Published : 13 Jun 2025, 09:27 AM
নতুন করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সারাদেশে যখন হাসপাতালগুলোতে প্রস্তুতির জন্য কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে তখন জনবলের অভাবে বন্ধ হতে চলেছে কুমিল্লার দুটি সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিট।
গেল কোভিড মৌসুমে বিশেষায়িতভাবে জীবন রক্ষাকারী এইসব ইউনিটের ৬০টি শয্যা স্থাপন করা হলেও কয়েক বছরের ব্যবধানে এসব আইসিইউ ইউনিট বেহাল।
আট মাস ধরে চিকিৎসক-স্টাফদের বেতন-ভাতা বন্ধ থাকায় অনেকটাই অচল হয়ে আছে দেড়শ কোটি টাকা মূল্যের আইসিইউ সরঞ্জাম।
কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের কোভিড ডেডিকেটেড আইসিইউ ইউনিটের দায়িত্বে থাকা আবদুল মুকতাদির বলেন, “করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ২০২০ সালের জুনে কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতাল ও কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপন করা হয় দুটি বিশেষ আইসিইউ ইউনিট।
“ইমারজেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড পেনডামিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ প্রকল্পের আওতায় এসব ইউনিটে জনবল নিয়োগ দেওয়া হলেও গত ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
“এ ছাড়া দীর্ঘদিন বেতন-ভাতা বন্ধ থাকায় কোনোরকম জোড়াতালি দিয়ে চলছে বিশেষায়িত এই দুটি ইউনিটের কার্যক্রম।”
আবদুল মুকতাদির বলেন, “কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালের ৩০টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ১০টি চালু আছ। তাও চলছে একজন চিকিৎসক ও চারজন নার্স দিয়ে। কোটি কোটি টাকার জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম নষ্ট হচ্ছে। শুধুমাত্র দক্ষ জনবল নিয়োগ না থাকায় সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ৷”
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইজিও বিভাগের জুনিয়র কনসালটেন্ট মাইন উদ্দিন মিয়াজী বলে, “গত ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে যায়, অনেক চিকিৎসক-নার্স চলে যান। তারপরও আমরা কয়েকজন এখনো কাজ করছি। চাইলেই এই মূল্যবান স্বাস্থ্য সেবা ইউনিট ছেড়ে দেওয়া যায় না। আমরা চাই, প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি হোক। কারণ আবারো করোনাভাইরাসের সতর্কতা জারি হয়েছে।”
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, “গত করোনাভাইরাসের মৌসুমে জীবন বাজি রেখে এই সব ইউনিটে আমরা কাজ করেছি। এখন প্রকল্পের মেয়াদ বাতিল হয়ে যাওয়ায় আমাদের চলে যেতে হচ্ছে।”
জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটের ওয়ার্ড বয় হাবীবুর রহমান বাবলু বলেন, “গত আট মাস বেতন পাই না। তারপরও চাকরি ছেড়ে দিইনি। বেতন-ভাতা চালু করলে, লোকবলও বাড়বে, বেশি রোগীও চিকিৎসা দেওয়া যাবে।”
কোভিডের প্রথম ধাপ থেকে শুরু করে গত মৌসুমে প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষ কুমিল্লার বিভিন্ন আইসিইউ ইউনিটের চিকিৎসা নিয়েছিলেন।
এর মধ্যে আইসিইউতেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রাণ হারায় এক হাজারেরও বেশি মানুষ।
আইসিইউ না পেয়ে কতজনের প্রাণহানি হয়েছে সেটির কোনো হিসাব নেই। অথচ করোনাভাইরাসের চলতি মৌসুমে চিকিৎসা কেন্দ্র প্রস্তুতের সতর্কতার সময়ে এসে সর্বোচ্চ বিশেষায়িত আইসিইউ ইউনিট এমন বেহাল।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার শাহজাহান কবির (৬৫) গত দুই সপ্তাহ জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
রোগীর স্বজনরা বলছেন, সরকারি এসব আইসিইউতে বিনামূল্যে চিকিৎসা নেওয়া যায়। করোনাভাইরাসের সময় সবগুলো আইসিইউ চালু থাকলে সুবিধা হবে নিম্ন আয়ের মানুষের।
শাহজাহানের ভাতিজা মাহবুব আলম বলেন, “বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে এতদিন রোগী রাখলে কয়েক লাখ টাকা দিতে হত। অথচ এখানে প্রায় বিনামূল্যেই আইসিইউর সেবা পাওয়া যাচ্ছে। গরিব-দুঃখি মানুষ যাদের আইসিইউ প্রয়োজন, তারা চাইলে এখান থেকে চিকিৎসা নিতে পারতেন। অথচ শুধু লোকবলের অভাবে এখানে আইসিইউ সিটগুলো খালি পড়ে আছে।”
আইসিইউতে চিকিৎসা নিচ্ছেন বুড়িচং উপজেলার শিকারপুর গ্রামের ১৪ বছর বয়সি হোসাইন।
তার মা শাহিনা বেগম বলেন, “ডাক্তাররা আমার ছেলেকে আইসিইউতে নিতে বলেছে। কিন্তু আমার যা অর্থনৈতিক অবস্থা, তাতে বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে আমার পরিচিত একজনের পরামর্শে সদর হাসপাতালে ছেলেকে ভর্তি করিয়েছি। এখানে বিনামূল্যেই ছেলের চিকিৎসা হচ্ছে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এই দুই হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আইসিইউ ইউনিট জনবল শূন্য বলা হলেও সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, কয়েকজন চিকিৎসক ও নার্স স্বপ্রণোদিত হয়ে এখনো সেবা দিচ্ছেন।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জেনালের হাসপাতালের ৩০টি করে শয্যার মধ্যে চালু আছে ১০টি করে শয্যা।
একজন করে চিকিৎসক ও চারজন করে নার্স-আয়া দিয়ে চলছে ইউনিট দুটির চিকিৎসা কার্যক্রম।
কুমিল্লার সিভিল সার্জন আলী নূর মোহাম্মদ বশির আহমেদ বলছেন, “কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটের প্রকল্প মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণেই চিকিৎসক ও স্টাফদের বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে আইসিইউ ইউনিটগুলোর বিষয়ে জানানো হয়েছে।
“এসব বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর অবগত আছেন, আশা করছি, খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এই জটিলতা নিরসন হয়ে আইসিইউ ইউনিটগুলো পুরোদমে চালু হবে।”