনে করিয়ে দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “ঘটনাটা শুরু হয় ৫ অগাস্ট, যখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশ ত্যাগ করেন। তখন সারাদেশজুড়ে মানুষ উদযাপন করছিল—অবশেষে আমরা মুক্ত। সুতরাং, আমরা ভেবেছিলাম যে ৫ অগাস্টই সবকিছুর ইতি, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে এই অধ্যায় শেষ। এখন এটি একটি নতুন দেশ, যেখানে তারা নেই।
“কিন্তু যারা পালিয়ে গেছে, তাদের জন্য এটা তখনো শেষ হয়নি। তারা এখনও আরেক দেশ থেকে একই কাজ করে যাচ্ছে, মানুষকে উসকে দিচ্ছে, রাস্তায় সংঘর্ষ করছে। এখন ১০ মাস পার হয়ে গেছে, কিন্তু ওই দলগুলোর কেউই এখন পর্যন্ত কোনো অনুশোচনা বা দুঃখ প্রকাশ করেনি। কেউ বলেনি, ‘এই ঘটনার দায় আমার নয়, তবে আমি এতে জড়িত ছিলাম বলে খুব কষ্ট পাচ্ছি।’ কেউ বলেনি। ফলে, আমাদের কাছে এটা শেষ, কিন্তু তাদের কাছে এটা এখনও চলছে।”