Published : 23 Apr 2025, 11:35 AM
সোজা হয়ে চলতে পারেন না জয়ন্তী রায়। তিনি কুঁজো, তাই ঝুঁকে চলতে হয়।
৪০ বছর বয়সী জয়ন্তীর জীবন কখনও সহজ ছিল না। প্রথম জীবনে পারিবারিক অস্বছলতার মাঝে এসএসসির গণ্ডি পেরোলেও অর্থের অভাবে শিক্ষাজীবনে আর এগোতে পারেননি।
এরপর কৃষক হরিচাঁন রায়কে বিয়ে করে আরও কঠিন জীবন শুরু হয় তার। স্বামীর ঘরেও প্রতিনিয়ত তাকে লড়াই করতে হয়েছে দারিদ্র্যের সঙ্গে।
টানাপোড়েনের সংসারে জয়ন্তীর কোল আলো করে ছেলে সন্তান এলেও জীবনের আলো খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এরপরও প্রতিবন্ধকতার কাছে কখনও মাথা নিচু করেননি জয়ন্তী। ভালো থাকার আশায় বাড়ির উঠানের একটি গাছতলায় মাত্র ১০ জন শিশুকে নিয়ে শুরু করেন পাঠশালা।
শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও দারিদ্র্য, প্রতিবন্ধকতা আর সামাজিক সীমাবদ্ধতা জয় করে শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি।
গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের বন্যাবাড়ি গ্রামে জয়ন্তীর স্কুল। টিনের তৈরি ওই স্কুলের সামনে যেতেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কলতান কানে ভেসে এল। ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল লাল রঙের শাড়ি পরা এক নারীকে ঘিরে বসে আছে শিশুরা। পরে জানা গেল, তিনিই জয়ন্তী।
শিশুদের সামনে বই-খাতা আর স্কুল ব্যাগ। তাদের কারে গায়ে পোশাক আবার কেউ উদোম। সবার মুখই হাসি হাসি। তাদের লিখে লিখে অক্ষর শেখাচ্ছিলেন জয়ন্তী।
সেখানেই কথা হয় জয়ন্তী রায়ের সঙ্গে। বলছিলেন, বর্তমানে তার স্কুলে ৩০ জন শিশু পড়াশোনা করছে। স্কুল চালুর পর শিশুপ্রতি মাসে ৩০০ টাকা করে নিতেন। কিন্তু অনেক অভিভাবকের এ টাকা দেওয়ার সক্ষমতা ছিল না। তাদের কেউ ৫০ বা কেউ ১০০ টাকা করে দিতেন। কিন্তু অর্থ নয়, তার মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া। ঝড়-বৃষ্টি এলে গাছতলার পাঠশালা সরিয়ে নেওয়া হতো পাশের একটি মন্দিরে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে টুঙ্গিপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মঈনুল হক বন্যাবাড়ি গ্রামে একটি রাস্তার কাজ পরিদর্শনে গেলে জয়ন্তীর এই অনন্য পাঠশালা তার নজরে আসে। তারপরই বদলে যায় দৃশ্যপট; শিশুদের পড়ানোর জন্য টিনশেড নির্মাণ ও শিক্ষক জয়ন্তীর জন্য মাসিক ৫ হাজার টাকা বেতনের ব্যবস্থা করে দেয় উপজেলা প্রশাসন। এখন পাঠশালা চালিয়ে সরকারি বেতন পান জয়ন্তী।
বন্যাবড়ি গ্রাওেমর শর্বরী বিশ্বাস বলছিলেন, “শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী জয়ন্তীর স্বামী হরিচাঁন রায় নিজেদের জমিতে সারা বছর কৃষিকাজ করেন। সেই রোজগার দিয়েই কোন রকমে তাদের সংসার চলতো। সংসারের অভাব ঘোচাতে ও স্বামীকে আর্থিক সাহায্য করতে পাঠশালা খোলেন জয়ন্তী। তিনি প্রথম দিকে ১০ শিশুকে পড়িয়ে মাসে ৩ হাজার টাকা নিতেন তিনি। ছাত্রদের কেউ কেউ ৩০০ টাকা দিত, আবার অনেকে ৫০, ১০০ ও ২০০ টাকাও দিতো।”
একই এলাকার মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল বলেন, “হরিচাঁদ-জয়ন্তী দম্পত্তি এক ছেলেকে নিয়ে এভাবেই সংসার চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ২০২৪ সালের শুরুর দিকে বন্যাবাড়ি গ্রামের একটি রাস্তার কাজ পরিদর্শনে আসেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মঈনুল হক। তারপর থেকেই শিক্ষার্থীদের পড়ানো বাবদ কোন টাকা দিতে হয় না জয়ন্তীকে।”
সেই গল্পটা জানতে চাওয়া হলে জয়ন্তী বলেন, হঠাৎ একদিন ইউএনও স্যার গাছতলার পাঠশালায় আসেন। তখন এলাকার শিশুদের পড়িয়ে মাসিক ৩০০ টাকা নেই বলে তিনি জানতে পারেন। তিনি আমাকে অভিভাবকদের কাছ টাকা নিতে নিষেধ করেন এবং মাস শেষে উপজেলায় গিয়ে ১০ জন শিক্ষার্থীকে পড়ানোর পারিশ্রমিক বাবদ ৩ হাজার টাকা তার (ইউএনও) কাছ আনতে বলেন।
“২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ হাজার টাকা করে ইউএনও স্যারের কাছ থেকে নিয়ে আসতাম। এপর ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে
হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের মন্দিরভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় আমার পাঠশালা অর্ন্তভুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এখন ওই কার্যক্রমের আওতায় মাসিক ৫ হাজার টাকা বেতন পাচ্ছি।”
তিনি বলেন, “চলতি বছরের মার্চ মাসে ইউএনও স্যার একটি টিনশেড ঘরের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এখন বাড়িতে পাঠশালা চালিয়ে সরকারি বেতন পাচ্ছি। এলাকার শিশুদের আজীবন বিনা পয়সায় অক্ষরজ্ঞান দিয়ে যাব। আর আমার মতো শারীরিক প্রতিবন্ধীকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করায় সরকার ও উপজেলা প্রশাসনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।”
বন্যাবাড়ি গ্রামের শিউলি বিশ্বাস নামের এক অভিভাবক বলেন, “সংসারের অভাব-অনটন ঘোচাতে জয়ন্তী বাড়ির উঠানে গাছের নিচে পাঠশালা শুরু করে। আগে রোদ-বৃষ্টিতে আমাদের ছেলে-মেয়েরা কষ্ট পেত। বৃষ্টি আসলেই পাশের মন্দিরে গিয়ে আশ্রয় নিতো হতো। তারওপর আমরা গরিব; সবাই ঠিকমতো জয়ন্তীকে পড়ানোর টাকা দিতে পারতাম না। ইউএনও স্যার একটি ঘর ও জয়ন্তীর পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।”
সবিতা রায় বলছিলেন, “এখন বিনা টাকায় এখানে আমাদের ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করছে। আমাদেরও সুবিধা হয়েছে।”
জয়ন্তীর পাঠশালার বিষয়ে টুঙ্গিপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মঈনুল হক বলেন, “বন্যাবাড়ি গ্রামের শিশুদের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচির (টিআর) আওতায় ১ লাখ ১৪ হাজার ব্যয়ে একটি টিনশেড পাঠশালা নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। পাশপাশি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় পাঠশালার শিক্ষক জয়ন্তী রায়ের বেতনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।
“এছাড়া পাঠশালায় বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়ার পর শিশুদের গরমে দুর্ভোগ কমাতে প্রশাসন থেকে তিনটি পাখার ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয়েছে।”
জনকল্যাণে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ধরনের সহায়তা প্রদান অব্যাহত থাকবে বলে জানান ইউএনও।