Published : 26 Aug 2024, 06:26 PM
গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে আসা বানের পানি বুড়িচং হয়ে পাশে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় প্রবেশ করবে- সেটা অনুমিতই ছিল। কিন্তু এর সঙ্গে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত দুই নদী সালদা ও ঘুংঘুরের বাঁধও ভেঙে গেছে।
গোমতী, সালদা আর ঘুংঘুর- এই তিন নদীর পানি ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি এখন ভয়াবহ হয়ে পড়েছে। প্রতিটি সড়ক তলিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এ উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা।
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) স ম আজহারুল ইসলাম বলেন, “একদিকে গোমতীর বাঁধভাঙা পানি বুড়িচং হয়ে প্রবেশ করছে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায়। একইসঙ্গে এ উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত সালদা ও ঘুংঘুর নদীর বাঁধ ভেঙে এ উপজেলায় পানি ঢুকছে স্রোতের মতো। বর্তমানে ব্রাহ্মণপাড়ায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে।”
এখন পর্যন্ত জেলার ১৪টি উপজেলা প্লাবিত হওয়ার খবর দিয়েছে জেলা প্রশাসন। গোমতীর পানি এখনও বিপৎসীমার উপরে। প্রতিনিয়ত প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। লোকালয়ে হু হু করে ঢুকছে পানি। এতে দিশাহারা হয়ে ঘরবাড়ি ফেলে প্রাণে বাঁচতে মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছেন। সবমিলিয়ে ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে কুমিল্লার বন্যা পরিস্থিতি।
সোমবার দুপুরে কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী (পাউবো) প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জমান জানান, গোমতীর পানি এখনও বিপৎসীমার ৪২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, “পানি না কমলে বাঁধ মেরামত করা সম্ভব না। পানি না কমা পর্যন্ত নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হতেই থাকবে।”
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় বর্তমানে পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা ৭০ হাজারের বেশি বলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) স ম আজহারুল ইসলাম জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “পানিবন্দিদের উদ্ধারে উপজেলা প্রশাসন, সামাজিক সংগঠন, সাংবাদিক ও স্বেচ্ছাসেবকরা দিনরাত কাজ করছেন। ইতোমধ্যে প্রায় আট হাজার পরিবারকে উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রসহ বন্যাদুর্গতদের খাদ্য ও নিরাপদ পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।”
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা সদরের বাসিন্দা আতাউর রহমান বলছিলেন, “গত ২০ বছরেও এমন পানি দেখা যায়নি এ উপজেলায়। এবার গোমতী ও সালদা নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে বন্যার পানি লোকালয়ে ঢুকে উপজেলার প্রায় সব এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে তলিয়ে গেছে ফসলি জমি, মাছের ঘের ও রাস্তাঘাট। ঘরে বাইরে পানি আর পানি।
“যার ফলে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন বানভাসি মানুষ। অনেকেই জীবন বাঁচাতে ঘরে জিনিসপত্র রেখে ঘর তালাবদ্ধ করে আশ্রয় নিয়েছেন নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে। গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন অনেকে। খাদ্য সংকটের পাশাপাশি নিরাপদ পানির অভাবে ভুগছেন অনেক পরিবার।”
বন্যায় সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বুড়িচং উপজেলায়। ভেঙে যাওয়া গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ দিয়ে প্রতিনিয়ত স্রোতের মতো লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। এতে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বুড়িচংয়ে এখনও লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। দেখা দিয়েছে তীব্র বিশুদ্ধ পানির সংকট।
সরেজমিনে জানা গেছে, ২২ অগাস্ট রাত পৌনে ১২টার দিকে বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের বুড়বুড়িয়া এলাকার গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের অন্তত ৩০ ফুট এলাকা ধসে লোকালয়ে পানি ঢুকতে শুরু করে। এতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্লাবিত হয়ে যায় পুরো বুড়িচং উপজেলা। বর্তমানে প্রতিনিয়ত সেই ভাঙন বেড়েই চলেছে।
বুড়িচং হয়ে গোমতীর পানি আর অন্যদিক দিয়ে ঘুংঘুর ও সালদা নদীর পানি ডুকে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা এখন পানিতে ভাসছে। প্রতিটি সড়ক তলিয়ে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এ উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা। বন্যার পানি প্রবেশ করেছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও। পানিবন্দি পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ আশ্রয়ে আনতে আটটি উদ্ধার দলসহ স্বেচ্ছাসেবী ও সামাজিক সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে উপজেলা প্রশাসন। পর্যাপ্ত নৌকা সংকটের কারণে ঢাকা থেকে ড্রাম এনে ভেলা তৈরি করে উদ্ধার কাজ চালু রাখা হয়েছে এ উপজেলায়। আশ্রয়কেন্দ্রে যারা আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের শুকনো খাবার ও নিরাপদ পানি দেওয়া হচ্ছে। তবে এটি চাহিদার তুলনায় সামান্য। এজন্য মানুষের দুর্ভোগ ও কষ্ট বেড়েই চলেছে।
বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইদা আক্তার বলেন, “আমার উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। গোমতীর পানি প্রতিনিয়ত প্রবেশ করায় বুড়িচং এর বন্যার পানিও উচ্চতাও বেড়ে চলেছে। এখন এই উপজেলা প্রচুর মানুষ পানিবন্দি আছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি আটকে পড়াদের উদ্ধার করে আশ্রায়কেন্দ্রে নেওয়ার জন্য। তাদের জন্য খাবার ও বিশুদ্ধ পানিরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
এদিকে জেলায় বন্যকবলিতদের ত্রাণ বিতরণের জন্য নৌযানের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। যার কারণে ত্রাণ সামগ্রী সমানভাবে বণ্টন হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বানভাসিরা। বেশিরভাগ স্থানেই মানুষ সহায়তা নিয়ে গেলেও প্রবেশ পথে ডাঙার মানুষজন কৌশলে ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছেন। এতে বঞ্চিত হচ্ছেন বানভাসিরা। জেলার বন্যা কবলিত উপজেলাগুলোর প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণ না পৌছায় কষ্টে হাহাকার করছেন বানভাসি মানুষ।
ত্রাণের সংকট মনোহরগঞ্জ-নাঙ্গলকোটে
জেলার দক্ষিণাঞ্চলের মনোহরগঞ্জ, লাকসাম ও নাঙ্গলকোট উপজেলায়ও ডাকাতিয়া নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। রোববার রাত থেকে অনবরত বৃষ্টি হতে থাকায় এসব এলাকার মানুষ আতঙ্কে দিন পার করছেন।
সোমবার সরেজমিনে দেখা গেছে, মনোহরগঞ্জ উপজেলায় অনেক আশ্রয়কেন্দ্র পানির নিচে তলিয়ে আছে। এ উপজেলাসহ নাঙ্গলকোট উপজেলার বেশিরভাগ প্রত্যন্ত অঞ্চলে ত্রাণ সহায়তা এখনও পৌঁছায়নি। চারদিকে ত্রাণের জন্য হাহাকার। বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট।
জেলার চৌদ্দগ্রামে পানি কিছুটা কমলেও ত্রাণ ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে মানুষ ভয়াবহ কষ্টে দিন পার করছেন।
সোমবার কুমিল্লার জেলা প্রশাসক খন্দকার মু মুশফিকুর রহমান জানান, জেলার ১৪টি উপজেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত জেলায় ৯ লাখ ৫১ হাজার ১০৯ জন পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। আর আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন ৬৬ হাজার ৯৬৬ জন। জেলার বন্যাকবলিত উপজেলাগুলোর দুর্গত এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, “বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে শুকনা খাবার, স্যালাইন ও ওষুধ বিতরণ করা হচ্ছে। ত্রাণসামগ্রী বিতরণও অব্যাহত আছে। আমরা সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর রাখছি। যারা আটকে পড়েছেন তাদেরকে উদ্ধারে কাজ চলছে।”
ব্রাহ্মণপাড়ায় কৃষকের কান্না
ভয়াবহ বন্যায় এখন দিশেহারা ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বানভাসি মানুষ। এরই মধ্যে বানের পানির তীব্র স্রোতে উপজেলায় দুই হাজার হেক্টর জমির আউশ ধান পানিতে তলিয়ে গেছে।
সপ্তাহখানেক পর মাঠ থেকে এসব ধান ঘরে তোলার প্রস্তুতি ছিল কৃষকদের। কিন্তু এর আগেই সব শেষ হয়ে গেছে।
কষ্টের ফসল তলিয়ে যাওয়ায় কাঁদছেন কৃষকরা। অনেকে বিলাপ করতে করতে মুর্ছা যাচ্ছেন। তবে শনিবার ও রোববার অনেক কৃষক চেষ্টা করেছেন পানির নিচ থেকে আধাপাকা ধান কেটে উঁচু কোনো যায়গায় রাখতে। তবে সেটি খুব বেশি সম্ভব হয়নি। কারণ এরই মধ্যে ফসলের মাঠ ১০ থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাসুদ রানা বলেন, “ভয়াবহ বন্যায় ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় দুই হাজার হেক্টর জমির আউশ ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া রোপা আমনের ১৬০ হেক্টর বীজতলা ও আবাদ করা আমন ১২’শ হেক্টর এবং দুই’শ হেক্টর জমির শাকসবজি তলিয়ে গেছে।
“এখনও যেসব জমির ধান কাটা সম্ভব, সেগুলো কেটে ঘরে তোলার জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তবে পানির পরিমাণ বেশি হওয়ায় সেটি খুব বেশি সম্ভব হচ্ছে না।”
উপজেলার দীর্ঘভূমি গ্রামের কৃষক হানিফ মিয়া বলেন, “আমি ৫০ শতক জমিতে আউশ ধানের আবাদ করেছিলাম। পরিশ্রমে ফলানো সেই ধান কয়েকদিন পর ঘরে তোলার কথা থাকলেও বন্যায় সব তলিয়ে গেছে। রোববার চেষ্টা করেছি কিছু ধান কেটে আনার। কিন্তু পানির পরিমাণ বেশি হওয়ায় সেটিও সম্ভব হয়নি।”
নাগাইশ এলাকার কৃষক ইকবাল হোসেন বলেন, “আমার সব ফসল এখন পানির নিচে। জমির মধ্যে ১০ থেকে ১৫ ফুট পানি। চেষ্টা করেও সোনালি ফসল ঘরে তুলতে পারিনি। স্বপ্নের ফসল বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে কী খেয়ে বাঁচবো, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।”