Published : 08 Jun 2025, 05:37 PM
শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলা সীমান্ত সংলগ্ন ঘরবাড়িতে প্রায় প্রতি রাতেই বন্যহাতির দল তাণ্ডব চালাচ্ছে। এতে নির্ঘুম রাত কাটছেন বাসিন্দাদের। এর মধ্যে অনেকেই বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
বোরো ধান কাটা শেষ হওয়ার পর থেকে বন্যহাতির পাল খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে নেমে আসায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাসিন্দারা। আর এতে প্রাণহানির মত ঘটনাও ঘটছে। বন্যহাতির লাগাতার আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়েছে মানুষ।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ বন বিভাগের মধুটিলা ফরেস্ট রেঞ্জ কর্মকর্তা দেওয়ান আলী বলেন, বন্যহাতির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তদের সরকার নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। সেইসঙ্গে হাতি ও মানুষ উভয়কে রক্ষা করতে বন বিভাগের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।
সবশেষ ৩০ মে সীমান্তবর্তী পোড়াগাঁও ইউনিয়নের বাতকুচি টিলাপাড়া গ্রামে খাবারের সন্ধানে একদল বন্যহাতি রাতভর তাণ্ডব চালায়। বৃষ্টির মধ্যে ৪০ থেকে ৫০টি বন্যহাতি ঘরবাড়ি লন্ডভন্ড করে ঘরে মজুত রাখা ধান-চাল খেয়ে সাবাড় করে।
সেইসঙ্গে গাছের কাঁঠাল ও বাড়ির আঙিনায় রোপণ করা কলা গাছ খেয়ে ফেলে। এমনকি ঘরে থাকা আসবাবপত্র তছনছ করেছে বন্যহাতির দল। রাতভর বাতকুচি গ্রামে ৮ থেকে ১০টি পরিবারের বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাতকুচি টিলাপাড়া গ্রামের ভুক্তভোগী আব্দুল মজিদ ও রুস্তম আলীসহ কয়েকজন জানান, কয়েকদিন আগে বোরো ধান কাটা শেষ হয়েছে। বন্যহাতিগুলো এখন আর মাঠে ধান খেতে পাচ্ছে না। তাই এখন তারা প্রতি রাতেই ঘর বাড়িতে হামলা করছে। সেইসঙ্গে ঘরের মজুত রাখা ধান-চাল খেয়ে সাবাড় করছে।
বর্তমানে বৃষ্টি থাকার কারণে রাতে গ্রামবাসী বন্যহাতি তাড়াতে ঘর থেকে বের হতেও পারছেন না। তারপরও যারা সাহস নিয়ে বন্যহাতি তাড়াতে যাচ্ছেন, তাদের কেউ কেই হাতির আক্রমণে প্রাণ হারাচ্ছেন।
এর আগে ২৯ মে রাতে বাতকুচি গ্রামের এক বৃদ্ধা বন্যহাতি আক্রমণে মারা যান। ঘটনার সময় হাতির দল ঘুমন্ত সুরতন নেছাকে (৬৫) ঘর থেকে টেনে বের করে বাড়ির আঙিনায় ফেলে শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে ও পায়ে পিষ্ট করে তাকে হত্যা করে।
এর আগে ২০ মে রাতে ঝিনাইগাতি উপজেলার বড় গজনী সড়কের দরবেশ তলা ও গজনী-বাকাকুড়া সড়কে বন্যহাতির আক্রমণে দুইজন নিহত হয়।
এলাকাবাসী বলছেন, আগে বন্যহাতির দল পাহাড় ঘেঁষা বাড়িঘরে হামলা করলেও এখন গ্রামের ভেতর অবাধে চলে আসছে। আর এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে।
বন্যহাতি গ্রামে ঢুকে আক্রমণ করার কারণে নালিতাবাড়ী উপজেলার উত্তর পলাশীকুড়া গ্রামের বাসিন্দারা বাড়ির আঙ্গিনার ছোটবড় গাছপালা কেটে ফেলেছেন। বন্যহাতির তাণ্ডব থেকে নিজেদের রক্ষায় রাত জেগে দলবেঁধে এলাকা পাহারা দিচ্ছেন তারা।
বাতকুচি টিলাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আয়নাল হক বলেন, বন্যহাতি তাড়ানোর জন্য তাদের কাছে পর্যাপ্ত ডিজেল ও সার্চ লাইট নেই। বন বিভাগের কাছে এসব উপকরণ চেয়েছেন তারা।
তিনি বলেন, “বন্যহাতি আমার পাশের বাড়ির বৃদ্ধাকে শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে আছাড় মেরে ও পায়ে পিষ্ট করে হত্যা করেছে। আমরা আতঙ্কের মধ্যে আছি। একদিকে বৃষ্টি আর অন্যদিকে অন্ধকারে বন্যহাতির ভয়ে রাত কাটছে আমাদের। আমরা বন্যহাতি সমস্যার স্থায়ী সমাধান চাই।”
বন্যহাতির আক্রমণে সীমান্ত এলাকার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জানিয়ে নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা আক্তার ববি বলেন, তাদের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া বন বিভাগের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তরা আবেদন করলে সরকারিভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
১০ বছরে বন্যহাতির আক্রমণে নিহত ৪৫, মারা পড়েছে ৩৪ হাতি
২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত শেরপুর জেলার বিভিন্ন সীমান্তে বন্যহাতির আক্রমণে ৪৫ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানিয়েছে বন বিভাগ। সেইসঙ্গে মারা গেছে ৩৪টি বন্যহাতি।
এসব তথ্য জানান শেরপুর বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মহাম্মদ নুরুল করিম।
রোববার বিকালে তিনি বলেন, মানুষের তৈরি বৈদ্যুতিক ফাঁদে, গুলিবিদ্ধ হয়ে, খাদ্যে বিষক্রিয়া কিংবা অসুস্থতাজনিত কারণ হাতিগুলো মারা যায়। এ ঘটনায় শেরপুরে আদালতে দুটি মামলা চলমান রয়েছে।
সরকারিভাবে বন্যহাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনে জেলায় ৫৩টি ইআরটি (এলিফেন্ট রেসপন্স টিম) গঠন করা হয়েছে। প্রত্যেকটি দলে ১০ জন করে মোট ৫৩০ জন কাজ করছেন।
এর মধ্যে ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার পাহাড়ি জনপদে প্রায় ৩০ কিলোমিটার সোলার ফেন্সিং ও বায়োফেন্সিং করা হয়েছে। বন্যহাতির আক্রমণে নিহতের পরিবারকে তিন লাখ টাকা, আহত ব্যক্তিকে এক লাখ টাকা এবং ফসলের ক্ষয়ক্ষতির জন্য প্রত্যেক কৃষককে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ প্রদান করছে সরকার।
এ ছাড়া বন্যহাতির তাড়ানোর জন্য মশাল জ্বালানোর জন্য প্রয়োজনীয় তেল ও টর্চ লাইট বিতরণ করা হয়েছে বলে জানান নুরুল করিম।
তিনি বলেন, ২৬ মে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান মধুটিলা রেঞ্জ এলাকায় বনবিভাগের রোপণ করা দীর্ঘমেয়াদি বনায়নের গাছ পরিদর্শন করেন।
পরে তিনি বন্যহাতি ও মানুষ দ্বন্দ্ব নিরসনে হাতি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে চেক বিতরণ ও এলিফেন্ট রেসপন্স টিম (ইআরটি) সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন।