Published : 24 Feb 2023, 04:05 PM
উত্তরাঞ্চলের তিস্তার বুকে এখন ধু-ধু বালুচর। রুপালী এই বালুচরে আলু, পেঁয়াজ, ভুট্টা, মিষ্টি কুমড়া, কাঁচা মরিচসহ নানা ফসলের ঢেউ তুলেছেন চরাঞ্চলের কৃষকরা।
তিস্তাচরের অবহেলিত এই চাষীদের দাবি, সরকারের কোনও নীতি-সহায়তা না পেলেও নিজেদের বুদ্ধি ও অর্থ খরচ করে তপ্ত বালুচরে এমন সবুজের সমারোহ তৈরি করেছেন তারা। তবে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া নিয়েও শঙ্কায় আছেন তারা।
সরেজমিনে তিস্তা নদীর বিভিন্ন চর এলাকায় দেখা গেছে, মাইলের পর মাইল, একরের পর একর আলু, মিষ্টি কুমড়া, পেঁয়াজ-রসুন, ভুট্টাসহ নানা ফসলের সমাহার। তপ্ত চরে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চাষবাসে অমানবিক শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন নারী-পুরুষরা।
চাষীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বর্ষা মৌসুমে তিস্তার চরে আমন ধান চাষ হয়নি। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এলাকার চাষীরা বিভিন্ন ধরনের রবিশস্য চাষ করেছেন। আবহাওয়া ভালো থাকায় কমবেশি সবখানেই ফলন ভালো হয়েছে।
কৃষকরা জানান, আগে তিস্তার চরাঞ্চলগুলো পতিত ছিল। অন্য ফসলের আশানুরূপ ফলন না হওয়ায় এসব জমিতে ফসল ফলানো হয়নি।
এখন আধুনিক পদ্ধতিতে এসব চরে নানামুখী রবিশস্য চাষ করা হচ্ছে। এতে ভালো ফলন এবং দামও পাওয়া যাচ্ছে। ধান, গম চাষ করলে যে লাভ হয়, এর চেয়ে দ্বিগুণ লাভ হয় রবিশস্যে।
বিশেষ করে ভুট্টা চাষে বেশ লাভবান হচ্ছেন তারা। প্রতি বিঘায় ৪০ থেকে ৪৫ মণ পর্যন্ত ভুট্টা হয়। যার মূল্য প্রায় ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা। আর ব্যয় হয় বিঘা প্রতি ১০-১২ হাজার টাকা। শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ভুট্টাচাষীরা বেশ লাভবান হবেন।
চর চল্লিশার কৃষক আমজাদ মিয়া (৫৫) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাফুরে হামারাতো চরের মানুষ, চরেই হামার সব।তিন-চার মাস হামরা আবাদ সুবাদ করি। সরকার তো হামাক কিছু দেয় না। আর যদি হামার আবাদের সঠিক দামও না দে, তাহলে হামার মরণ দশা। তোমরা একনা সরকারোক কনতো হামার ফসলের ভাল দাম দেয়।”
তিনি আক্ষেপ করে আরো বলেন, “সেচ-সার-বীজ, ভর্তুকি, কৃষিঋণ দূরের কথা, কৃষি বিভাগের পরামর্শটুকুও পাইন্যা।”
তবে কৃষক আজিজুল ইসলাম (৪৫) উপজেলা কৃষি অফিস থেকে কুমড়া চাষের বীজ ও সার দেওয়া হয়েছে বলে জানান।
তিনি জানান, এবারে তিস্তার বালু চরে মিষ্টিকুমড়ার বাম্পার ফলন হয়েছে। একেকটি গর্তে চারটি করে চারা লাগিয়েছেন। প্রতিটি গাছ থেকে ১০ থেকে ১৫টি করে কুমড়া উঠবে। ভালো দাম বিক্রি করতে পারলে বেশ লাভ পাবেন।
মহিপুর এলাকার তিস্তাচরের কৃষক আমিনুল ইসলাম (৪০) এর সঙ্গে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের। তিনি বলেন, “ভাই একটা এনজিও থেকে কিস্তির উপর পঞ্চাশ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সেই টাকা দিয়ে জমির আবাদ করেছি।
“কিন্তু এখন ফসলের দাম না পেলে আমরা মাঠে মারা যাব।আমাদেরকে কিস্তির জ্বালায় বাড়ি থেকে পালিয়ে থাকতে হবে। সরকার যদি ফসলের দাম ঠিকমত দেয় তাহলে আমাদের কোনো সমস্যা হবে না ।”
লক্ষ্মিটারী এলাকার কৃষক নওফেল মিয়া (৫০) অভিযোগ করেন, “আমরা কৃষি অফিসে সাহায্য বা পরামর্শের জন্য গেলে সেভাবে পাই না। সার বা বীজ পেলে আমাদের জন্য ভালো হতো।”
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তদের তথ্য মতে- রংপুর, লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলার তিস্তার নদীবেষ্টিত ১৫৪টি চরের জমির পরিমাণ সাড়ে ১৯ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে আবাদযোগ্য প্রায় ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে ৩৩ প্রকার ফসলের চাষাবাদ হচ্ছে।
রংপুর জেলা জাতীয় কৃষক সমিতির সভাপতি অধ্যাক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চরের কৃষকরা যাতে দ্রুত তাদের কৃষিপণ্য বাজারে নিয়ে আসতে পারেন, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এতে কৃষকরা লাভবান হবেন।
“কৃষকরা যত লাভবান হবে তত আমাদের উন্নয়নের বিপ্লব ঘটবে। তাই আমি সরকারকে বলবো কৃষকের দিকে নজর দেওয়ার জন্য।”
লালমনিরহাট সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরা চরের মানুষের জন্য কাজ করছি। কোনো চর যাতে করে পড়ে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য করে কৃষকদের চাষাবাদের পরামর্শ দিচ্ছি। লালমনিরহাট সদরে যে কয়টি চর জেগেছে সেগুলোতে বিভিন্ন রকমের আবাদ হয়েছে।
“আমাদের মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তারা বাদেও আমি নিজেও প্রতিদিন মাঠে গিয়ে চরের কৃষকদের সাথে কথা বলছি এবং বিভিন্ন রকমের পরামর্শ দিচ্ছি।”
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ শাহ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রতি বছর উত্তরের চরগুলোতে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন হচ্ছে। এবার রংপুর অঞ্চলে প্রায় এক লাখ হেক্টর চরের জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফসল আবাদ হচ্ছে।
উৎপাদন দ্বিগুণ করতে চরাঞ্চলের কৃষকদের সহযোগিতার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “চরের কৃষির উন্নয়নে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও অনাবাদি জমিগুলোকে চাষের আওতায় নিয়ে আসার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কোনো জমি চাষাবাদ করতে কৃষকদের যাতে সমস্যা না হয় সেদিকটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। এবং সরকারের পক্ষ থেকে আমরা কৃষকদের সার্বক্ষণিক খোঁজখবর করছি।”
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও উন্নয়ন গবেষক কুন্ডলা চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য কৃষিতে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে তালিকা প্রণয়নের মাধ্যমে তাদেরকে জলবায়ু ঝুঁকিবীমার আওতায় আনতে হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রতি বছর দেশে শূন্য দশমিক ৭০ শতাংশ কৃষি জমি কমছে। কিন্তু পরিমাণ বাড়ছে চরের। তাই চরের কৃষি ব্যবস্থাপনায় বিশেষ প্রকল্পের পাশাপাশি বন্যা, খরাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহনীয় নানা রকম ফসলের জাত উদ্ভাবনের ওপর নজর দেওয়া জরুরি।