Published : 24 May 2025, 01:50 AM
মিয়ানমারের রাখাইনে ‘মানবিক করিডোর’, চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়া এবং জাতীয় নির্বাচনের দাবি নিয়ে বিতর্কের মধ্যে বিএনপি ও এনসিপির পাল্টাপাল্টি মাঠে নামার ঘটনায় গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনীতিতে নতুন সঙ্কটের ঝুঁকি দৃশ্যমান।
‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধানের বক্তব্যের খবর সংবাদামাধ্যমে আসার পর প্রধান উপদেষ্টার ‘পদত্যাগের ভাবনার’ ঘটনায় সরকারের কর্তৃত্বের প্রশ্নটিও সামনে আসছে।
পরিস্থিতি বিচার করে রাজনীতির বিশ্লেষক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা যে বক্তব্য দিচ্ছেন, তাতে মোটা দাগে সরকারের দুর্বল কর্তৃত্ব, সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ, অভ্যুত্থানের পক্ষের দলগুলোর মধ্যে অনৈক্যকে নতুন এই সংকটের জন্য দায়ী করা হচ্ছে।
গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকা শিক্ষার্থীদের অনুরোধে তিনদিন পর অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিতে ফ্রান্স থেকে ছুটে আসেন নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস।
সেদিন বিমানবন্দরে ছাত্রনেতাদের অভ্যর্থনার জবাবে ইউনূস দেশবাসীর উদ্দেশে বলেছিলেন, “আপনারা যদি আমার ওপর আস্থা রাখেন, তাহলে নিশ্চিত করেন দেশের কোথাও কারো ওপরে হামলা হবে না। আমার কথা যদি আপনারা না শোনেন তাহলে আমার প্রয়োজন নেই। আমাকে বিদায় দেন। আমাকে প্রয়োজন মনে করলে আমার কথা আপনাদের শুনতে হবে।”
সেদিন সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারী ও তিনি বাহিনীর প্রধানদের অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, “আমরা একটা পরিবার। এখানে যাতে গোলযোগ না হয়, আমরা যেন এক সাথে চলতে পারি।”
গত ১০ মাসে বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা হলেও ইউনূস সরকারকে বড় কোনো বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়নি। কিন্তু এখন মিয়ানমারে
‘মানবিক করিডোর’ এবং বন্দর টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া নিয়ে সরকারের অবস্থানের কঠোর বিরোধিতা করেছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনেতিক দল।
জাতীয় নির্বাচন, সংস্কার ও জুলাই ঘোষণা, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা নিয়ে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই অভ্যুত্থানের পক্ষের দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য চলছে।
তার আগে ‘মব’ সৃষ্টি করে বাড়িঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, ডাকাতির মত ঘটনাতেও সরকার সমালোচিত হয়েছে।
দাবি আদায়ের মিছিলগুলো দিনে দিনে যমুনায় সরকারপ্রধানের বাসভবনের দরজায় কড়া নাড়ছিল। যমুনার সীমানা দেয়ালের কাছাকাছি স্থানে সভা-সমাবেশের নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে বিক্ষোভ চলেছে দিনরাত।
এমন পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের এক পর্যায়ে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন বলে গুঞ্জন ছড়ায়।
আগের দিন ঢাকা সেনানিবাসে ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচনের তারিখ, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ত্রাণ কার্যক্রমের জন্য কথিত করিডোর ও বিদেশি কোম্পানিকে সমুদ্র বন্দরের পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে নেতিবাচক অবস্থান তুলে ধরে বক্তব্য দেন। এতে করে সরকারের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বিরোধের বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এর মধ্যে উপদেষ্টা পরিষদ ছেড়ে এসে দল গঠন করা জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে আসার পর ইউনূসের পদত্যাগের অভিপ্রায়ের বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে আসে।
সাক্ষাৎ শেষে নাহিদ বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, “প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, তিনি কাজ করতে এসেছেন, কাজ করার মত পরিস্থিতি না থাকলে তিনি পদত্যাগের বিষয়টি ভাববেন।”
সঙ্কটের শুরু যেভাবে
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের মন্ত্রী-এমপি, আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। জুলাই আন্দোলনের ঐক্য মাস কয়েক বজায় থাকলেও প্রথমে ছাত্রদের মধ্যে ফাটল দেখা দেয়। তারপর রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ ও ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলেনের দূরত্ব তৈরি হয়।
এরপর ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্র আন্দোলন ও তাদের জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে নতুন দল এনসিপির আত্মপ্রকাশের পর সংস্কার ও নির্বাচন বিষয়ে মিত্র দলগুলোর মধ্যে বিভেদ স্পষ্ট হতে শুরু করে।
রাজপথ দখলে নিয়ে টানা বিক্ষোভ দেখিয়ে এনসিপি যে কৌশলে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি আদায় করে নিয়েছে, বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন সেই একই কৌশলে মেয়র পদে বসার চেষ্টা করলে এনসিপি সঙ্গে বিরোধ বাড়তে শুরু করে।
ইশরাককে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে শপথ পড়ানোর দাবিতে এক সপ্তাহ আগে নগর ভবনের সামনে লাগাতার আন্দোলন শুরু করেন তার সমর্থকরা। পরে তারা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের কাছে কাকরাইলে সড়ক অবরোধ করেও বিক্ষোভ দেখান।
সে বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে ইশরাক স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের পদত্যাগ দাবি করেন।
অন্যদিকে ইশরাককে মেয়র ঘোষণার গেজেট প্রকাশ করায় নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এনসিপি। কমিশন পুনর্গঠন দাবি করে তারা নির্বাচন ভবনের সামনে বিক্ষোভও করে।
সেখানে দলটির নেতা নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী পরিকল্পনা উপদেষ্ট ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে ‘বিএনপির মুখপাত্রা’ আখ্যায়িত করে তাদের পদত্যাগ দাবি করেন।
বৃহস্পতিবার বিএনপি জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে স্থানীয় সরকার, তথ্য ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের হুমকি দেয়।
এমন পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টার ‘পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশের’ গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।
এবি পার্টির চেয়ারম্যানের চোখে সরকারের কর্তৃত্ব ‘দুর্বল’
শুক্রবার জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু গত কয়েক মাসে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের দাবির আন্দোলনের চিত্র তুলে ধরেন।
সবশেষ পরিস্থিতি বর্ণনা করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলনের সময় প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনা ‘ঘেরাওয়ের’ মত কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। এ দাবি আদায়ের পর একইভাবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যমুনা ঘেরাও করেন। এরপর ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ইশরাক হোসেনকে শপথ পড়ানোর দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়।
মঞ্জু বলেন, এর বাইরে এনসিপি ও বিএনপির মধ্যে টানাপড়েন, নানা ধরনের কাদা ছোড়াছুড়ি ও বাকযুদ্ধ চলতে দেখা যাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে দুই পক্ষ থেকে তিনজন করে ছয় উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করা হয়, ইসি ‘ঘেরাও’ হয়েছে। দুই ছাত্র উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেছে বিএনপি।
এর আগে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনের পরপরই এনসিপির সঙ্গে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের বাকযুদ্ধ হয়েছে, সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ‘বক্তব্যকে’ ঘিরে এসব হয়েছে।
তার ভাষায়, “আমরা দেখলাম, বিএনপি-এনসিপি একেবারে মুখোমুখি অবস্থায় দাঁড়িয়ে গেছে। এটাকে কেন্দ্র করে সরকারের সাথেও এক ধরনের সম্পর্কের অবনতি তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের বিদেশ যাওয়া নিয়ে একটা টানাপড়েন তৈরি হয়।
“সবশেষ যেটা দেখলাম-বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অফিসার্স অ্যাড্রেসে যে বক্তব্য রেখেছেন, সে বক্তব্যগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও পত্রিকায় এসেছে। যে বক্তব্যের সঙ্গে সরকারের বক্তব্যের কিছুটা দ্বিমত আমাদের কাছে পরিলক্ষিত হয়েছে।
“এ প্রেক্ষাপটে আমরা দেখলাম, সরকারের সাথে রাজনৈতিক দল, প্রধান রাজনৈতিক দল, সরকারের সাথে ছাত্রদের যে রাজনৈতিক দল, একই সাথে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের ঘোলাটে পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আমাদের কাছে মনে হয়েছে সরকারের অবস্থান, সরকারের কর্তৃত্ব কিছুটা দুর্বল হয়েছে। সরকারের কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে পারছে না।”
রাজনীতি বিশ্লেষকরা যা বলছেন
এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার জন্য সরকারের দায় দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকারের গঠন কাঠামো ও কার্যাবলী সরকারকে এই পরিস্থিতির মধ্যে নিয়ে আসছে। সরকারের কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সরকার যদি যাথার্থভাবে কাজ করত, তাহলে এই ধরনের পরিস্থিতি আসত না।
“আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি হতে শুরু করে অনেকগুলো বিষয় খুব নিম্ন পর্যায়ের। বিচার ও সংস্কারের বিষয়ে নাগরিকদের আকাঙ্খাগুলো আরও দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার ছিল।”
পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “সরকার ৯ মাসে তাদের সাফল্য দেখাতে পারে নাই। জনগণের দাবিগুলোর বাস্তবায়ন করতে পারে নাই। সরকারের পুনর্গঠনটা গত ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদীদের লোকজন দিয়ে করা হয়েছে। যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছিল তাদেরকে দিয়ে করানো হয়নি।
“বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন ছিল এই সরকারের মূল কাজ। এই তিনটি কাজের কোনোটাতেই দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখাতে পারেনি সরকার। এসব কারণে সরকারের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছে। তারা নিজেরাও ভালো নাই। মানুষ বুঝতে পারছে না যে এই সরকারের মেয়াদ কতদিন হবে।”
সরকারের কী করা উচিত ছিল এমন প্রশ্নের উত্তরে মাহবুবুর রহমান বলেন, “নির্বাচন যখনই হোক একটা ডেডলাইন কিন্তু দেওয়া যেত। সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ঘন ঘন বসতে পারত। এখনও সময় আছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে সরকার সিদ্ধান্তে আসুক।”
এই পরিস্থিতির মধ্যে শনিবার দুপুর ১২টায় জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে এনসিপি। আর সন্ধ্যায় জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি নেতাদের সঙ্গে আলাদাভাবে বসার কথা রয়েছে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের।
সঙ্কট কেন? রাজনৈতিক দলের নেতারা যা বলছেন
বাংলাদেশ জাসদ এর স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক (জিএস) মুশতাক হোসেন মনে করেন, সরকার ও দলগুলো আলোচনা করে মীমাংসা করতে পারছিল না বলেই এ বিরোধগুলো প্রকাশ্যে এসেছে।
তার মতে, রাজনৈতিক দল, শিক্ষার্থী ও সামরিক বাহিনীকে আলাদা পক্ষ। এখন খোলামেলা আলোচনা করতে হবে, সবার ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। নির্বাচন যেন অর্থবহ হয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার দরকার।
সঙ্কট কাটানোর উপায় হিসেবে নির্বাচনের পথনকশা ঘোষণা করা দরকার বলে মনে করেন মুশতাক। তবে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে চান না তিনি।
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বের সারিতে থাকা এই নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন না হলে ভবিষ্যতে আর সংস্কার হবে না। পরাজিত দলটির নেতাদের বিচারের বিষয়ে একটা সন্দেহ আছে, হবে কি হবে না। এ বিষয়ে মানুষকে আশ্বস্ত করা দরকার। সংস্কার, নির্বাচন ও বিচারের একটা রোডম্যাপ দেওয়া হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারে।
“রাজনৈতিক দল ও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আলাপ করা যেতে পারে। কারণ জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তাদেরও অবদান ছিল।”
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্সও মনে করেন বিচার, সংস্কার ও একটি ভালো নির্বাচন আয়োজন অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ। কিন্তু সরকার নিজের সীমা নির্ধারণ না করে ‘অনেক বেশি’ কাজে হাত দিয়েছে।
বিচারকাজ শুরু করা সরকারের প্রথম কাজ ছিল মন্তব্য করে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিচারের কাজটা হয়ত শুরু হয়েছে। ভালো নির্বাচনের জন্য যা যা সংস্কার করা দরকার সেটা আগে করতে হত। কিন্তু তিনি এবং তার সরকার যে যে কাজে হাত দিলেন, সেটা অনেক বিস্তৃত। মানুষের মাঝে দীর্ঘদিনের অধিকার বঞ্চনা রয়েছে। সময় যদি বেশি নিয়ে নেয়, তাহলে মানুষ তো দাবিদাওয়া নিয়ে আসবেই।”
গণঅভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীর ‘বড় ভূমিকা’ থাকার কথা তুলে ধরে প্রিন্স বলেন, “অতীতে যা হয়েছে, কিন্তু এইবার গণঅভ্যুত্থানের পরে সেনাবাহিনী অনেক দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে।”
বন্দর ও করিডোর নিয়ে কাজ করা একটা অনির্বাচিত সরকারের দায়িত্বের মধ্যে ‘পড়ে না’ মন্তব্য করে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক বলেন, “জনগণের মনে প্রশ্ন জেগেছে যে, এদের উদ্দেশ্যটা কী? একটা ভালো নির্বাচন করে চলে যাওয়া? নাকি অন্য কারো স্বার্থ সংরক্ষণ করা।”
এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, দেশের ‘গণতান্ত্রিক রূপান্তর’ বাধাগ্রস্ত করে আরেকটা এক-এগারো করার ‘পাঁয়তারা চলছে’ বলে তারা মনে করছেন।
শুক্রবার এক ফেইসবুক পোস্টে তিনি এমন কথাও বলেছেন যে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে ‘দিল্লি থেকে ছক আঁকা হচ্ছে’।
অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য জয়নুল আবদিন ফারুক মনে করেন, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণায় ‘বিলম্বই’ দেশে অস্থিরতার কারণ।
ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক প্রতিবাদ কর্মসূচিতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের ‘পদত্যাগের ইচ্ছা’ বিষয়ে তিনি বলেন, “আপনি নন্দিত লোক, নিন্দিত হয়ে বিদায় যদি নেন আমরা মনে কষ্ট পাব।”
অবিলম্বে সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দাবি জানিয়ে বিএনপির এই নেতা বলেন, “যেই সংস্কারের মধ্য দিয়ে করিডোর হবে, চট্টগ্রাম বন্দর অন্যের হাতে চলে যাবে, এমন সংস্কার কইরেন না।”
যে সংস্কারের মধ্য দিয়ে ‘ষড়যন্ত্রকারীরা’ নির্বাচনকে বিলম্বিত করে সরকারকে অস্থির করে তুলবে তেমন সংস্কার না করতে আহ্বান জানান তিনি।
জয়নুল আবদিন বলেন, “অস্থিরতা কাটাতে হলে আজ-কাল-পরশুর মধ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে হবে।”
‘ভুল বোঝাবুঝি’ অবসানের প্রত্যাশা
সরকার, সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন বিভেদকে কেউ কেউ ‘ভুল বোঝাবুঝি’ মনে করছেন।
এ পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামী সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার জন্য প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। বৃহস্পতিবার জরুরি বৈঠক করে দলটির আমির শফিকুর রহমান এই আহ্বান জানান।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের আস্থার সঙ্কট হলে একটা জটিলতা তৈরি হবে-এমন মন্তব্য করে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মঞ্জু বলেছেন, বিএনপিসহ বেশ কটি রাজনৈতিক দলের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে এ সরকার কোনো না কোনোভাবে তাদের ‘ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত’ করতে চায়। এর বাইরে বন্দর ও করিডোর নিয়ে অনেক ধরনের অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে সরকার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সবার সঙ্গে পরামর্শ করতে পারতো মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমরা অনুরোধ করব, তিনি (ইউনূস) সরে গেলে এটার সমাধান হবে না। ওনার সরে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে কোনো রাজনৈতিক রঙ দেওয়ারও চেষ্টা করি, সেটাও আমাদের জন্য সমাধান বয়ে আনবে না।
“কারণ, উনি যদি এখান থেকে সরে যান, আমাদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে অন্য কেউ দায়িত্ব নিতে সাহস করবেন না। যে পরিস্থিতিতে এটা হচ্ছে এ পরিস্থিতিতে একটা শূন্যতা এবং একটা ভয়ভীতি অনেকের মধ্যে কাজ করবে।”
প্রধান উপদেষ্টার ‘পদত্যাগের অভিপ্রায় ভুল ও আত্মঘাতী’ বলে মন্তব্য করেছেন কলামনিস্ট ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। সেই সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাবাহিনীর মধ্যকার ‘ভুল বোঝাবুঝির’ অবসান চেয়েছেন তিনি।
ফরহাদ মজহার এক ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, “ড. ইউনূস পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করে ভুল করেছেন। পদত্যাগ করা হবে তার ব্যর্থতা, তার জন্য আত্মঘাতী। কোনো ব্যক্তি বা দল নয়, তার উচিত জনগণের ঐতিহাসিক অভিপ্রায়কে সম্মান করা, কোনো দল বা গোষ্ঠীর চাপে বিভ্রান্ত না হয়ে জনগণের ওপর আস্থা রাখা।”
তিনি লিখেছেন, “এই সকল লক্ষ্য অর্জনের জন্য জনগণ চায় প্রধান উপদেষ্টা ও বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ড. ইউনূসের ভুল বোঝাবুঝির অবসান হোক।”
এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ তার ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, “আমরা সবাই এক হয়েছিলাম বলে দীর্ঘ দেড় যুগের শক্তিশালী ফ্যাসিবাদকে তছনছ করতে পেরেছিলাম। আমরা খণ্ডবিখণ্ড হলে পতিত ফ্যাসিবাদ ও তার দেশি-বিদেশি দোসরেরা আমাদের তছনছ করার হীন পাঁয়তারা করবে।”
দেশ ও জাতির স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকার ওপর জোর দিয়ে তিনি লিখেছেন, “কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে এ ঐক্য নয়, বরং আমাদের দেশের জন্য ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই।”
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা মনে করেন, দেশ কোনো ধরনের রাজনৈতিক ঐক্যের পথে নেই। গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকেই তা ভেঙে গেছে।
সব পক্ষ যদি কিছুটা ‘পরিপক্বতা’ দেখাত, শহীদদের জীবনের কথা ভেবে কিছুটা ‘ছাড়’ দিত, তাহলে অন্তত নির্বাচনের আগপর্যন্ত দেশটা স্থিতিশীল থাকত বলে তিনি মনে করেন।
দেশকে স্থিতিশীল না হতে দেওয়ার জন্য অনেক ধরনের ‘বাহিনী’ ভেতরে সক্রিয় আছে, আর জুলাই এর সকল লড়াকু শক্তিই ক্ষমতা প্রশ্নে ‘অস্থির’ হয়ে গেছে-এমন মন্তব্যও এসেছে তার কাছ থেকে।
ফেইসবুক পোস্টে উমামা লিখেছেন, “রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, ধৈর্য ও টেবিলে ঐকমত্যের রাজনীতিই দেশকে একটা গণতান্ত্রিক উত্তরণের দিকে নিতে পারে।”
আরও পড়ুন:
ইউনূসের 'পদত্যাগ ভাবনা': ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলো যা লিখছে
ইউনূসের পদত্যাগের গুঞ্জন: কী ছিল তৈয়্যবের ফেইসবুক পোস্টে
পদত্যাগের কথা 'ভাবছেন' ইউনূস: নাহিদ