Published : 25 Jan 2025, 09:26 PM
ইতালি নিয়ে যাওয়ার কথা বলে লিবিয়ায় তিন বছর আটক রেখে দফায় দফায় মুক্তিপণ আদায়ের পরও নির্যাতনে মাদারীপুরের এক যুবকের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে।
বুধবার রাতে তার মৃত্যুর খবর আসার পর থেকে পরিবারে চলছে শোকের মাতম।
নিহত রাকিব মহাজন (২৩) মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের পখিরা গ্রামের নাজিম উদ্দিন মহাজনের ছেলে।
দীর্ঘ তিন বছর লিবিয়ায় ‘গেইমঘরে’ বন্দি অবস্থায় দালালদের নির্যাতনে ছেলে মারা যান বলে রাকিবের পরিবারের অভিযোগ।
রাকিবের বাবা নাজিম উদ্দিন মহাজন ছেলে মৃত্যুর শোকে একেবারে ভেঙে পড়েছেন।
আহাজারি করতে করতে তিনি বলছিলেন, “দফায় দফায় টাকা দিয়ে আমি সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। এ পর্যন্ত দুজনকে সব মিলিয়ে ৪৫ লাখ টাকা দিয়েছি। তারপরও আমার ছেলের মৃত্যুর খবর শুনতে হল! আমার ছেলেকে না খাইয়ে ও নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে দালালরা।”
তার অভিযোগ, “কয়েকদিন আগেও আমার ছেলে ভিডিওতে তাকে নির্যাতনের কথা বলেছে। এত টাকা দালালদের দিয়েও ছেলেকে বাঁচাতে পারলাম না।”
এখন ছেলের লাশও দেখতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সংশয়ে আছেন।
লাশ দেশে আনা ও এ ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবি জানান নাজিম উদ্দিন।
নিহতের চাচা শাহজালাল মহাজনের অভিযোগ, “নির্যাতন করে আমার ভাতিজাকে হত্যা করেছে। এখন দালালরা বলছে, অসুস্থ হয়ে রাকিব মারা গেছে। আমরা এ হত্যার বিচার চাই।”
স্থানীয়দের দাবি, উন্নত জীবনের আশায় মাদারীপুর সদর উপজেলার জাহাঙ্গীর মৃধার প্রলোভনে পড়েন রাকিব মহাজন।
নিহতের পরিবারের সদস্যরা বলেন, জাহাঙ্গীর তার ভায়রা শরীয়তপুরের পালং থানার ধানুকা ইউনিয়নের ছোট বিনোদপুর গ্রামের সোহাগ মাতুব্বরের মাধ্যমে ২৭ লাখ টাকায় রাকিবকে ইতালিতে পৌঁছে দেওয়ার চুক্তি করেন।
পরে ওই টাকা দিয়ে তিন বছর আগে ইতালির উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন রাকিব মহাজন।
নাজিমের অভিযোগ, লিবিয়ায় যাওয়ার পর তার ছেলেকে গেইমঘরে (বন্দিশালা) রেখে আরও টাকার জন্য নির্যাতন চালাতে থাকেন সোহাগ মাতুব্বর ও তার লোকজন।
পরে ছেলের ‘মুক্তিপণ হিসেবে’ ধার-দেনা করে ‘দালালদের’ আরো পাঁচ লাখ টাকা দেন নাজিম।
তারপরও ছেলের ওপর নির্যাতন চলতে থাকলে এক পর্যায়ে মাদারীপুর সদর উপজেলার ঝাউদি ইউনিয়নের ব্রামন্দী গ্রামের মাজেদ খলিফা নামে ‘বিদেশে লোক পাঠানোয় জড়িত’ এক ব্যক্তির দ্বারস্থ হয় রাকিবের পরিবার।
সবশেষ মাজেদকে ১৫ লাখ টাকা দেওয়া হলেও মুক্তি মেলেনি রাকিবের।
অসুস্থ অবস্থায় মঙ্গলবার লিবিয়ার একটি হাসপাতালে রাকিব মহাজন মারা যান বলে বুধবার রাতে তার পরিবারকে জানান মাজেদ খলিফা।
অভিযোগের বিষয়ে স্থানীয় জাহাঙ্গীর মৃধা বলেন, “সোহাগ আমার ভায়রা হওয়ায় আমাকে জড়ানো হচ্ছে। কেউ বলতে পারবে না যে, আমি তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি। ওই ছেলে অসুস্থ হয়ে লিবিয়ায় মারা গেছে। আমার ভায়রা বরং সেখানে তার চিকিৎসা করেছে। এর বেশি কিছু জানি না।”
তবে মাজেদ খলিফার বাড়ি গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। বক্তব্য জানার চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল নম্বরও বন্ধ পাওয়া গেছে।
মাদারীপুর সদর থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “ঘটনার কথা মৌখিকভাবে জেনেছি। লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
মাদারীপুর জেলা পুলিশের তথ্য মতে, গেল বছর লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার পথে জেলার অন্তত শতাধিক মানুষ ‘দালাল চক্রের’ নির্যাতনসহ বিভিন্নভাবে নিহত হন। এসব ঘটনায় পাঁচ শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রায় ২০০ মামলা হয়েছে।
তবে অভিযোগ আছে, গ্রেপ্তারের পর জামিন পেয়ে পুনরায় একই কাজে যুক্ত হন আসামিরা।
এদিকে, অবৈধভাবে মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানোর কথা বলছেন মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মো. সাইফুজ্জামান।
তিনি বলেন, “মাদারীপুরে দালাল চক্রের বিরুদ্ধে বেশকিছু তথ্য পেয়েছি। শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে লিবিয়া হয়ে ইতালিতে মানবপাচার করছে প্রতারক চক্র। তদন্ত করে এদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা জেলা পুলিশ এসব বিষয়ে জিরো টলারেন্সে আছি।”