Published : 20 May 2025, 08:27 PM
ঐতিহাসিক ‘মুল্লুকে চলো’ আন্দোলনের ১০৪তম বার্ষিকী উপলক্ষে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন চা শ্রমিকরা। তারা সেই সময় নিহত সব শ্রমিকের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও দাবি করেন।
মঙ্গলবার সকালে সিলেট বিভাগের সব চা বাগানে শ্রদ্ধা জানানো হয় বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক রাজু গোয়ালা।
১৯২১ সালের এই দিনে সিলেটের চা বাগানগুলোর প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক ব্রিটিশ শাসনের শোষণ থেকে মুক্তি পেতে ‘মুল্লুকে চলো’ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। চাঁদপুরের মেঘনা ঘাটে পৌঁছালে ব্রিটিশ গোর্খা সৈন্যরা তাদের ওপর গুলি চালিয়ে শত শত শ্রমিককে হত্যা করে। এই আত্মত্যাগের স্মরণে প্রতি বছর ২০ মে চা শ্রমিক দিবস পালন করা হয়।’
চা শ্রমিকরা জানান, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগান গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে সিলেট অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চা বাগানের যাত্রা শুরু হয়। তখন ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের টিলা ভূমিতে একের পর এক চা বাগান গড়ে তোলতে থাকে। টিলা ভূমিতে চা বাগান তৈরিতে তখন অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু সিলেট অঞ্চলের দুর্গম পাহাড়ি জমিতে সাপ, জোঁক, পোকামাকড়ের মধ্যে কাজ করার মত শ্রমিকের অভাব ছিল।
ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো তখনকার অবিভক্ত ভারতের ওডিশা, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, চেন্নাই, পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন অঞ্চলের খরা ও দারিদ্র্যপীড়িত, অনুর্বর অঞ্চলে দালাল নিয়োগ করে। দালালদের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষকে নিশ্চিত, সুন্দর ও উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখানো হয়। দালালদের ফাঁদে পড়েন এসব মানুষ। এই শ্রমিকদের নিপীড়ন করা হত। চালানো হত শারীরিক নির্যাতন।
স্বপ্নভঙ্গ চা শ্রমিকরা গোপনে ‘নিজ মুল্লুকে’ (নিজ দেশে) ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ফিরে যাওয়ার পথ কারও জানা নেই। তাদের শুধু জানা ছিল, চাঁদপুর থেকে স্টিমারে কলকাতা যাওয়া যায়। এই জানাটুকু সম্বল করেই ১৯২১ সালে দিনক্ষণ ঠিক করে কাছাড় ও সিলেটের প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক ‘মুল্লুকে চলো’ ডাক দিয়ে পথে নেমে পড়েন।
দিনের পর দিন হেঁটে এক সময় নদীবন্দর চাঁদপুরে গিয়ে পৌঁছান শ্রমিকরা। পথে অনেকের মৃত্যুও হয়। চা শ্রমিকদের এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তাদের নেতা গঙ্গাদয়াল দীক্ষিত, দেওশরন ত্রিপাঠি, হরিচরণ প্রমুখ।
অপরদিকে চা বাগান ছেড়ে আসা শ্রমিকদের পথরোধ করতে সরকারের সহযোগিতায় চাঁদপুরে মোতায়েন করা হয় আসাম রাইফেলের গোর্খা সেনা। স্টিমারে উঠতে চাইলে গোর্খা সেনার শ্রতিরোধের মুখে পড়েন চা শ্রমিকরা। বাধার মুখে শ্রমিকরা তখন বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। শ্রমিকদের বিদ্রোহ ঠেকাতে ১৯২১ সালের ২০ মে সেনারা নির্বিচার গুলি চালায়। অনেক শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনাটি ব্যাপক আলোড়ন তোলে। এই আন্দোলন তখন একটি সর্বভারতীয় শ্রমিক আন্দোলনে রূপ ধারণ করে। তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে চাঁদপুর ও লাকসাম জংশনের রেল শ্রমিকেরা ২১ মে থেকে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেন।
২৪ মে থেকে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের শ্রমিক ও ২৮ মে থেকে স্টিমার ধর্মঘট চলতে থাকে। আসাম বেঙ্গল রেল শ্রমিকেরা তিন মাস এবং স্টিমার শ্রমিকেরা ছয় সপ্তাহ ধর্মঘট করেছিলেন। এই ধর্মঘট ও দেশজুড়ে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার ফলে চা বাগানের ব্রিটিশ মালিকেরা শ্রমিকদের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে বাধ্য হয়েছিলেন।
শ্রমিক নেতা রাজু গোয়ালা বলেন, “আজও চা শ্রমিকরা ভূমির অধিকার, ন্যায্য মজুরি, শিক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আমরা দাবি জানাই, ২০ মে দিনটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘চা শ্রমিক দিবস’ ঘোষণা করা হোক। সবেতন ছুটি প্রদান করা হোক। ‘মুল্লুকে চল’ আন্দোলনের ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক।”
চা শ্রমিক সুনীল তাঁতি বলেন, “আমাদের পূর্ব পুরুষদের ‘গাছ হিলেগা, রুপিয়া মিলেগা’ এমন প্রলোভন দেখিয়ে এ দেশে নিয়ে আসা হয়েছিল। শ্রমিকরা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে যখন তারা নিজ দেশে চলে যেতে চেয়েছিলেন, ওই সময় তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। শত শত চা শ্রমিককে হত্যা করে মেঘনা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। অথচ ১০৪ বছরেও আমাদের পূর্বপুরুষদের হত্যাকাণ্ডের এই দিনটিতে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। আমরা চাই দেশে সরকারিভাবে এই দিনটি পালন করা হোক।”
নারী চা শ্রমিক কুলবতি লোহার বলেন, “আমরা এই দিনটিকে চা শ্রমিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি চাই সরকারের কাছে। আমাদের দাবিটি সরকারকে মেনে নেওয়ার অনুরোধ করছি।’’
‘চা শ্রমিকরা মর্যাদাপূর্ণ মানবিক জীবন চায়’
১০৪তম চা শ্রমিক দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশন সিলেট জেলা শাখার উদ্যোগে লাক্কাতুরা চা বাগানে মিছিল, সমাবেশ ও শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে মঙ্গলবার সকাল ৯টায় সবুজ সংঘ মাঠ থেকে মিছিল শুরু হয়ে লাক্কাতুরা শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ শেষে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশন সিলেট জেলা আহ্বায়ক বীরেন সিংয়ের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য দেন ফেডারেশনের উপদেষ্টা আবু জাফর, উজ্জ্বল রায় ও প্রণব জ্যোতি পাল, ফেডারেশনের সদস্য হৃদয় লোহার, জরিনা বেগম, উষামনি গঞ্জু, জেনী মুদি।
এ ছাড়া বাংলাদেশ চা শ্রমিক ফেডারেশন সিলেট জেলা শাখার উদ্যোগে হিলুয়াছড়া, কেওয়াছড়া, খাদিম, খান চা বাগান, তারাপুর চা বাগানসহ সিলেট ভ্যালির অন্যান্য বাগানেই কর্মসূচি পালিত হয়। কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন প্রসেনজিৎ রুদ্র, শিপন পাল, রত্না বসাক, নীপা মুদি, অজয় বাউরি, শয়ন সিং, দীপা দাস, কল্পনা সিং, রতন বাউরি, উষা বুনার্জী, পঞ্চমী লোহার।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, ব্রিটিশ-পাকিস্তানিদের তাড়িয়ে দিয়ে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও চা শ্রমিকদের বঞ্চনার পরিসমাপ্তি হয়নি। শিক্ষা-চিকিৎসার ন্যূনতম আয়োজন নেই, নেই ভূমির মালিকানা।
বক্তারা মর্যাদাপূর্ণ মানবিক জীবন প্রতিষ্ঠার জন্য বৈষম্য দূর, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ, বসতভিটার স্থাযী বন্দোবস্ত নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।