Published : 11 Mar 2022, 03:24 PM
তবু আমাকে যেতে হবে। কে যেন ডাকে। কে যেন ইশারা দেয়। অনুভব হয় যেন নতুন বৌ ফুলশয্যা রচনা করে আমাকে ডাকছে। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ মৃদু হাওয়ায় ফুটপাত ধরে হাঁটছি। অনুভব করছি পা দুটো কোনো এক জাদুমন্ত্রবলে সমুদ্রতীরের দিকে যাচ্ছে।
অগত্যা শরীর-মনও সাথি হলো একই গন্তব্যে। সারি ধরে লাগানো নারকেল বীথির ফাঁকে ফাঁকে মোটা ফারাই করা কাঠের বসার আসন। সামুদ্রিক হাওয়ায় ভেসে আসা সাদা বালুর হালকা আস্তরণ। একটু ফুঁ দিলেই সব বিলকুল সাফ। একসারি মালয়ি জোব্বাজাব্বি পরা রমণী গাঢ় সান্ধ্য আঁধারিতে বালুকাবেলা ঝাট দিচ্ছে। কী যে পণ এদের! সারা সৈকতে একটা শুকনো পাতা কুড়িয়ে পেতেও রাজ্যের হয়রানি পোহাতে হয়।
মহাসমুদ্দুরের উপর দিয়ে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে আসা পেলব নরম হাওয়াগুলো এমনভাবে গায়ে এসে গলে গলে পড়ছে যেন দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর দয়িতের সঙ্গে নির্জনে প্রথম দেখা। এ আহ্বান, এ নিবেদন অনর্থক উপেক্ষা করা ধর্মত অসংগত হবে বিধায় দীর্ঘক্ষণ চুপচাপ থেকে বায়ু-প্রণয়ীদের প্রণয়াবেগ রাধিকা বিরহে সর্বঅঙ্গ জর্জরিত কৃষ্ণের মতো সর্বআলিঙ্গনে মৌন সম্মতি দিয়ে গেলাম। মৌনং সম্মতি লক্ষণং।
গতকালের মতো আজও একটা চাঁদ হঠাৎ করেই সমুদ্দুর ফুঁড়ে উঠে এলো। আজ একটু বেশি ঝলমলে, হয়তো রিফুয়েলিং করে এসেছে। ওর স্নিগ্ধ আলোতে সমুদ্দুরের বাবু-ঢেউগুলো শুভ্র বালুকাবেলার বুকে ছলাৎ ছলাৎ নৃত্যরত। বাবু-ঢেউ এজন্য যে সৈকতকে মূল ঢেউয়ের আঘাত থেকে রক্ষার জন্য তীরের অদূরে বড় বড় পাথর দিয়ে মাঝে মাঝে ফাঁকা রেখে কৃত্রিম বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। সমুদ্রের মাঝ থেকে তেড়ে আসা বড় ঢেউগুলোর হিংস্রতা কঠিন পাষাণের বাধায় কিছুটা পোষ মানলেও বাঁধের ফাঁকফোকর দিয়ে নিরীহ বাবু-ঢেউগুলোকে তীরের দিকে লেলিয়ে দিয়ে অক্ষমের ইজ্জত রক্ষার চেষ্টা আরকি!
ওদের ওসব ঠেলাঠেলির ঝামেলায় না জড়িয়ে আমি সন্তর্পণে জোছনালোকিত ফেনিল স্ফটিক-জলধারায় নেমে পড়ি। ঈষদুষ্ণ স্বচ্ছ জলধারা পদযুগল স্পর্শ করে যেন সমস্ত দেহের কোষে কোষে মোলায়েম বিদ্যুৎ শিহরণ ছড়িয়ে দেয়। নানা আকারের, নানা রংয়ের মীন-সকল অবাধে ঘুরঘুর করছে চারপাশে, যেন বিশাল প্রাকৃতিক অ্যাকুরিয়ামের অভয়ারণ্যে বসবাস।
কিছুক্ষণ জল-তটে বিহার করে আবার এসে ওই একই আসনটাতে বসে পড়ি। সমগ্র অস্তিত্ব থেকে ইচ্ছে হয় এ অপার্থিব পরিবেশে, নিয়ত প্রবহমান এই সময়টাকে ধারন করে অনন্তকাল এখানেই বসে থাকি। মনে হয় এখানে ক্ষুধা, জরা, জীবনের অশুদ্ধতা কোন কিছুই ছুঁতে পারবে না। জান্নাতের নহর, কুসুম-বাগিচা, হুর-গিলমান বা স্বর্গালয়ের তিলোত্তমা, উর্বশী, নন্দন-কানন, পারিজাতের আকর্ষণ হয়তো অনেক বেশি। কিন্তু মর্তলোকের এই ক্ষণের, এই সময়ের, মনের এই অনুভূতিগুলো স্বর্গে যেতে সহমরণে রাজি হবে কিনা সেটা যে এক অমীমাংসিত ফয়সালা।
অনেকক্ষণ থেকেই দেখছি, পোশাক বৈশিষ্ট্যে অ-মালদিভিয়ান, সম্ভবত শ্রীলঙ্কান হবে, এক তরুণী এক বেঞ্চি দূরে তার ল্যাপটপখানায় বোতাম টিপে টিপে একাগ্রমনে যেন ধ্যান করে যাচ্ছে। চারদিকে জনমানবহীন সুনশান নিরবতা, অস্পষ্ট চন্দ্রালোকে সান্ধ্য আলো-আধাঁরীর গভীর রহস্যময়তা কোন কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করে নেই। নিজের মনন-জগৎ বা কর্ম-জগৎ যেন তার সমগ্র অস্তিত্বকে বাকি দুনিয়া থেকে একেবারেই আড়াল করে রেখেছে। বিস্ময় নিয়ে লক্ষ্য করি পুরনো এই পৃথিবীর নতুন প্রজন্ম তাদের ভুবনে যেন একটা নতুন মহাজগৎ তৈরি করে চলছে।
এই সৃষ্টি, এই বর্তমান জগৎ তাদের মনোজগতে নিত্য নতুন পরিবর্তিত হয়ে খাপ খাইয়ে নিতে প্রাণান্তকর অবস্থা। কিছু সময়ের বিবর্তনে এই পরিবর্তন ক্রমে অস্পষ্ট থেকে স্পষ্ট হয়ে আবার পুরনো হয়ে যাবে। মহান সৃষ্টিকর্তা বিশ্বসংসারের সব সৃষ্টি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই তৈরি করেন। মনের মধ্যে সেই চির অসামান্য দর্শন, অমোঘ বাণী সামনে এসে দাঁড়ায়-
“আমি সৃষ্টি করেছি আসমান ও জমিন এবং উভয়ের মধ্যস্থিত যাবতীয় বস্তু যথাযথভাবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য…।” (সূরা আল-আহকাফ, আয়াত ৩)
অথবা-
“আমি অক্ষম নই যে, তোমাদের পরিবর্তে তোমাদের মতো অন্যদের নিয়ে আসি এবং তোমাদের এমন আকৃতিতে বানিয়ে দিই, যা তোমরা জানো না।” (সূরা ওয়াকিয়াহ, আয়াত ৬০, ৬১)
ভেবে সারা হই এ মহা-দর্শন বাণীর মধ্যে কী গভীর গোপন বার্তা-রহস্য সুপ্ত হয়ে মহাসময়ের গর্ভে লুকিয়ে আছে!
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |