Published : 21 Dec 2023, 02:27 PM
ভালো জীবনের আশায় এক দশক আগে লিবিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন রুবিনা আক্তার, সেখানেই পরিচয় হয় টাইলসমিস্ত্রি রবিজুলের সঙ্গে; এরপর প্রেম আর পরিবারকে না জানিয়েই বিয়ে।
কিশোরগঞ্জের মেয়ে রুবিনা জানতেন না রবিজুলের ঘরে আরও এক স্ত্রী আছে। আর যখন জানলেন, তখন ছিল না পেছনে ফেরার সুযোগ; অগত্যা থেকে যান সতীনের সংসারেই।
দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রীকে কিছু জানাননি রবিজুল। এভাবে ফোনে সম্পর্ক ও আগের স্ত্রীদের অনুমতি না নিয়ে গোপনে একে একে বিয়ে করেন সাতটি।
অসহায় কিংবা দরিদ্র পরিবারের হওয়ায় সব স্ত্রীই থেকে গেছেন এক সংসারে, যা নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় রীতিমত ভাইরাল কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পাটিকাবাড়ি ইউনিয়নের রবিজুল ইসলাম (৩৮)।
‘সাত স্ত্রীকে নিয়ে সুখের সংসার’- রবিজুলকে নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে এমন শিরোনাম হলেও এর শুরুর ঘটনায় যে ‘প্রতারণাই’ ছিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সেটিই জানিয়েছেন তার স্ত্রীরা। বাবা-মায়ের অভাবী সংসার ও অসহায়ত্বের কারণে ‘বাধ্য হয়েই পড়ে আছেন’ সতীনের সংসারে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন বলছে, স্ত্রীদের প্রতি সমান হক প্রতিপালনের শর্তে অনুমতি নিয়ে সর্বোচ্চ চারটি বিয়ের বাইরে আরও স্ত্রী গ্রহণের বৈধতা নেই। এছাড়া একাধিক বিয়ের ক্ষেত্রে আগের স্ত্রীদের লিখিত অনাপত্তি অঙ্গীকারনামা জমা নেওয়া সাপেক্ষে বিয়ে নিবন্ধনের নিয়মের কথা জানিয়েছেন স্থানীয় এক কাজী। তবে রবিজুল এর কিছুই মানেননি বলে জানান তার স্ত্রীরা।
রবিজুলের দাবি, ‘বিধি সম্মত না হলেও’ তার স্ত্রীদের কারও কোনো অভিযোগ নেই। একসঙ্গে `শান্তিপূর্ণভাবেই’ তারা সংসার করছেন।
পেশায় মাইক্রোবাস চালক রবিজুল ১৯৯৯ সালে পারিবারিকভাবে বানু খাতুনকে বিয়ে করেন। এরপর জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমিয়েছিলেন লিবিয়ায়। সেখানে ২০১২ সালে পরিচয় হয় রুবিনার সঙ্গে। ২০১৫ সালে তারা বিয়ে (দ্বিতীয় বিয়ে) করেন। মাঝে আরেকটি বিয়ের পর চলতি বছরের অগাস্ট থেকে নভেম্বরের মধ্যেই তিনি চারটি বিয়ে করেছেন।
রবিজুলের দ্বিতীয় স্ত্রী রুবিনা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিয়ের এক সপ্তাহ পরই আমি জানতে পারি রবিজুলের বাড়িতে আগে থেকেই বউ-বাচ্চা আছে। বিষয়টি রবিজুলের কাছে জানতে চাইলে বলেছিল, তাতে কোনো সমস্যা নেই। বউ আমাকে মেনে নেবে।
“যেহেতু আমি নিজেও পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলি, সে কারণে আমিও আর প্রকৃত অবস্থাটা পরিবারকে না জানিয়েই এখানে সংসার করছি। আমার বাবা-মা এখনও জানে যে আমিই রবিজুলের বড় বউ।”
রবিজুলের ষষ্ঠ স্ত্রী কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার পোড়াদহের মেয়ে জুঁই আক্তার। তার আগের স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে দেড় মাস আগে রবিজুলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তবে জানতেন না রবিজুলের আরও পাঁচজন স্ত্রী আছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জুঁই আক্তার বলেন, “আগের স্বামী অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর প্রায় ৫ বছর দিনমজুর বাবার ঘরে মানবেতর জীবন ছিল আমার। সেসময় আমার বাবা-মাকে রাজি করিয়ে রবিজুল আমাকে বিয়ে করে। তবে আমি জানতাম না যে তার আগে আরও পাঁচ বউ আছে। জানলে কি আর এই বিয়েতে আমি রাজি হতাম!
“তাছাড়া রবিজুলও তার পাঁচ বিয়ের কথা গোপন করে রেখেছিল। আমাকে বিয়ের ১৮ দিন আগে একটা বিয়ে করেছে। আর ১৮ দিন পর আরেকটা (সপ্তম) বিয়ে করেছে। এখন কী আর করা! এখানে পেটভরে দু’মুঠো খাবার পাচ্ছি, এটা আমার জন্য অনেক।”
সাত স্ত্রী নিয়ে রবিজুলের ‘সুখের সংসারের’ খবরে সাড়া পড়েছে তার এলাকাতেও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর স্থানীয় অনেকে দেখতে যান তাদের। যদিও স্থানীয়রাও আগে জানতেন না রবিউজুলের সাত স্ত্রীর ব্যাপারে।
প্রতিবেশী স্কুল শিক্ষিকা সাবিনা খাতুন জানান, “হঠাৎ ইউটিউবে ভাইরাল হওয়া একটা সংবাদ দেখে আমি আশ্চর্য হলাম যে, আমারই বাড়ির পাশে একসঙ্গে সাত বউয়ের সংসার, আর আমি জানতেই পারিনি। তাই কৌতুহলবশত দেখতে এসেছিলাম।
“দেখলাম। বউদের সাথে কথা বলে বুঝতে চেষ্টা করলাম ব্যাপারটা কী। কীভাবে সম্ভব নির্বিবাদে একসাথে সাত বউ থেকে সংসার করে। ওদের সাথে কথা বলে মনে হয়েছে, রবিজুল প্রত্যেক বউকেই বিয়ে করেছে তথ্য গোপন করে। এরা প্রায় সবাই গরিব ঘরের মেয়ে। সে কারণে তারা অনিচ্ছা সত্বেও হয়ত আপাতত একসাথে আছে। তবে সেটা কতদিন স্থায়ী হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।”
রবিজুলের বাবা আইন উদ্দিন বলেন, “আইনে নাই, ধর্মেও নাই সাত বিয়ে, একন ছেইলি বিয়ে কইরি ফেইলিচে, ইডা বৈদি (বৈধ) না জানিউ মাইনি (মেনে) নিতি হচ্চে। ইছাড়া কিই বা করার আচে আমার? সুখ-শান্তিতে বসবাস কল্লিই ভালো।”
জানতে চাইলে কাবিন ছাড়াই সাত বিয়ের বিষয়টিকে স্বীকার করে রবিজুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট্কমকে বলেন, “আমার সাত বিয়ের মিশন কমপ্লিট। এইটা যদি অপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে দেশবাসীর কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
“আমার বউদের যেহেতু কোনো অভাব-অভিযোগ নেই, এজন্য আমার যে শাস্তি হয় হোক মেনে নেব।”
পাটিকাবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শেখ রেজভী উজ্জামান বলেন, “আমার ইউনিয়নের ঘটনা, আর আমরা জানতামই না।”
নিয়ম না মেনে একাধিক বিয়ের এমন ঘটনাকে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারকে ‘সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা’ হিসেবে মন্তব্য করেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক শাহরিয়ার হোসেন। একই কথা বলেন মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার উপ-পরিচালক নুরে সফুরা ফেরদৌস।
একাধিক বিয়ের ব্যাপারে ইসলাম কী বলে- জানতে চাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন কুষ্টিয়ার উপপরিচালক মো. হেলাল উজ্জামানের কাছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “শরিয়া অনুযায়ী শর্ত সাপেক্ষে কোনো ব্যক্তি সর্বোচ্চ চারটি বিয়ে করতে পারেন বৈধভাবে। এজন্য আগের সব স্ত্রীর অনুমতি থাকতে হবে। দাম্পত্য জীবনে সব স্ত্রীর সমঅধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এর বাইরে অতিরিক্ত কোনো স্ত্রী গ্রহণের বিধান নেই।
“যদি কেউ করেন, সেটা সম্পূর্ণ বেদাতি কর্মকাণ্ড হবে। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।”
বিয়ে বা নিকাহ নিবন্ধনের ক্ষেত্রে আগের স্ত্রীর অনুমতি থাকলে তার অনাপত্তি অঙ্গীকারনামাকে আবশ্যক বলছেন কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর ইউনিয়নের কাজী মুজ্জাফারুল ইসলাম।
“প্রথম স্ত্রীর পরে যে কয়বার বিয়ে করবে, প্রত্যেকবারই পূর্ব স্ত্রীদের লিখিত অনাপত্তি অঙ্গীকারনামা জমা নেওয়া সাপেক্ষে কাজী সাহেব পরবর্তী নিকাহ নিবন্ধন করবেন। অন্যথায় এর বাইরে কোনো নিকাহ করলে সেটার বৈধতা নেই।”