Published : 27 Mar 2025, 02:21 PM
সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে যাদুকাটা নদীতে শুরু হয়েছে পণাতীর্থ বা গঙ্গাস্নান। তবে মহাবারুণী স্নান নামে পরিচিত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এই উৎসবে এবার পুণ্যার্থীদের উপস্থিতি অনেক কম দেখা গেছে।
অন্যদিকে প্রতিবছর একই সময়ে যাদুকাটার তীরে লৌকিক পীর খ্যাত সাধক শাহ আরেফিনের মাজারেও ওরশ হয়, বসে মেলা। এবার সেই ওরশ-মেলাও হচ্ছে না।
শ্রীশ্রী অদ্বৈত জন্মধাম কেন্দ্রীয় পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অদ্বৈত রায় বলেন, বুধবার রাত থেকেই পূণ্যস্নান সম্পন্ন করা শুরু করেছেন ভক্তরা। বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত স্নানের লগ্ন আছে। তবে এবার পুণ্যার্থীদের উপস্থিতি কম।
তিনি জানান, এবার স্নানের লগ্ন নির্ধারিত হয়েছে বুধবার রাত ১১টা ১ মিনিট ৫৩ সেকেন্ড থেকে বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ২৪ মিনিট ৩২ সেকেন্ড পর্যন্ত।
প্রতি বছর চৈত্রের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে পৃথিবীর সপ্তবারীর জল যাদুকাটা নদীতে এসে মিশে, যেখানে স্নান করলে গঙ্গাস্নানের মতো পূতপবিত্র হওয়া যায় এমনটাই বিশ্বাস সনাতন ধর্মাবলম্বী পুণ্যার্থীদের।
তাই পাঁচ শতাধিক বছর ধরে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নে অদ্বৈত আচার্য্যর জন্মধাম নবগ্রাম রাজারগাওয়ে জড়ো হন দেশ বিদেশের লাখো পুণ্যার্থী।
স্নান করতে আসা ভক্তরা অদ্বৈত মন্দিরে জড়ো হন, নানা আচারাদি পালন করেন। এসময় তারা পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণও করেন। ভোগ বাতি ও মানসিক প্রদান করেন তারা।
এ স্নানোৎসব ঘিরে যাদুকাটার তীরে প্রতিবছর বারুণী মেলাও অনুষ্ঠিত হয়। এবার কিছু দোকান-পাট থাকলেও সেভাবে জমে ওঠেনি মেলা।
অদ্বৈত জন্মধাম কেন্দ্রীয় পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অদ্বৈত রায় বলেন, “পণাতীর্থ ও বারুণীমেলা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সব আয়োজন আছে। পুণ্যার্থীদের সুবিধা ও যানজট নিরসনে ওয়ানওয়ে রাস্তায় যানবাহন চলাচল করছে।
“মঙ্গলবার বিকাল ৫টার পর থেকেই এসব সড়কে ট্রাক, ট্রাক্টর, কোস্টার, কোচ, মাহিন্দ্র ট্রাক্টর বড় যানবাহন চলাচল বন্ধ আছে।”
সিলেটের ওসমানীনগর থানার কুররা গ্রামের জয়ব্রত দাস বলেন, “আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে এসেছি। এর আগেও আরও দুইবার এসেছি। তখন লাখো পুণ্যার্থী দেখেছি। নদীর দুই তীর প্রায় ২-৩ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে পুণ্যার্থীরা স্নান করতেন। কিন্তু এবার স্নানে কম এসেছেন মানুষ।”
শাল্লা উপজেলার শোধনখল্লী গ্রামের নিপু দাস বলেন, আমি প্রতি বছরই স্নানে আসি। এবারের মতো কম পুণ্যার্থী এর আগে দেখিনি। এবার দেশের পরিস্থিতি ও লগ্ন দীর্ঘ হওয়ার কারণে হয়তো পুণ্যার্থীদের উপস্থিতি কম।
তবে স্নান বা আচারাদিতে কোনও সমস্যা হয়নি বলে জানান তিনি।
এদিকে প্রতি বছর এ সময়ে একই নদীর পূর্ব পাড়ে লাউড়েড়গড় গ্রামে মুসলিম ধর্মের সাধক ও লৌকিক পীর খ্যাত শাহ আরেফিনের আস্তানায় অনুষ্ঠিত হয় তিনদিন ব্যাপী ওরশ।
যুগ যুগ ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য উৎসব হিসেবে বারুণি স্নান ও শাহ আরেফিনের ওরশ দুই ধর্মের মানুষের মিলন উৎসবে পরিণত হয়ে আসছে।
ওরশে হামদ-নাত-গান-আলোচনায় সাধন ভজন করতেন দেশ-বিদেশ থেকে আসা শাহ আরেফিনের আশেকানরা।
কিন্তু এবার শাহ আরেফিনের মাজারের ওরশ হবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
শাহ আরেফিন মাজার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আলম সাব্বির বলেন, এবার তারা কোনও অনুষ্ঠান করছেন না।
তিনি বলেন, “শবে কদর ও রমজানের কারণে শাহ আরেফিনের ওরশ ও মেলা বন্ধ আছে। আমরা কমিটি বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
শত বছর ধরে চলা শাহ আরেফিনের ওরশ অতীতে এভাবে বন্ধ হয়নি বলে জানিয়ে হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জের আলা উদ্দিন বলেন, “আমি গত ৩০ বছর ধরে বাবা শারফিনের আস্তানায় আসি। কাফেলার সঙ্গে ওরসে আসি। গানে গানে বাবা শারফিনকে ডাকি। আমরাতো কারো কোনও ক্ষতি করি না।”
ধর্মপাশা উপজেলার নোয়াগাও গ্রামের আশরাজুল ইসলাম বলেন, “আমি ছোটবেলা থেকেই শারফিনের ওরসে বিভিন্ন কাফেলার সঙ্গে যুক্ত থাকি। এ ওরসটি আমাদের কাছে মিলন মেলা।
“শুধু মুসলমানরা নয় সব ধর্মের লোকজনই উৎসবে আসেন। সবাই নিজের মতো স্রষ্টাকে ডাকেন। প্রার্থনা করেন। কিন্তু এবার ওরস ও মেলা দুটোই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতে ভক্তবৃন্দ হতাশ।”
সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) জাকির হোসাইন বলেন, “মহাবারুণী স্নান উপলক্ষ্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে জেলা পুলিশের কর্মকর্তা ও ফোর্সের উপস্থিতিতে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
কেউ অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দিলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “স্নান উপলক্ষে আগত পুণ্যার্থীদের সুষ্ঠু ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”
তবে এবার শাহ আরেফিনের মাজার কমিটির লোকজন ওরশ না করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তা হচ্ছে না বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।