Published : 24 May 2025, 11:28 AM
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় কয়লা পোড়ানোর শর্তে পরিবেশবান্ধব সনদ পেলেও অধিকাংশ ইটভাটায় কাঠ পোড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। এমনকি রীতিমত করাতকল বসিয়ে কাঠ চেরাই করা হচ্ছে এসব ভাটায়।
ইটভাটায় এভাবে কাঠ পোড়ানোয় যেমন উজার হচ্ছে বৃক্ষ, তেমনি পরিবেশ ও কৃষির মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। মানুষের শরীরেও বাসা বাঁধছে রোগ।
তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব ভাটার বিরুদ্ধে তারা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছেন। তাতেও বন্ধ হচ্ছে না অবৈধ কার্যক্রম।
এমন চিত্র গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার পাইককান্দি, সুকতাইল, জালালাবাদ ও চন্দ্রদীঘলিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের। এসব গ্রামে মেসার্স এসআরআরবি ব্রিকস, মেসার্স লাল পরি ব্রিকস, মেসার্স স্টার ব্রিকস, মেসার্স হাসেম ব্রিকস, এসবিআই ব্রিকসসহ মোট ৩৯টি ইটভাটা রয়েছে।
যার ৩৮টিই পরিবেশবান্ধব ভাটা। একটিমাত্র ড্রাম চিমনি ভাটা রয়েছে। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ এসব ভাটার মধ্যে ৩৫টিতেই পোড়ানো হচ্ছে কাঠ।
পুখুরিয়া গ্রামের এসবিআই ইটভাটা কার্যালয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. সিরাজ মোল্লার সঙ্গে।
এই ভাটা মালিক বলেন, “আমরা বিধি মোতাবেক কয়লা কিনে ইট পোড়াচ্ছি। প্রতিমণ কয়লা কিনতে হয় ১৮ হাজার ২০০ থেকে ১৮ হাজার ৭০০ টাকা দরে। আমরা প্রতি হাজার ইট বিক্রি করছি আট হাজার ৫০০ টাকা দরে।
“অন্যদিকে যারা কাঠ দিয়ে ইট পোড়াচ্ছে, তাদের খরচ অনেক কম হচ্ছে। কিন্তু তারাও আমাদের দামে ইট বিক্রি করেছেন। এতে আমরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না।”
তাই অবিলম্বে ভাটায় কাঠের ব্যবহার বন্ধে প্রশাসনের আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করেন এই ভাটা মালিক।
সরজমিনে পাইককান্দি ইউনিয়নের পুখুরিয়া গ্রামের স্টার ইটভাটায় গিয়ে দেখা গেছে, ভাটার এক কোণে অবৈধভাবে স্থাপন করা করাতকলে কাঠ চেরাই করতে ব্যস্ত রয়েছেন শ্রমিকরা। করাতকল থেকে সেই কাঠ ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভাটার ক্লিমে।
সেখানে শ্রমিকরা পোড়ানোর জন্য কাঁচা ইট সাজাচ্ছেন। আর ইটের ফাঁকে ফাঁকে সাজিয়ে দিচ্ছেন কাঠ।
ভাটার শ্রমিক মো. রাজু বলেন, “আমরা ভাটার ক্লিম (যেখানে ইট পোড়ানো হয়) সেখানে কাঁচা ইট সাজাই। ইটের ফাঁকে ফাঁকে কাঠ সাজিয়ে দেই। এই কাঠ দিয়েই ভাটায় আগুন দেওয়া হয়।”
এই ভাটায় ড্রাম চিমনি দিয়ে ইট পোড়ানো হয় বলেও তিনি জানান। তবে এটি বৈধ না অবৈধ তা তিনি জানেন না বলে মন্তব্য করেন।
এ ভাটার আরেক কর্মী রিজু মোল্লা বলেন, “শুধু আমাদের ভাটায় নয়, এলাকার অধিকাংশ ভাটায় করাতকল রয়েছে। এসব করাতকলে কাঠ আনা হয়। সেই কাঠ চেরাই করে ইটভাটায় পোড়ানো হচ্ছে।”
এ ছাড়া ভাটাটির অবৈধ ড্রাম চিমনী দিয়ে অনর্গল কালো ধোঁয়া বের হতেও দেখা গেছে। এতে এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
কিন্তু চেষ্টা করেও এই ভাটার মালিকপক্ষের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
গোপালগঞ্জের মধ্যে এই পুখুরিয়া গ্রামেই ইটভাটার সংখ্যা সবেচেয়ে বেশি। এখানে অন্তত ২৬টি ভাটা রয়েছে। একটি ভাটার গায়ে আরেকটি ভাটার অবস্থান। তাই গ্রামটি ‘ইটভাটার গ্রাম’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
এই গ্রামের কৃষক জমির আলী শেখ বলেন, “জেলার মধ্যে আমাদের গ্রামে ইটভাটা সবচেয়ে বেশি। স্টার ভাটা বাদে সবগুলোই পরিবেশেবান্ধব। কিন্তু অধিকাংশ ভাটায় কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। এতে আমাদের শরীর ও ফসলের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। তাই অবাধে ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো বন্ধ করার দাবি জানাচ্ছি।”
স্টার ইটভাটার শ্রমিক মো. হাসান বলেন, “এখানে কাজ করে হাঁচি, কাশি, শ্বাসকষ্ট ও বুকের বিভিন্ন সমস্য দেখা দিয়েছে। তারপরও বাধ্য হয়ে পেটের দায়ে সংসার চালাতে এখানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করি।”
একটি ইটভাটার মালিক বলেন, “কয়লার দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পক্ষান্তরে কাঠের দাম অনেক কম। তাই অতিরিক্ত মুনাফার জন্য কিছু অসাধু ইটভাটা মালিক জিগজ্যাগ ভাটাকে পরিবর্তন করে দেদারসে কয়লার পরিবর্তে কাঠ পোড়াচ্ছে।”
গোপালগঞ্জের সিভিল সার্জন আবু সাইদ মো. ফারুক বলেন, “ইটভাটায় কাঠ পোড়লে তার ধোঁয়ায় মানুষের শরীরে অ্যালার্জি, বক্ষব্যাধিসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। বিশেষ করে শিশু-বৃদ্ধদের বেশি ক্ষতি হয়। এ ছাড়া দেশের বনজ সম্পদ উজাড় হয়, বায়ুমণ্ডলে উষ্ণতা বাড়ে।”
কাঠের পরিবর্তে কয়লা ব্যবহৃত হলে দেশীয় বনজ সম্পদ রক্ষা পায় তাই ইটভাটায় কয়লা ব্যবহার নিশ্চিত করার আহ্বান জানান এই চিকিৎসক।
পরিবেশ অধিদপ্তরের গোপালগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মাহফুজুর রহমান বলেন, “২০২৪-২৫ অর্থবছরে পরিবেশ রক্ষায় আমরা তিন দফায় অবৈধ ১১টি ইটভাটায় অভিযান পরিচালনা করেছি। ছয়টি ভাটা উচ্ছেদ করেছি।
“এ ছাড়া ভাটাগুলোকে ১৮ লাখ টাকা জরিমানা করে আদায় করা হয়েছে। একটি ভাটার মালিককে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডও দিয়েছিলেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক।”
ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো বন্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, “পরিবেশ, মানুষের স্বাস্থ্য ও কৃষির ক্ষতিসাধন করে এমন ইটভাটা চলতে দেওয়া হবে না। পর্যায়ক্রমে এসব ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়া হবে।”