Published : 30 Apr 2025, 09:15 AM
“আমার ছেলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। আমি সবসময় আতঙ্কে থাকি কখন বালুবোঝাই যানবাহনে তার দুর্ঘটনা ঘটে। আর এসব গাড়ি যাতায়াতের কারণে যেভাবে ধুলা ওড়ে তাতে ছেলের এলার্জির সমস্যাও হচ্ছে। বাচ্চাদের ক্ষতি এড়াতে স্কুলের সময়ে বালু পরিবহন বন্ধ করা হোক।”
কথাগুলো বলছিলেন মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার বয়ড়া মধ্যকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক ছাত্রের অভিভাবক লাইলী আক্তার।
লাইলীর মত সন্তানদের নিয়ে একই দুশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়েছে আরও অনেক অভিভাবকের। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, উপজেলার বয়ড়া ইউনিয়নের বয়ড়া মধ্যকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় লাগোয়া একাধিক বালুর গদি রয়েছে। এসব গদি থেকে থেকে প্রতিনিয়ত বালু ট্রাক, নসিমন ও কাঁকড়া গাড়িতে পরিবহন করা হচ্ছে।
দিনরাত বালু পরিবহনের কারণে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাতায়াতের পথে দুর্ঘটনার ভয়ে থাকে। অনেক শিশু শিক্ষার্থী ‘ডাস্ট অ্যালার্জির’ সমস্যায় ভুগছেন বলেও জানান অভিভাবক ও শিক্ষকরা।
দিনের বেলা বালু পরিবহন বন্ধ করার জন্য সম্প্রতি হরিরামপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে মৌখিকভাবে জানানো হলে তিনি ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন।
যদিও বালু ব্যবসায়ীদের দাবি, দিনের বেলা বালু পরিবহন করেন না তারা।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যালয় লগোয়া ৫০ মিটারের মধ্যে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান দেওয়ান সাইদুর রহমানের গদি ছিল। গত বছরের পাঁচ অগাস্টের পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান। তার গদির পাশেই বাদল মণ্ডল নামের একজনের গদি রয়েছে। তবে ওই গদির মালিক মূলত উপজেলা যুবদলের সদস্যসচিব আবু সাদাত মোহাম্মদ শাহিন ওরফে মোল্লা শাহিন।
শাহিনের পাশেই বালু ফেলছেন উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মাছুম শিকদার ও মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন। এর একটু এগালেই মিলবে সোহেল বাবু ও মামুনের গদি। এ ছাড়া বিল্টুর গদি, আবু সাঈদ ও নুরুল ইসলামের গদি, মোল্লা আজিজ, সিরাজ ও শাকিলের গদি রয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, এসব গদি থেকে দিনে ও রাতে ‘অর্ধশতাধিক’ যানবাহনে বিদ্যালয় সংলগ্ন সড়ক দিয়ে বালু পরিবহন করা হয়। দিনের বেলায় বালু পরিবহনের যানবাহন বেপরোয়াভাবে চলাচল করায় দুর্ঘটনার শঙ্কা রয়েছে।
বয়ড়া মধ্যকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রের অভিভাবক সীমা আক্তার। এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে সীমার কন্ঠেও ফুটে ওঠে অসহায়েত্বের সুর।
তিনি বলছিলেন, “উনারা ব্যবসা করুক তবে বিদ্যালয় চলাকালীন সময়ে ট্রাক বন্ধ করতে হবে। না হলে আমাদের সন্তানদের বড় ক্ষতি হতে পারে।”
বয়ড়া মধ্যকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রাশেদা আক্তার এ প্রসঙ্গে বলেন, “এর আগে এক ছোট্ট শিশুর বালুর গাড়ির নিচে পড়েছিল। দুই চাকার মাঝে হওয়ায় বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। বিদ্যালয় চলাকালীন সময়ে বালু পরিবহন বন্ধে প্রশাসনকে দুই-তিন বছর আগে লিখিত অভিযোগও দিয়েছিলাম।
“তখন চার মাসের মতো বন্ধ থাকলেও আবার আগের চেহারায় ফিরে আসে। ছাত্র-ছাত্রীসহ আমরা বালুর গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গাড়ি যাতায়াত বন্ধও করেছি, তারপরও দিনের বেলা বালু পরিবহন বন্ধ হচ্ছে না।”
তিনি বলেন, “স্কুল চলাকালীন বালু পরিবহন বন্ধ করার বিষয়ে হরিরামপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলামকে আমরা মৌখিকভাবে জানিয়েছি। আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের কথা চিন্তা করে এটা বন্ধ করতে হবে।”
প্রধান শিক্ষক ঝর্ণা আক্তার বলছেন, “দিনের বেলা বালু পরিবহনের কারণে বিদ্যালয়ের ক্লাসরুম ও লাইব্রেরিতে বালুর আস্তর জমে যায়। দুর্ঘটনার শঙ্কায় ছাত্র ছাত্রীদের অভিভাবকরা আতঙ্কে থাকেন বলে একাধিকবার জানিয়েছেন। আমরাও ভয়ে থাকি, কোন সময় আমার ছাত্র-ছাত্রীরা দুর্ঘটনায় পড়ে। দিনের বেলায় বালু পরিবহন বন্ধ হওয়া জরুরি।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বালু ব্যবসায়ী যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মাছুম শিকদার বলেন, “আমাদের বালুর গদি এখনও চালুই হয়নি। দিনের বেলা বালু পরিবহনের প্রশ্নই ওঠে না।”
আরেক বালু ব্যবসায়ী বাদল মণ্ডল বলেন, “দিনের বেলায় বালু পরিবহন করা হয় না।”
একই ধরনের সুর উপজেলা যুবদলের সদস্যসচিব আবু সাদাত মোহাম্মদ মোল্লা শাহিনের কণ্ঠেও ফুটে উঠল।
তিনি বলছেন, “দিনের বেলায় তো বালু পরিবহন বন্ধ। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমস্যা হতে পারে। আমরা দিনের বেলায় কাউকে বালু পরিবহন করতে দেব না।”
হরিরামপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম বলছিলেন, “বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ঝর্ণা আক্তারসহ শিক্ষকরা এর আগে এ বিষয়ে জানিয়েছেন। এ বিষয়ে ইউএনও ম্যডামের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কোহিনুর আক্তার বলেন, “স্কুল চলাকালীন বালু পরিবহনের কোনো সুযোগ নেই। দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”