Published : 09 Jun 2025, 01:18 AM
ছাত্র রাজনীতি থেকে জাতীয় নেতৃত্ব তৈরির যে প্রবণতা চলে আসছে, সেটিকে ‘ভুল ধারণা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান তোফায়েল আহমেদ।
তার ভাষ্য, এই নেতৃত্ব আসা দরকার স্থানীয় সরকার থেকে। কারণ জনসাধারণের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতাধারীরা সংকট অনুধাবনের পাশাপাশি তা উতরানোর পথও বাতলাতে পারেন।
অধ্যাপক তোফায়েল এও মনে করেন, স্থানীয় সরকার থেকে জাতীয় নেতৃত্ব তৈরি হলে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে। আর স্থানীয় সরকারকে কার্যকর করতে এর কাঠামো ও ভোট পদ্ধতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনা জরুরি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ইনসাইড আউটে অংশ নিয়ে বিদ্যমান স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার দুর্বলতা, প্রস্তাবিত কাঠামো ও ভোটের ধরন পরিবর্তন, নারী নেতৃত্ব বিকাশের বিকল্প পথ নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল।
রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করা হয়।
স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনেরও সদস্য। তিনি ২০০৬-২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠিত 'স্থানীয় সরকার কমিশনের' সদস্য ছিলেন।
স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী ও কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব প্রণয়ন করার লক্ষ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদকে প্রধান করে গত ১৮ নভেম্বর স্থানীয় সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়।
এই অধ্যাপকের নেতৃত্বে কাজ করেন সাত সদস্য। গত ২০ এপ্রিল তারা দুই খণ্ডের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে তুলে দেন।
এ প্রতিবেদনে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংসদীয় পদ্ধতির আদলে পুনর্বিন্যস্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন পৃথক আইনের বদলে একটি আইনের অধীনে আনতে বলা হয়েছে। আর এসব প্রতিষ্ঠানের ভোট এক তফসিলে একসঙ্গে করার সুপারিশ করা হয়েছে।
এই প্রতিবেদন জমার দেড় মাস বাদেও তা বাস্তবায়নের কোনো সম্ভাবনা দেখতে না পেয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন কমিশন প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল।
তিনি বলেন, “আমরা রিপোর্ট দিলাম এপ্রিলের ২০ তারিখ।… কোনো আলোচনা তো হয়নি। আর সামনে যে হবে তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
“তবে হ্যাঁ, এটার একটা আর্কাইভাল ভ্যালু হবে; এটাই মনে হচ্ছে আরকি।”
এ পরিস্থিতির জন্য রাজনীতিক ও স্থানীয় সরকারের নেতৃত্বেরও দায় দেখছেন তোফায়েল আহমেদ।
তার ভাষ্যে, “এখানে রাজনীতিবিদ এবং লোকাল গভর্মেন্ট- যারা লিডারস, যারা কাউন্সিলরস অ্যান্ড মেম্বারস- তাদের মধ্যে কিন্তু কোনো সংস্কার চেতনা নাই। কারণ আমরা এগুলো নষ্ট করে ফেলেছি।”
সব নেতৃত্ব ‘স্টুডেন্ট পলিটিক্স’ থেকে?
গত ৫ অগাস্টের পর সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভায় আওয়ামী লীগ সমর্থক মেয়র, চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, কাউন্সিলররা অনুপস্থিত থাকায় নাগরিক সেবা ব্যাহত হচ্ছিল। এ পরিস্থিতিতে আইন সংশোধন করে সেই সব সংস্থার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সরিয়ে বসানো হয়েছে প্রশাসক।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, “শূন্যতা তৈরি করা হয়েছে, এটা প্রসেসের মাধ্যমে হয়েছে। একটা হচ্ছে- একদল লোক পালিয়ে গেছেন বা আত্মগোপনে গেছেন বা অনুপস্থিত- সেটা একটা শূন্যতার কারণ। আরেকটা হচ্ছে যা আছে, তাদেরও বাতিল করে দিয়ে একটা নতুন শূন্যতা সৃষ্টি করা হয়েছে।”
বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে স্থানীয় সংস্থার সেবা দেওয়া হচ্ছে। সমাজে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার প্রশ্নে তাদের চাইতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভূমিকা বেশি ছিল বলে মনে করেন অধ্যাপক তোফায়েল।
তিনি বলেন, নেতৃত্ব বিকাশে স্থানীয় সরকারকে ধর্তব্যের মধ্যে না রাখা একটা ‘ভুল ধারণা’।
“নেতৃত্ব বিকাশের জন্য এই যে লোকাল গভর্মেন্ট সিস্টেমটাকে আমরা খুব একটা ধর্তব্যের মধ্যে নিইনি। আমরা মনে করি, সমস্ত নেতৃত্ব আসবে স্টুডেন্ট পলিটিক্স থেকে, এটা একটা রং কনসেপ্ট; দুনিয়ার কোনো দেশে এটা হয় না।”
কেবল ক্যাম্পাস রাজনীতি করে জাতীয় নেতা বনে যাওয়ার সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা তুলে ধরতে গিয়ে তোফায়েল আহমেদ বলেন, “আমি কোনো জনসাধারণের জন্য কাজ করলাম না। ইউনিভার্সিটিতে পড়লাম। ক্যাম্পাসে মিছিল করলাম। ক্যাম্পাসের নেতা হয়ে আমি জাতীয় নেতা হয়ে যাব। আমি তো দেশের কোনো সমস্যা বুঝব না; বুঝতেছিও না।
“কারণ, এটা একটা অন্য ধরনের একটা রোমান্টিসিজম কাজ করে। তখন ওই ক্যাম্পাসের মধ্যে ক্যাম্পাস রাজনীতি। ক্যাম্পাস রাজনীতি ডিফারেন্ট জিনিস।”
তিনি মনে করেন, নেতৃত্ব বিকাশের জন্য স্থানীয় মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ, মেলামেশা, সমস্যা সমাধানের স্থানীয় অভিজ্ঞতা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
“ক্যাম্পাস রাজনীতি হবে- এটা ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক। কিন্তু আমরা ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক জিনিসটাকে জাতীয় রাজনীতির রূপ দিয়েছি। জাতীয় রাজনীতি নির্ধারক করে দিয়েছি তাদেরকে। তাতে করে রিয়েল অর্থে রাজনীতির যে গুণগত পরিবর্তন- যেটা আসা দরকার, নেতৃত্ব বিকাশের যে প্রক্রিয়া- সেটা কিন্তু ভিন্ন দিক থেকে শুরু করেছি আমরা।”
স্থানীয় সরকারে কাজ করার অভিজ্ঞতা গুরুত্ব তুলে ধরতে গিয়ে অধ্যাপক তোফায়েল বলেন, “লোকাল গভর্মেন্ট কাজ করলে একটা লোক… হত কি; মানুষের সাথে মেলামেশা যেমন হতো, মানুষের সমস্যা জানতে পারতো। ইন্টারেকশনটা হত এবং ওয়ান টু ওয়ান বুঝতে পারক কীভাবে সমস্যার সমাধান করা যায়।
“তার কিছু অর্থ খরচের একটা বিষয় থাকত। ওখানে একটা বিরোধ মীমাংসার বিষয় থাকতো। সমাজ, প্রশাসনের বিষয় থাকতো। এগুলো করে কিন্তু তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠতো।
“তাহলে এখান থেকে নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়। আমাদেরও দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু মন্ত্রী ছিলেন। তারা কিন্তু একসময় লোকাল গভর্মেন্টের চেয়ারম্যান ছিলেন। পৌরসভার মেয়র ছিলেন।”
তোফায়েল আহমেদ বলেন, “স্থানীয় সরকারের একটা বড় কাজ- জাতীয় গণতন্ত্রের জন্য, জাতীয় পার্লামেন্টের জন্য লোকাল পার্লামেন্টেরিয়ান থেকে গ্র্যাজুয়ালি তাদেরকে শিক্ষিত করে তোলা। আমাদের দেশে এই প্রচেষ্টা কিন্তু লোকাল গভর্মেন্টে হয়নি। এটা কিন্তু শুরু করা যেত।”
স্থানীয় সরকার হবে ‘স্থানীয় সংসদ’
স্থানীয় সরকারের পাঁচটি স্তরকে স্থানীয় সংসদ নামে বর্ণনা করছেন অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ।
তিনি বলেন, “আমরা শুধু জাতীয় পার্লামেন্টের কথা বুঝি, জাতীয় সংসদের কথা বুঝি; কিন্তু লোকাল গভর্মেন্টের যে প্রতিষ্ঠানগুলো- এগুলো কিন্তু একটা সংসদ। জাতীয় সংসদ যদি একটা কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে পলিসি নেওয়ার সংসদ হয়ে থাকে; এখানে পাঁচটি সংসদ (ইউপি, পৌরসভা, জেলা, উপজেলা ও সিটি করপোরেশন)।”
স্থানীয় সরকারের এসব প্রতিষ্ঠানকে সংসদীয় কাঠামোতে পুনর্বিন্যাসের সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানান তোফায়েল আহমেদ।
তিনি বলেন, “আমরা এটাকে পুনর্বিন্যাস করেছি যে- রিয়াল অর্থে এটা সংসদের মত কাজ করবে। ওই লেভেলে, ওই পর্যায়ে, লিমিটেড যে- তাদের যে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা, তারা এটা প্রয়োগ করবে। সেজন্য এখানে নির্বাহী এবং আইনকে পৃথক করেছি আমরা।”
সুপারিশ তুলে ধরতে গিয়ে তোফায়েল আহমেদ বলেন, “চেয়ারম্যান ও মেয়র হবেন নির্বাহী। এটা আইন বিভাগের মতো ফাংশন করবে।
“ওখানে একজন স্পিকার টাইপের একজন ব্যক্তি থাকবেন। সভাধিপতি- মেম্বারদের ভোটে হবে।”
তিনি বলেন, প্রস্তাবিত পদ্ধতিকে গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে হলে পরিষদের সবাইকে মেম্বার বা কাউন্সিলর নির্বাচিত হতে হবে।
“আমরা বলেছি, এ সিস্টেম করলে সবাইকে মেম্বার হওয়া লাগবে, সবাইকে কাউন্সিলর হতে হবে। কাউন্সিলররা মেয়র করবেন এবং অনাস্থা দিলে মেয়র তখন আবার সদস্য হয়ে যাবেন। বেরিয়ে যাবেন না। অনাস্থা দেবে পরিষদ। এটাকে অনেকে ধরে নিয়েছে- আইয়ুব খানের সিস্টেম হয়ে গেছে।”
ষাটের দশকে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামে স্থানীয় সরকার পদ্ধতি চালু করেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে তার পতনের সঙ্গে এই ব্যবস্থারও অবসান ঘটে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল বলেন, “মৌলিক গণতন্ত্র খারাপ ছিল কেন? কারণ মৌলিক গণতন্ত্রের অধীনে সকল ভোট জনসাধারণের পক্ষে মৌলিক গণতন্ত্রীরা দিত।…পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের সেই মৌলিক গণতন্ত্র খারাপ ছিল।
“এটা তো মৌলিক গণতন্ত্র না। এটা পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি। আমরা প্রাইম মিনিস্টার নির্বাচন করি না, প্রাইম মিনিস্টার তো এমপিরা নির্বাচন করেন।”
তিন ব্যালটে পাঁচ স্তরের ভোট
স্থানীয় সরকারের পাঁচটি স্তরের ভোট একসঙ্গে করার ভাবনা নিয়ে ইনসাইড আউটে একটি ব্যাখ্যা দেন অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ।
তিনি বলেন, “এখন পাঁচটা নির্বাচন করতে হয় লোকাল গভর্মেন্টে। একটা হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা- এই তিনটা ইলেকশন কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের মতই হয়।
“আর সিটি করপোরেশন এবং জেলা পরিষদ নির্বাচন একটু কম উত্তেজনাপূর্ণ হয় বা এটা লোকালাইজড হয়।”
এটিই ‘সবচেয়ে সহজ’ নির্বাচন পদ্ধতি মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কিন্তু আমরা যে সিস্টেম করেছি, এই সিস্টেমে হচ্ছে- ইলেকশনটা হয়ে যাবে, অত্যন্ত সহজ একটা ইলেকশন। পাঁচটা প্রতিষ্ঠানের ইলেকশন এক সাথে। কিন্তু মানুষ ভোট দেবে- ইউনিয়নের একটা ভোটার ভোট দিবে তিনটা।”
ভোটদান প্রক্রিয়া কী হবে, তার ব্যাখ্যায় অধ্যাপক তোফায়েল বলেন, “কেন্দ্রে ঢুকে তিনটা ব্যালট পাবে। একটা ব্যালট তার ইউনিয়ন পরিষদের, তার ওয়ার্ডের মেম্বারের। আরেকটা ব্যালট হচ্ছে সে যে উপজেলা পরিষদের ওয়ার্ডে পড়েছে, সেই উপজেলা পরিষদের একটা ব্যালট। আর জেলা পরিষদের যে ওয়ার্ডের মধ্যে সে পড়েছে, সেই জেলা পরিষদের একটা ব্যালট।
“ভোটার তিনজনকে তিনটা ব্যালট পেপারে ভোট দিয়ে চলে আসবে। এখানে আর ঝামেলা নাই। যারা পৌরসভার ভোটার, তারাও তিনটা ভোট দিবে। একটা তার নিজের ওয়ার্ড, একটা ভোট হচ্ছে উপজেলার ওয়ার্ড; আরেকটা হচ্ছে জেলা পরিষদের ওয়ার্ড।”
তিনি বলতে থাকেন, তবে যারা সিটি করপোরেশনে, তারা ভোট দেবেন দুটো।
“কারণ সিটি করপোরেশনের বাসিন্দার উপজেলায় ভোট দেওয়ার দরকার নাই। তারা ভোট দেবে তার সিটির কাউন্সিলরকে। আর জেলা পরিষদের কাউন্সিলরকে। ব্যাস, ফিনিশ। ইজিয়ার ভোট।”
নির্বাচিত মেম্বার বা কাউন্সিলররাই চেয়ারম্যান বা মেয়র নির্বাচিত করবেন।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন প্রধান বলেন, “এই সিস্টেমটাকে আমরা চাইছিলাম ডেমোক্রেটিক স্বচ্ছ জবাবদিহিমূলক। এ সিস্টেমে সকলকে আগে মেম্বার হওয়া লাগবে। কাউন্সিলর হওয়া লাগবে।
“কাউন্সিলর হওয়ার পরে কাউন্সিলররা মেয়র করবেন এবং অনাস্থা দিলে মেয়র তখন আবার সদস্য হয়ে যাবেন।… একবার একটা ইলেকশন হলেই কিন্তু জিনিসটার উপকারিতাটা বোঝা যেত।”
এ পদ্ধতিতে ভোট হলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে সরকারের ব্যয়ও কমে আসবে বলে অধ্যাপক তোফায়েলের ভাষ্য।
তিনি বলছেন, ২০২১-২৪ সালে স্থানীয় নির্বাচনে ইসির যেখানে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৩০০ কোটি টাকা; সেখানে প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে খরচ হবে মাত্র ৬০০ কোটি টাকা।
ঝামেলা এড়াতে এক তফসিলেই জেলা বা বিভাগওয়ারি ভোট করা যেতে পারে বলে মত দেন তিনি।
নারীদের জন্য ‘ঘূর্ণায়মান’ পদ্ধতি
নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতির সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
এ পদ্ধতির প্রচলন ভারতে রয়েছে জানিয়ে অধ্যাপক তোফায়েল বলেন, “স্থানীয় সরকারে এখন এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষিত থাকে নারীদের জন্য। কিন্তু আসন নির্দিষ্ট নেই। এটা সুপার আসন, তিনজনের উপর একজনকে ইম্পোজ করে দেন।
“তো সে নিজে কোথাও কিন্তু পা ফেলতে পারে না ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষেত্রে। উপজেলার ক্ষেত্রে দুইজন ভাইস চেয়ারম্যান, একজনকে নারী ভাইস চেয়ারম্যান রয়েছে। তার কাজ কী, তার কোনো দিশা নেই। সেজন্য ঘূর্ণায়মান পদ্ধতির সুপারিশ করা হয়েছে।”
এ পদ্ধতির ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “একটা উপজেলায় যদি ইউনিয়ন পরিষদে নয়টা আসন থাকে, তিনটা আসন এক নির্বাচনের জন্য ফিক্সড করে দেন।
“এই তিনটা আসনে শুধু নারীরা এবার কন্টেস্ট করবে। তারপর এক নির্বাচনের পরে ওই তিনটা ওপেন হয়ে যাবে, আর তিনটা রিজার্ভ হবে। তারপর আর তিনটা রিজার্ভ হবে।”
অধ্যাপক তোফায়েল বলেন, প্রার্থী হতে ভোটার হলেই হবে, যে কোনো আসন থেকে দাঁড়াতে পারবেন। জটিলতা এড়াতে এমন বিধানের সুপারিশ করা হয়েছে।
জনসংখ্যা ও আয়তন বিবেচনায় ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড সংখ্যা সর্বনিম্ন ৯ এবং সর্বোচ্চ ৩৯ করার প্রস্তাব করেছে এ কমিশন।
‘দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকারের ভোট নয়’
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে চালু হওয়া দলীয় প্রতীকে ভোটের বিধান নিয়ে সমালোচনা করেন তোফায়েল আহমেদ।
তিনি বলেন, “তারা কিন্তু দলীয় প্রতীকে যে দিয়েছে, এখানে একটা চালাকি করেছে। মেয়র হবে দলীয় প্রতীকে আর কাউন্সিলর এবং মেম্বাররা হবে নির্দলীয় প্রতীকে। এটা কী ধরনের সিস্টেম হল, আধা খেঁচড়া।
“সেজন্য এটা অনেক আগে থেকে প্রবল জনমত ছিল যে- অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা যারা সমাজকর্ম করেন- দলীয় না, তারাই নির্বাচন করুক। এটা আগে থেকেই ছিল। সুতরাং, আমরাও কিন্তু এটা ধারাবাহিকতা রক্ষার কথাই বলেছি।”
এ নির্বাচন বিশেষজ্ঞের ভাষ্য, “এখানে সব অরাজনৈতিক ব্যক্তি আসবে, তা না…তাহলে মানুষ সত্যিকার অর্থে একজন লোকাল লিডার বেছে নিতে পারবে। এই সুযোগটা সৃষ্টি হবে। আর দলীয় নির্বাচনে ফিরে যাক- এটা বলিনি; নির্দলীয় হবে- সেটাও বলিনি।”
স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থীদের শিক্ষাযোগ্যতা নির্ধারণের সুপারিশ এলেও তা সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করেনি বলে জানান কমিশন প্রধান তোফায়েল।
তিনি বলেন, “প্রবল জনমত ছিল, শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়া। আমরা অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি এটি সম্ভব না।
“কারণ, সংবিধান অ্যালাউ করবে না। এটা এটা একটা মামলা হয়ে বাতিল হয়ে যাবে।”
‘অন্ধের হাতি দেখা’
তোফায়েল আহমেদ বলেন, স্থানীয় সরকারের যুতসই ব্যবস্থা দেশে গড়ে ওঠেনি।
“আমাদের স্থানীয় সরকার সমস্যাটা সবাই বুঝতে চাচ্ছেন না। একেকজন একেকভাবে দেখছেন। অন্ধের হাতি দেখার মত। কারণ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বলে কোনো জিনিস এদেশে ডেভেলপ করেনি। কতগুলো প্রতিষ্ঠান ডেভেলপ করেছে বিভিন্ন সময়ে, একটা থেকে আরেকটার অনেক ব্যবধান, সময়ের ব্যবধান।”
বিদ্যমান ব্যবস্থায় ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদে রাজনৈতিক ও স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ঘটছে, অন্যদিকে জেলা পরিষদ ভোটে জনসাধারণের সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ নেই।
অধ্যাপক তোফায়েল বলেন, “এখন স্থানীয় সরকারের কিন্তু কোনো স্তরেই সত্যিকার অর্থে পরিষদ সিস্টেম কাজ করছে না। মেয়র এবং চেয়ারম্যানের ইচ্ছা মত এটা চলে।”
স্থানীয় সরকারের জন্য অভিন্ন কাঠামো আনার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
তোফায়েল বলেন, “সব বিষয় মাথায় রেখে আমরা চেষ্টা করেছি একটা অভিন্ন কাঠামো দাঁড় করাতে। এটা বহু বছর ধরে আলোচনা হচ্ছিল- বিভিন্ন জায়গায়, ‘সমজাতীয় কাঠামো সব জায়গায় থাকুক’।
“সবগুলো প্রতিষ্ঠানকে সমজাতীয় কাঠামো এবং সিটি কর্পোরেশন এবং পৌরসভাকেও একইরকম কাঠামোর মধ্যে আনার চেষ্টা করা হয়েছে।”
জাতীয় নির্বাচন আলাদাভাবে
স্থানীয় সরকার আর জাতীয় নির্বাচন আলাদাভাবে আয়োজনের পক্ষে তোফায়েল আহমেদ।
তিনি বলেন, “জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন একই দিনে করতে বলছি না। জাতীয় সংসদ আলাদা থাকুক, এটাকে স্থানীয় সরকারের সাথে মিলিয়ে লাভ নেই। কারণ এটার ইস্যু ডিফারেন্ট।
“এটার উত্তেজনা ডিফারেন্ট। এটার স্থানীয় সাথে মিলায়ে ফেললে তখন কিন্তু কনফিউশন হবে।”
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন প্রধান বলেন, সবগুলো স্থানীয় নির্বাচন একসঙ্গে করার লক্ষ্যে স্থানীয় নির্বাচন আইন আগে ঠিক করতে হবে।
“সেজন্যই আগে করো, পরে করো- এ কথা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়নি। কিন্তু সার্ভের মধ্যে জনগণ বলেছে এটা। যেমন ৬৫ শতাংশ মানুষ স্থানীয় নির্বাচন আগে চায়।
“আর পার্বত্য এলাকায় শুধু জেলা পরিষদ নির্বাচনটা- সেখানকার ৮৬ শতাংশ মানুষ চায় অবিলম্বে করা হোক। সুতরাং, এটা আমরা কিন্তু কোনো মতামত দিইনি। আমরা বলছি, সংস্কারটা আগে।”
সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয়
স্থানীয় সরকার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমার দেড় মাস পার হলেও তার বাস্তবায়ন শুরু না হওয়ায় খেদ প্রকাশ করেছেন কমিশন প্রধান তোফায়েল।
তিনি বলেন, তাদের সুপারিশ যে সামনে বাস্তবায়ন হবে তার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
“তবে হ্যাঁ, এটা (প্রতিবেদন) একটা আর্কাইভাল ভ্যালু হবে, এটাই মনে হচ্ছে।”
আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, “হিমাগারে বলব না। আর্কাইভাল ভ্যালু হচ্ছে- এটা ছাপা হবে, ছাপা হওয়ার পরে আপনি পড়তে পারবেন। বলা হবে একদা কোনো একটা কমিশন ছিল, তারা একটা রিপোর্ট দিয়েছিল। রিপোর্টে এই কথাগুলো বলা ছিল।
“এটার এই সমালোচনা ছিল, এই ভালো দিক ছিল। ইতিহাসে একটা আর্কাইভাল ভ্যালু থাকবে।”
সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সহযোগিতা দরকার বলে মনে করেন তোফায়েল আহমেদ।
তিনি বলেন, “এটা তারা বাস্তবায়ন করতে পারবে না। (অন্তর্বর্তী সরকার) শুরু করেছিলেন ভালো কমিশন করে, রিপোর্ট নিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবায়নের জন্য যেই অবস্থাটা সে অবস্থাটা, তেমন সংস্কারবান্ধব বা সংস্কারমুখী একটা সহযোগিতা রাজনৈতিক দিক থেকে আসেনি।”
ভারতের উদাহরণ টেনে অধ্যাপক তোফায়েল বলেন, “সেখানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে যেসব জায়গায় সংস্কারের প্রস্তাব এসেছে, সেখানে সাকসেসফুল। কিন্তু এখানে রাজনীতিক এবং লোকাল গভর্মেন্ট যারা লিডারস, যারা কাউন্সিলরস অ্যান্ড মেম্বারস, তাদের মধ্যে কিন্তু কোনো সংস্কার চেতনা নাই। কারণ, আমরা এগুলো নষ্ট করে ফেলেছি।”
ইশরাকের ঘটনা এখন ‘পলিটিক্যাল প্রবলেম’
ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র হিসেবে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের শপথ পড়ানো নিয়ে যে জটিলতা দেখা দিয়েছে তা আর আইনগত জায়গায় সীমাবদ্ধ নেই বলে মনে করেন তোফায়েল আহমেদ।
তিনি বলেন, “গড়িমসি করে এখন ডাইমেনশন পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে। এখন তো আর (করপোরেশনের মেয়াদ) সময় নেই। এখন তো আপনি বড় ধরনের ফাঁদে পড়ে গেছেন।
“তাইলে এ প্রবলেমটা কিন্তু এখন লিগ্যাল প্রবলেমে নেই। এটা কিন্তু পলিটিক্যাল প্রবলেম হয়ে গেছে, রাজনৈতিক সমস্যা এখানে।”
স্থানীয় সরকার কমিশনের প্রধান বলেন, “এগুলো কেন সৃষ্টি করা হচ্ছে? এগুলো হচ্ছে এক ধরনের পলিটিক্যাল মোটিভেশন, ডিফারেন্ট যারা দায়িত্বে আছেন তারা। আরেকটা হচ্ছে ব্যুরোক্রেটিক এক ধরনের অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছে। কোনোটাই কাম্য ছিল না।”
পাঁচ বছরের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মাস দুয়েক আগে আদালতের রায়ে মেয়র হওয়ার সুযোগ পান ইশরাক হোসেন। এরপর ইসি তাকে মেয়র ঘোষণা করলেও আইনি জটিলতার কথা বলে তার শপথগ্রহণের ব্যবস্থা নেয়নি স্থানীয় সরকার বিভাগ।
এ ধরনের সমস্যার সমাধান রাস্তায় বসে করা যায় না মন্তব্য করে অধ্যাপক তোফায়েল বলেন, “আর তারাও যারা, ইশরাক সাহেব তিনিও। কোর্টের রায় হয়েছে, কোর্টের রায় বাস্তবায়ন করছে না। উনাকে আবার কোর্টে যেয়ে সমাধান আনতে হবে। রাস্তায় বসে যাওয়া কোনো সমাধান না।
“প্রতিষ্ঠানটা রাস্তায় বসে গিয়ে সেবা বন্ধ করে দেওয়া, রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেওয়া এটা কোনো সমাধান না। কোর্ট এটার সমাধান দিয়েছে একটা। এটা যখন প্রতিপালিত হচ্ছে না। আবার ইউ হ্যাভ টু গো টু কোর্ট। কোর্ট আবার সমাধান দেবে এটার। রাস্তায় বসে যাওয়া সমাধান ছিল না এটার- আমি মনে করি।”