Published : 12 May 2025, 01:40 AM
আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ হওয়াকে ‘পোয়েটিক জাস্টিস’ আখ্যা দিয়ে এর ফলাফল ‘ইতিবাচক’ হবে বলেই মনে করছেন কলামনিস্ট ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। তার মতে, এখন বাংলাদেশের জনগণের সামনের লড়াই ধর্মীয় জাতিবাদের বিরুদ্ধে।
জনগণের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে তাতে সব ধরনের ‘ফ্যাসিবাদী’ শক্তিকে মোকাবেলা করার মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ গঠনের রাজনীতি করার তাগিদ এসেছে তার তরফে।
তার মতে, ফ্যাসিবাদী কোনো মতের বা কোনো মতাদর্শের রাজনৈতিক পুনর্বাসন চলবে না, যা আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। তবে দলটির কর্মী-সমর্থকদের সামাজিকভাবে পুনর্বাসন করতে হবে।
রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ইনসাইড আউটে অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন ফরহাদ মজহার। অনেকের মতে তিনি জুলাই গণ অভ্যুত্থানের নেপথ্যের অন্যতম নায়ক।
বাংলাদেশে নানা ধরনের ‘ফ্যাসিস্ট’ প্রবণতা বিদ্যমান থাকা এবং তা থেকে মুক্তির উপায় তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, “ফ্যাসিবাদীদের দুটো চরিত্র আছে। এটা তো একই মুদ্রার দুই পিঠ। একটা হল– তার সেকুলার চরিত্র, আরেকটা হচ্ছে তার ধর্মীয় জাতিবাদী চরিত্র। দুটোই জাতিবাদের দুটো পিঠ। ওটা হল সেকুলার জাতিবাদ। এটা হল ধর্মীয় জাতিবাদ।
“ফলে বাংলাদেশের জনগণের সামনে দুটো শত্রু। এই দুটো শত্রুর বিরুদ্ধে তাকে লড়াই করতে। আমরা ধর্মীয় জাতিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা শুরু করেছি। জনগণ এখন বুঝতেছে ধর্মীয় জাতিবাদ কী ভয়ংকর। এটার বিরুদ্ধে লড়াই হবে।”
জুলাই অভ্যুত্থানের নেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দাবির মুখে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম শনিবার রাতে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ সম্পর্কিত প্রজ্ঞাপন সোমবার জারি হবে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
একই সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দলটিকে জুলাই আন্দোলন দমনে ‘মানবতাবিরোধী’ অপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধনী আনার সিদ্ধান্তও হয়েছে।
‘ইনসাইড আউটের’ আলোচনায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, সমকালীন রাজনীতি, রাজনীতির প্রতিবন্ধকতা, ভারত ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধসহ নানা বিষয়ে নিজের বিশ্লেষণ তুলে ধরেন ফরহাদ মজহার।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউবে অনুষ্ঠানটি সম্প্রচার করা হয়।
ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কেন এবং কীভাবে লড়াই
ফরহাদ মজহার যে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলেছেন, সেটি কার বিরুদ্ধে, কীভাবে হবে সেটির ব্যাখ্যাও তিনি করেছেন।
এর আগে তিনি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ একাই শুধু ‘ফ্যাসিস্ট’ নয়, বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় ধর্মনিরপেক্ষ কিংবা ধর্মীয় নানান ‘ফ্যাসিস্ট’ প্রবণতা রয়েছে।
তারা কারা সেই ব্যাখায় ইনসাইড আউটে তিনি বলেন, “প্রথমত তিনটা ভাগ করবেন আপনি।
”আমাদের লড়তে হচ্ছে প্রথমত ফ্যাসিবাদ…এটা ইডিওলজি, এরপর হল ‘ফ্যাসিস্ট শক্তি’। এটা কিন্তু ইডিওলজি না, এটা অর্গানাইজড। ইডিওলজি যখন একটা অর্গানাইজড সামাজিক এবং রাজনৈতিক শক্তি আকারে হাজির থাকে, এটা হল একটা ফ্যাসিস্ট শক্তি। আর তিন নম্বর হল–‘ফ্যাসিস্ট সংবিধান’।”
‘সেক্যুলার ফ্যাসিবাদ যেটা বাঙালি জাতিবাদ এবং সমাজতন্ত্রের নামে তৈরি হয়েছিল’ সেটা এরই মধ্যে মোকাবেলা করা হয়ে গেছে বলে মনে করেন তিনি।
চিন্তক ফরহাদ মজহার বলেন, “সেকুলার ফ্যাসিবাদ আমরা মোকাবেলা করেছি। কিন্তু একই সঙ্গে আরেকটা– ধর্মীয় জাতিবাদ। ধর্মের নামে মনে করে যে, তার অবস্থানই সহীহ। আর সকলে তার শত্রু এবং তাদের বিরুদ্ধে তারা একটা সংগ্রাম করে। যে শক্তিটা মাজার ভাঙে ইসলামের নামে, যে শক্তিটা ইসলামের নামে মেয়েকে অপমান করে, যে ফ্যাসিবাদ এই ইসলামের নামে তার যে মহিমা, তার যে ফিলোসফিক্যাল শক্তি, সেটাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এটাকে একটা পরকালবাদী ধর্ম আকারে হাজির করে।”
সমাজের যেকোনো প্রকার ঐতিহাসিক অগ্রযাত্রাকে যে বাধা দেয় ক্রমাগত, এটা কি ফ্যাসিবাদ নয়– সেই প্রশ্নও রাখেন তিনি।
ধর্মীয় জাতিবাদেরও পতন হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের যদি পতন ঘটে থাকে তাহলে ধর্মীয় জাতিবাদেরও পতন ঘটবে। কারণ ধর্মীয় জাতিবাদের কোনো প্রকার স্থান বিশ্ব ইতিহাসে হবে না। আর বাংলাদেশে ইতিহাসে এটা কখনো হবে না। কিন্তু ইসলামের হবে। ইসলাম ভিন্ন জিনিস। ইসলামী যারা, যদি কেউ সত্যিকারের মোমিন বা মুসলমান হয়ে থাকে তার প্রথম শিক্ষা ইসলাম জাতিবাদ বিরোধী। ইসলাম কোনো প্রকার জাতিবাদকে প্রশ্রয় দেয় না।”
আর কাউকে নিষিদ্ধের দাবি উঠবে?
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারকে ঘিরে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে রূপ নেয়। ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনে জনরোষের মুখে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান; পতন ঘটে আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলের।
আন্দোলনের মধ্যেই আওয়ামী লীগকে ‘ফ্যাসিবাদ’ আখ্যা দিয়ে পদত্যাগের দাবি জোরালো হতে থাকে। সরকার পতনের পর আন্দোলন দমাতে শক্তিপ্রয়োগ ও ’গণহত্যার’ অভিযোগ তুলে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারাসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলো আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও দলের বিচারের দাবি আসছে।
আওয়ামী লীগের পাশাপাশি অন্যান্য ‘ফ্যাসিবাদের’ কথাও বলে আসছে ফরহাদ মজহার। সেক্ষেত্রে অন্য কোনো দলকেও নিষিদ্ধের দাবি আসবে কি না রোববার ‘ইনসাইড আউট’ অনুষ্ঠানের আলোচনায় এই প্রশ্ন ছিল তার কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, “সেটা নির্ভর করছে তাদের তৎপরতা দেখে। যেমন ধরেন, আজকে যে এক ধরনের ইসলামপন্থিকে দেখলাম, যারা শাপলা চত্বরটা বানাতে দেয়নি আমাদের ধর্মের নামে; যে মিনার তৈরি করাটা খারাপ। স্মৃতিটাকে তারা ধ্বংস করেছে। শেখ হাসিনা যেভাবে এই তরুণ মাদ্রাসা ছাত্রদের হত্যা করেছে, যে রক্তপাত ঘটিয়েছে, এটাকে ধামাচাপার দেওয়ার জন্য যারা শেখ হাসিনাকে কওমি জননী বলেছে এবং কওমি জননী বলার মধ্য দিয়ে যারা শাপলা চত্বরকে একটা ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ বানাতে যারা বাধা দিয়েছে, এরা তো স্বভাবতই বাংলাদেশের মুসলমানদের দুষমন।”
এক যুগ আগে ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ ডেকেছিল কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। শাহবাগের আন্দোলনের বিপরীতে ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে সেখানে তারা অবস্থান নিলে তাদের হঠাতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বল প্রয়োগ করলে সেখানে ব্যাপক সহিংসতা ঘটে।
তখনকার সেই প্রেক্ষাপটের কথা তুলে ধরে ধর্মীয় গোষ্ঠী শাপলা ছেড়ে শাহবাগ দখল করেছে বলে মন্তব্য করেন ফরহাদ মজহার। বলেন, “এরা এখন কী করছে? এরা এখন শাহবাগ দখল করতে আসছে। শাহবাগ তো তোমার জায়গা না। তোমার জায়গা ছিল শাপলা। যেখানে শাপলা ছিল সিম্বল। শাপলা ছিল আমাদের লড়াইয়ের জায়গা। শাপলা ছিল আমাদের স্মৃতিচিহ্ন। সে স্মৃতিচিহ্নকে তোমরা ধ্বংস করেছ। ধ্বংস করে এসে এখন তোমরা শাহবাগকে অপবিত্র করতে এসেছ।
”এটা তো চলবে না। এভাবে তো রাজনীতি চলবে না। এই হচ্ছে ফ্যাসিজমের চরিত্র। এই ফ্যাসিজমকে ধরিয়ে দেওয়াটা এটা আমাদের এখনকার কাজ।”
এই গোষ্ঠীর সমালোচনা করে তিনি বলেন, “যারা মাজার ভেঙেছে, যারা মাজার ভাঙে এবং যারা মেয়েদেরকে অপমান করে, মেয়েদেরকে কোনো প্রকার সম্মান দেয় না, মেয়েদেরকে তাদের দাসি-বাদী মনে করে। আপনি কি মনে করে বাংলাদেশের জনগণ গণঅভ্যুত্থানের পরে এদেরকে সহ্য করবে? অবশ্যই সহ্য করবে না।
”ফলে এইজন্য আমরা মনে করি যে, সকল প্রকার ফ্যাসিবাদ ফ্যাসিস্ট শক্তিকে আমাদের মোকাবেলা করতে হবে এবং মোকাবেলা করার মধ্য দিয়ে একটা নতুন বাংলাদেশ গঠন করবার রাজনীতি আমাদের করতে যাবে।”
‘ধর্মীয় জাতিবাদীরা আওয়ামী লীগেরই দোসর’
ফরহাদ মজহার মনে করেন, যারা ইসলাম ধর্মের হয়ে নারীর অগ্রযাত্রায় বাধা দেয়, মাজার ভাঙে, তারা আওয়ামী লীগেরই দোসর।
তিনি বলেন, “যারাই মুসলিম জাতিবাদের নামে, ইসলামী জাতিবাদের নামে, ধর্মীয় জাতিবাদের নামে রাজনীতি করতে চাইছে, তারা আওয়ামী লীগেরই দোসর। দেখবেন তারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা আনার জন্য নানা রকম তৎপরতা এখন বাংলাদেশে শুরু করেছে। ফলে এখনকার লড়াই একান্ত ধর্মীয় জাতিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং ইসলামের মহিমা কায়েম করার লড়াই।”
বাঙালি মানেই মুসলমান বাঙালিই বোঝায় বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার। বলেন, “বাঙালি মানে কিন্তু কলকাতার বাঙালি বোঝায় না। আমরা যুদ্ধ করে বাঙালি হয়েছি। ফলে বাঙালি বলতে সবসময় মুসলমান বাঙালিই বোঝায়।
”সেই দিক থেকে ইসলামের মহিমা যখন আমরা আত্মস্থ করব বাঙালি হিসেবে…আমরা তো আরব না, আমরা তো ইরানি না, আমরা তুরানি না, ফলে আমরা আরব হিসেবে নয়, বাংলাভাষী বাংলা সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক হিসেবে যখন বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতির মধ্যেও আমরা ইসলামের মহিমা কায়েম করব, এটাই হবে বাংলাদেশের জনগণের সামনে এগিয়ে যাবার আপনার অগ্রযাত্রা। এটা আমরা করব।”
‘রাজনৈতিক নয়, আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করতে হবে সামাজিকভাবে’
গণ অভ্যুত্থানে দেড় দশক ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দলটিকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে যুক্তি দিয়ে ফেইসবুকে লিখেছিলেন ফরহাদ মজহার। অনেকের মতে তিনি জুলাই আন্দোলনের অন্যতম ‘নেপথ্যের নায়ক’।
তার ভাষ্য ছিল, আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে নিষিদ্ধ করতে হবে, কিন্তু সামজিকভাবে পুনর্বাসনেরও দরকার আছে।
ওই লেখায় ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন সেটির ব্যাখ্যা করে ইনসাইড আউটের আলোচনায় তিনি বলেন, “প্রথমত, একটা গণঅভ্যুত্থান যখন ঘটে, তখন আমাদেরকে হিস্ট্রিকে নতুন করে পুনর্বিবেচনা করতে হয়। গণঅভ্যুত্থান মানে হল বিদ্যমান যে ইতিহাসের বয়ান, এটাকে প্রশ্ন করা। ফলে স্বভাবতই এই পর্যন্ত যে ইতিহাসটা লেখা হয়েছে, যেটা মূলত আওয়ামী লীগ লিখেছে। এই ইতিহাসের বয়ানটাকে প্রশ্ন করার জন্য এই নিষিদ্ধের প্রশ্নটা আসে।
“দ্বিতীয় হল যে আওয়ামী লীগ একটা ফ্যাসিস্ট সংগঠন। তার যে মতাদর্শের ভিত্তি এবং তার রাষ্ট্র পরিচালনার যে নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন করার যে ইতিহাস রয়েছে…ফলে এটা একান্তই একটা ফ্যাসিস্ট সংগঠন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হিটলারের দল যদি নিষিদ্ধ হতে পারে, মুসোলিনির দল যদি নিষিদ্ধ হতে পারে তাহলে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে না কেন? এটা হচ্ছে প্রথম ব্যাপার। কিন্তু আমার কথা কিন্তু এতটুকু থামার ছিল না।”
আওয়ামী লীগকে দল আকারে নিষিদ্ধ করা হলেও দলটির কর্মী, সমর্থকদের সামাজিকভাবে পুনর্বাসন করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন মজহার। তার যুক্তি– দলটি ‘ফ্যাসিস্ট’ হলেও সমর্থকরা তা নন।
“আমার যে জিনিসটা ছিল সেটা হল এই যে এর সঙ্গে (নিষিদ্ধ) আপনাকে এটা ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলেশন, নেলসন ম্যান্ডেলার যে চিন্তাটা ছিল… মানে আমাদের সমাজে যে ক্ষতগুলো তৈরি হয়েছে, কিছু ক্ষত ঐতিহাসিক। এতগুলো লোককে আপনি মারলেন, এতগুলো লোককে আপনি গুম করলেন, কোনো ন্যায়বিচার পায়নি জনগণ। এই যে সমাজে যে ক্ষতটা তৈরি হয়েছে…এই ক্ষতের ফলে বাংলাদেশে যারা আওয়ামী লীগের সমর্থক তারা তো আর ফ্যাসিস্ট না। দলটা ফ্যাসিস্ট। ফলে সে সমর্থকদের যে প্রত্যাশা ছিল সে মানুষগুলোকেও তো সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত করতে হবে।”
নিজের চিন্তার স্পষ্ট প্রকাশ করে ফরহাদ মহজার বলেন, “দল আকারে নিষিদ্ধ করতে হবে। কথাটা খুব পরিষ্কার। কিন্তু সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের প্রয়োজন আছে। এজন্যই আপনাকে এ দুটো কাজ একসঙ্গে করতে হবে। একটা হল যে নিষিদ্ধ করা এবং পাশাপাশি সামাজিকভাবে পুনর্বাসন। রাজনৈতিক পুনর্বাসন না। এটা খুব পরিষ্কার থাকতে হবে।”
তার ভাষ্য, “ফ্যাসিস্ট কোনো মতের বা কোনো মতাদর্শের রাজনৈতিক পুনর্বাসন চলবে না। কিন্তু সমাজে যারা আছেন, যে মানুষগুলো সমাজের অন্তর্গত তাদের সামাজিক পুনর্বাসন, সামাজিক পুনঃশিক্ষা নতুন করে ইতিহাস পাঠ, নতুন করে যে বয়ান, জনগণের যে বয়ান, এটা এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া ‘পোয়েটিক জাস্টিস’
স্বাধীনতার চুয়ান্ন বছর পর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়াটকে সঠিক সিদ্ধান্ত এবং যুগপৎ ‘পোয়েটিক জাস্টিস’ বলে মনে করেন চিন্তক ফরহাদ মজহার।
তিনি বলেন, “এটাকে আমি ট্র্যাজেডিক মনে করি না। এটাকে বলে পোয়েটিক জাস্টিস। পোয়েটিক জাস্টিসটা হল বাংলাদেশের জনগণ শেখ মুজিবকে মেনে নিয়েছে, তার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে। তিনি কী জন্য নেতা ছিলেন, তিনি প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন চেয়েছিলেন। সেজন্য তাকে সত্তরে নির্বাচিত করেছিল পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন করার জন্য। পাকিস্তানের সংবিধান মানে…সেখানে কী ছিল?
”এলএফওর অধীনে সে সংবিধান প্রণয়ন করার কথা ছিল একটা ইসলামী সংবিধান। একটা ইসলামী সংবিধান প্রণয়ন করবার জন্য বাংলাদেশের জনগণ বা তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাকে নির্বাচিত করেছিল।”
ফরহাদ মজহারের মতে বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ন করে শেখ মুজিবুর রহমান সেই চিন্তার সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছিলেন।
তিনি বলেন, “কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ যখন হল, শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম জনগণের সঙ্গে যে বিশ্বাসঘাতকতা করলেন, তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের যে ঘোষণা, স্বাধীনতার যে প্রক্লেমেশন, এটাকে তিনি অস্বীকার করলেন। সম্পূর্ণ। অস্বীকার করে তিনি এমন একটা সংবিধান আরোপ করলেন কাদের দ্বারা, যারা আসলে আইনগত দিক থেকে ছিলেন পাকিস্তানি। কারণ, তারা পাকিস্তানের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীন জনগণের দ্বারা নির্বাচিত কোনো দল তারা ছিলেন না।
“ফলে বাহাত্তর সালে তাদের সংবিধান চাপিয়ে দেবার, সংবিধান প্রণয়ন করার কোনো রাজনৈতিক এবং আইনগত অধিকার ছিল না। এই সংবিধানের কারণে আমরা একটা ফ্যাশিস্ট শাসন দেখলাম দীর্ঘ এতটা বছর। তারই শাস্তি। এটাকে এজন্য বলেছি এটা পোয়েটিক জাস্টিস। যে আজকে সে বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা একটা নিষিদ্ধ দল আকারে ঘোষিত হল। এবং অন্তর্বর্তী সরকার এটা করেছে। ফলে আমি মনে করেছি তারা সঠিক কাজটা করেছেন।”
নিষিদ্ধের ফল ‘ইতিবাচক হবে‘
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার যে প্রক্রিয়ায় সরকার হাঁটছে সেটি সঠিক এবং সরকার ঠিক পথেই হাঁটছে বলে মনে করেন ফরহাদ মজহার।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ফলাফল কী হবে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ইতিবাচক হবে নিঃসন্দেহে। প্রথম কথা হচ্ছে যে এটা হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণের যে ক্ষোভ, বাংলাদেশের ছাত্র-তরুণদের যে দাবি, সেই দাবির প্রতিফলন। এবং সরকার শুধু এইটা দাবি করে কিন্তু থেমে থাকেনি। তারা যে ভুলটা শুরুতে করেছে সে ভুলটা হল– এই জুলাই ঘোষণা যে তারা দেননি, এখন তারা বলছেন যে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে তারা নতুন ঘোষণা দেবে। যেই ঘোষণাই আসুক, একটা ঘোষণা দেবেন।”
জুলাই বিপ্লবের ঘোষণা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে হওয়া উচিত নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এটা একান্তই ছাত্রদের। যারা গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছেন, এটা তাদের ঘোষণা হবে। যেটা আমি মনে করি, ড. ইউনুসের এই নীতিটা ভুল নীতি। তার প্রথম বুদ্ধি ছিল– ছাত্ররা তাদের ঘোষণা দেবে। সমাজে জনগণ রয়েছে। জনগণ যদি মনে করে যে ছাত্রদের ঘোষণা গ্রহণযোগ্য, তারা গ্রহণ করবে। যদি গ্রহণযোগ্য মনে না করে…জনগণকে বিচার করতে দিন।
”এখানে রাজনৈতিক দলের তো কোনো প্রশ্ন আসছে না। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো দল হিসেবে তো গণঅভ্যুত্থান করেনি। গণঅভ্যুত্থান করেছে জনগণ।”
অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব জনগণকে দিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, “কর্তা-সত্ত্বা হল জনগণ। ফলে জনগণের পক্ষে ছাত্র-তরুণরা ঘোষণা দেবে। এটা হচ্ছে নীতি। এটাকে প্রতিহত করা হয়েছে। সেদিক থেকে আমি মনে করি যে, আওয়ামী লীগকে যে নিষিদ্ধকরণ সন্ত্রাস আইনে এবং তার বিচার সম্পন্ন হওয়ার আগে পর্যন্ত, এটা সঠিক। এবং তার সঙ্গে তারা যেটা বলেছেন যে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণা দিতে হবে। এটা আরও ভালো এবং দেখা যাচ্ছে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছে।
“তার সঙ্গে এখন যদি তারা যুক্ত করেন এই নেলসন ম্যান্ডেলার ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলেশন জাস্টিস কমিশনের আদলে এখানেও একটা রিকনসিলেশন কনস্ট্রাকশনের একটা পদ্ধতি, একটা প্রক্রিয়া তারা শুরু করে, তাহলে স্বভাবতই তারা সঠিক পথে আছে।”
রাজনৈতিক দলের কাছে ইউনূসের ‘নতজানু’ হওয়ার যুক্তি নেই: ফরহাদ মজহার
পশ্চিমা প্রযুক্তির হার এড়াতে যুদ্ধ থামান ট্রাম্প: ফরহাদ মজহার
নারী সংস্কার কমিশন খারাপ কী বলেছে, ধর্ম সংস্কার তো করতে বলেনি: ফরহাদ মজহার
ট্রুথ অ্যান্ড রেকনসিলিয়েশন কমিশন কেন জরুরি? ব্যাখ্যা দিলেন ফরহাদ