Published : 02 Dec 2023, 09:09 PM
কানাডার টরন্টোতে ‘রয়্যাল অন্টারিও মিউজিয়াম’ (আরওএম) বিশ্বের কয়েকটি সমৃদ্ধ জাদুঘরের একটি। উত্তর আমেরিকা তথা কানাডার সবচেয়ে বড় এ জাদুঘর ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতি বছর প্রায় ১৫ লাখ দর্শনার্থী এই জাদুঘর দেখতে আসে।
এতে তুলে ধরা হয়েছে শিল্প, বিশ্ব-সংস্কৃতি এবং প্রকৃতির ইতিহাস। এখানেই চলছে ‘বিয়িং অ্যান্ড বিলংগিং’ শিরোনামে শিল্প প্রদর্শনী। এবছর পহেলা জুলাই শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী চলবে ৭ জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত। সমকালীন মুসলিম বিশ্বের ২৫ নারী শিল্পীর শিল্পকর্ম নিয়ে এই প্রদর্শনী।
এতে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের শিল্পী তৈয়বা বেগম লিপির তিনটি শিল্পকর্ম। স্টেইনলেস স্টিল ব্লেডের তৈরি এক জোড়া হাই হিল জুতো, শিল্পী তার এই শিল্পকর্মের নাম দিয়েছেন ‘নট ফর মি’। একই মাধ্যমের ছবি ‘ফ্রক’, মেয়েদের জনপ্রিয় পোশাক এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের জীবনযন্ত্রণা নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র।
কানাডার জাতীয় সংসদ ২০০৭ সালে অক্টোবর মাসকে ‘কানাডিয়ান ইসলামিক হিস্ট্রি মান্থ’ হিসেবে ঘোষণা করে। ঘোষণার পর থেকে কবিতা, চলচ্চিত্র ও শিল্পকলার মাধ্যমে কানাডার সামাজিক উন্নয়নে মুসলিম জনগোষ্ঠীর অবদানকে তুলে ধরা হয়। তাছাড়া কানাডা সরকার ১৯৯২ সালে থেকে অক্টোবর মাসকে উইমেন’স হিস্ট্রি মান্থ হিসেবে পালন করে আসছে। অক্টোবর মাসের এই দুই ইভেন্টকে স্মরণীয় করে রাখতে রয়্যাল অন্টারিও মিউজিয়ামের এ উদ্যোগ।
এ প্রসঙ্গে কানাডার ‘গ্লোব অ্যান্ড মেইল’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে জাদুঘরের কিউরেটর ফাহমিদা সোলাইমান বলেন, “বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার দ্বন্দ্ব কিংবা আন্দোলন সংগ্রামের ফলে ব্যক্তি বা ভৌগলিক অবস্থানের উপর যে প্রভাব, যার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল শরণার্থীর মতো যুগযন্ত্রণা। মূলত এসবই তুলে ধরা হয়েছে এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে।”
গতানুগতিক শিল্প ভাবনার বাইরে গিয়ে লিপি দীর্ঘদিন থেকে স্টেইনলেস স্টিল ব্লেড দিয়ে শিল্প তৈরি করে যাচ্ছেন। এটি তার সিগনেচার আইটেমে পরিণত হয়েছে। ‘নট ফর মি’ শিরোনামে স্টেইনলেস স্টিল ব্লেডের অনেকগুলো কাজ আছে। একই মাধ্যমে তৈরি ‘লাভ বেড’ শিরোনামের একটি শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন এলাকার সলোমন আর. গগেনহেইম মিউজিয়ামে। এই শিল্পকর্মটির উপর একটি ক্রিটিক ভিডিও স্থান পেয়েছে কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ভিক্টোরিয়ার ডিন’স লেকচার সিরিজের অংশ হিসেবে। আলোচনা করেছেন ইউনিভার্সিটির আর্টস, হিস্ট্রি অ্যান্ড ভিজ্যুয়াল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মেলিনা বেলি বোস।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উদযাপনের অংশ হিসেবে কানাডার মিসিসাগায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের শিল্পকর্মের একটি প্রদর্শনী। দেশের প্রতিনিধিত্বশীল অনেক চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছিল এ প্রদর্শনীতে। সেখানেই দেখেছিলাম লিপির ‘নট ফর মি’ শিরোনামের হাই হিল জুতোর এ শিল্পকর্মটি। রয়্যাল অন্টারিও মিউজিয়াম এই শিল্পকর্মটি প্রদর্শনের জন্য কিনে নিয়েছে।
লিপির আমন্ত্রণে আমরা গিয়েছিলাম ‘বিয়িং অ্যান্ড বিলংগিং’ শিরোনামের সেই শিল্পপ্রদর্শনী দেখতে। ডাউনটাউন টরন্টোতে ফ্রি পার্কিং নেই বললেই চলে। অগত্যা কাছের প্রাইভেট পে পার্কিং-এ গাড়ি পার্ক করে ব্লোর রোড ধরে হেঁটে যাচ্ছি। মধ্য নভেম্বরে বাইরের তাপমাত্রা শূন্যের কয়েক ডিগ্রি উপরে। না, খুব বেশিদূর হাঁটতে হয়নি। শ’খানেক গজ হাঁটার পরই চোখে পড়লো রয়্যাল অন্টারিও মিউজিয়ামের (আরওএম) জিওমেট্রিক ভবন।
আরওএমের সামনে এসে মনটা ভালো হয়ে গেল। প্রদর্শনীর প্রচারণার জন্য যে বিশাল আকৃতির ফেস্টুন, সেখানে স্থান পেয়েছে লিপির শিল্পকর্ম। আরওএম কর্তৃপক্ষ লিপির সেই শিল্পকর্মের উপর প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে লিখেছে ‘পাওয়ার অর পেইন?’। এখানে স্টিলের ব্লেডের শার্পনেসকে হয়তো ‘পাওয়ার’ আর এই শার্পনেসের কারণে সুন্দর হাই হিল পরতে না পারার বেদনাকে তুলে ধরা হয়েছে। অবশ্য শিল্পীর ভাবনা ভিন্ন হতে পারে। এর আগেও দেখেছি আরওএম এই প্রদর্শনীর প্রচারণার জন্য তাদের ওয়েবসাইট এবং টরন্টো ট্রানজিট কমিশনের (টিটিসি) বাসের দেয়ালে লিপির এ শিল্পকর্মটি ব্যবহার করেছিল।
লিপির সঙ্গে লবিতেই দেখা হলো। সে অপেক্ষা করছিল আমাদেরকে গ্যালারিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। টিকিট কাউন্টারের উপরের বিলবোর্ডে দেখলাম লিপির শিল্পকর্ম ভেসে আসছে। ক্যাফেটেরিয়া লবির আনাচে কানাচে সর্বত্র হাই হিল জুতো স্থান পেয়েছে। পুরো লবি লিপিময় দেখে বাংলাদেশের জন্য গর্বে বুক ভরে ওঠলো। উপরে উঠে তৃতীয় তলায় দেখলাম লিপির শিল্পকর্মের উপর ভিড় লেগেই আছে। লিপির অনুরোধে আরওএম কর্তৃপক্ষ আমাদের জন্য একজন গাইডের ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রাঞ্জল ভাষায় তিনি সবকিছু বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন।
পরদিন ২৬ নভেম্বর ছিলো তৈয়বা বেগম লিপির সঙ্গে ‘ক্যাফে আড্ডা’! শিল্পরসিকরা শিল্পীর সঙ্গে প্রশ্নোত্তরের ভিত্তিতে মতবিনিময় করবেন। এই অনুষ্ঠান ছিল সীমিত, ২৬ ডলারের টিকিটের বিনিময়ে শিল্পীর সঙ্গে মতবিনিময়ের সুযোগ। দুই সপ্তাহ আগেই সব টিকিট বিক্রি হয়ে যায়। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনায় ছিলেন আরওএমের কিউরেটর ফাহমিদা সোলাইমান।
লিপির জন্ম গাইবান্ধায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে মাস্টার্স পাশ করার পর লেগে থাকেন শিল্পকলার সঙ্গে। জীবনের প্রথম সাফল্য পান ২০০৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে। এ উৎসবে লিপির চিত্রকর্ম গ্র্যান্ড পুরস্কার জিতে নেয়। তারপর আর থেমে থাকেননি লিপি। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে আসে আরও অনেক স্বীকৃতি।
শিল্পচর্চাকে সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার জন্য ২০০২ সালে জীবনসঙ্গী মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে লিপি গড়ে তোলেন ‘বৃত্ত আর্ট ফাউন্ডেশন’। ‘ডকুমেন্টা ফিফটিন’ শিরোনামে একটি সমকালীন আর্ট এক্সিবিশন হয়েছিল জার্মানির ক্যাসেলে। শুরু হয়েছিল ২০২২ সালের ১৮ জুন এবং শেষ হয়েছিল একই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর। এতে বৃত্ত আর্ট ফাউন্ডেশন তার দল নিয়ে অংশ নেয়।