Published : 12 May 2025, 12:48 AM
দল হিসেবে বিচার হওয়ার আগে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরদিন এ নিয়ে বক্তব্য এসেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে।
বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ও গণঅধিকার পরিষদ এ বিষয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরেছে।
গণ অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলের দাবির মুখে শনিবার রাতে জরুরি বৈঠকে উপদেষ্টা পরিষদ সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ব্ঠৈক শেষে বিফ্রিংয়ে বলেন, পরর্বর্তী কার্যদিবসে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
সভায় একই সঙ্গে জুলাই আন্দোলন দমনে ‘মানবতাবিরোধী’ অপরাধের অভিযোগে আওয়ামী লীগকে বিচারের মুখোমুখি করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধনী আনার সিদ্ধান্তও নেয় উপদেষ্টা পরিষদ।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধনের গেজেটও জারি হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের খবরের লাইভ দেখার পর শাহবাগ ও ইন্টারকন্টিনেন্টালে টানা অবস্থানে থাকা এনসিপি, কয়েকটি ইসলামী দল ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা উল্লাস প্রকাশ করে। মধ্যরাতে জামায়াতে ইসলামেও শোকরানা সমাবেশ করে।
এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নেয় এনসিপি, ছাত্রশিবিরসহ কয়েকটি ইসলামী দলের সদস্যরা। শুক্র ও শনিবার তারা শাহবাগে অবস্থান করে। সেখানে গিয়ে জামায়াতে ইসলামী, গণ অধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন ইসলামী দলের নেতারা সংহতি জানান। পরে জরুরি ব্ঠৈকে বসে সিদ্ধান্ত নেয় উপদেষ্টা পরিষদ।
এ সিদ্ধান্তের পরদিন রোববার বিকালে বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপকে ‘সঠিক’ আখ্যা দিয়ে বিবৃতি দেয়।
দলের অবস্থান তুলে ধরে বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘‘আমরা আনন্দিত যে, বিলম্বে হলেও গতরাতে (শনিবার) অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ফ্যাসীবাদী সরকারের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার দ্রুত করার এবং বিচারকার্য নির্বিঘ্ন করার স্বার্থে ফ্যাসীবাদী দল আওয়ামী লীগ ও তার সাথে যুক্ত সকল সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
‘‘প্রাসঙ্গিক আইন সংশোধন করে বিচারিক প্রক্রিয়ায় গুম, খুন, নিপীড়ন ও জনগণের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন অপশাসন চালনাকারী, ফ্যাসীবাদী দলের বিচার করার সিদ্ধান্তকে আমরা সঠিক বলে মনে করি।”
বিএনপি বলছে, তারা অনেক আগে থেকেই এসব দাবি জানিয়ে আসছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে তারা এসব নিয়ে কথাও বলেছে।
দলটি মনে করছে, তাদের দাবি মেনে আগেই ‘এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে’ চাপের মুখে ব্যবস্থা নেওয়ার মত ‘বিব্রতকর ও অনভিপ্রেত’ অবস্থায় সরকারকে পড়তে হত না।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের প্রেস সচিব খন্দকার দেলোয়ার জালালি বলেন, তাদের দল এই সিদ্ধান্তের ‘পক্ষে নয়’ বলে শনিবার রাতেই দলের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, এর আগে শনিবার দুপুরে জাতীয় পার্টির বনানীর কার্যালয়ে ছাত্র সমাজের এক সভায় কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের পক্ষে না থাকার কথা বলেছেন চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের।
সেখানে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, “আমরা বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করছে বা করতে চায় এমন কোন দলকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে আমরা নই। আওয়ামী লীগ সরকার যখন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছে, আমরা তার প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু যদি গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে প্রশ্ন আসে একাত্তর সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ব্যাপক গণহত্যার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দায়ী সংগঠনগুলোর বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত হবে? কারণ বাংলাদেশের ইতিহাসে সব চেয়ে বেশি গণহত্যা হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়।”
এদিকে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় রোববার দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে গণঅধিকার পরিষদ।
সংবাদ সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান লিখিত বক্তব্যে বলেন, “শুধু সাংগঠনিক নিষেধাজ্ঞা নয়, আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত নিবন্ধন বাতিল না হলে এই গণঅভ্যুত্থান অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নের পাশাপাশি নিবন্ধন বাতিল এবং চূড়ান্তভাবে দলটিকে নিষিদ্ধ করতে নির্বাচন কমিশন কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলেও আশা করে গণঅধিকার পরিষদ।”
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ এক বিবৃতিতে গণহত্যার অভিযোগে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীরও বিচার দাবি করেছেন।
বিবৃতিতে তিনি বলেন, “জুলাই গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে রাজনীতি করার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত পনের বছরের শাসনে আওয়ামী লীগ দেশের সকল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে, অসংখ্য মানুষের গুম-খুন ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী। এখনও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জুলাই গণহত্যাসহ তাদের বিগত কর্মকাণ্ডের জন্য ন্যূনতম অনুশোচনাও নেই।
”কিন্তু তারপরও সন্ত্রাস দমন আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের মত অগণতান্ত্রিক আইনের মাধ্যমে নির্বাহী আদেশে কোন রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা অথবা কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার মত যেকোন সিদ্ধান্ত দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণের পথে প্রতিবন্ধক।”
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের আইন সংশোধন করে জুলাই গণহত্যাসহ সব রাজনৈতিক ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দায়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার করার মাধ্যমে তাদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া সঠিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বলে তিনি মনে করেন।
বিবৃতিতে তিনি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের বিচারের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধ এবং মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার দায়ে জামায়াতে ইসলামীরও বিচার দাবি করেন।
আইনজীবী অধ্যাপক শাহদীন মালিক আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেছেন। রোববার তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ট্রাইব্যুনালকে ক্ষমতা দিয়ে সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের সংশোধন করেছে। সে হিসেবে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম বা দল নিষিদ্ধের ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালের।
“আমি রাজনীতিবিদ হিসেবে নয়, বিষয়টি আইনের দৃষ্টিভঙ্গিতে মূল্যায়ন করব। সরকার বা যারা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি করছে, তাদের উচিত ছিল ট্রাইব্যুনালের কাছে দরখাস্ত করা। ট্রাইব্যুনালের কাছে চাওয়া যেন কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। এরপর ট্রাইব্যুনাল দলটিকে নিষিদ্ধ করলে তা অধিকতর আইনসঙ্গত হবে।”
আরেক আইনজীবি জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করলে তো রাজনৈতিক দল থেকে যাচ্ছে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধের কোনো সুযোগ নেই। সুযোগ আছে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার। ফলে রাজনৈতিক দল যদি না থাকে তাহলে তাদের কর্মকাণ্ড থাকারও কোন সুযোগ থাকছে না।”
ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত হলে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ, সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের বিধান
নিষিদ্ধ হচ্ছে আওয়ামী লীগ, বিচারেরও পথ খুলছে
'সন্ত্রাসী' সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ ঘোষণা