Published : 21 Aug 2024, 11:46 AM
বদলে গেছে ফেনীর পাড়া-মহল্লার সব দেওয়াল। রং-তুলির আঁচড়ে সেগুলো যেন একটুকরো বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।
শহর থেকে গ্রামে কোথাও খালি নেই কোনো দেওয়াল। তারুণ্যের স্লোগান, সমসাময়িক ঘটনার প্রতিচ্ছবি ও আগামীর বাংলাদেশের নানা চিত্র ফুটে উঠেছে সেগুলোতে।
১০-১২ দিন ধরে একঝাঁক তরুণ শিক্ষার্থী হাতে তুলে নিয়েছে রং-তুলি। যাদের বেশিরভাগেরই চারুকলা কিংবা আর্টের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। তবুও প্রাণে-প্রাণ মিলিয়ে দেওয়ালগুলোতে তারা সরকারের পতন, লাল-সবুজের বাংলাদেশ, দুর্নীতি, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বাঁধভাঙা জোয়ারের প্রতিচিত্র ফুটিয়ে তুলছে।
দেয়ালচিত্রে স্থান পেয়েছে পুলিশের গুলিতে রংপুরে নিহত শিক্ষার্থী আবু সাঈদ, ঢাকার মুগ্ধ কিংবা ফেনীর ইস্তিয়াক শ্রাবণের বীরত্বগাঁথা।
জেলায় শ্রাবণ-ভাদ্রের বর্ষণের লুকোচুরির ফাঁকেও শিক্ষার্থীরা তাদের শিল্পকর্ম অব্যাহত রেখেছে। তারুণ্যের এই জোয়ারকে স্বাগত জানিয়েছে জেলার সর্বস্তরের মহল।
শহর ঘুরে দেখা যায়, ফেনী সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণ, ডাক্তারপাড়া, মাস্টারপাড়া, মিজান রোড, মডেল থানা, রাজাঝি দিঘীর পূর্বপাড়, সড়ক-জনপথের দেওয়ালসহ পাড়া-মহল্লা সব খালি দেওয়ালে চিত্রাঙ্কন করেছে শিক্ষার্থীরা। কিছুদিন আগেও পোস্টারে ঢেকে থাকা দেওয়ালগুলোতে স্থান পেয়েছে নানান চিত্র, গ্রাফিতি এবং ক্যালিওগ্রাফি।
এসব চিত্রকর্মে ফুটে উঠেছে ‘২৪-এর তারুণ্য’, ‘রক্তাক্ত জুলাই ২০২৪’, ‘স্বাধীনতা এনেছি সংস্কারও আনবো’, ‘ধর্ম যার যার; বাংলাদেশ সবার’, ‘আমরা হার মানবো না’, ‘দেশটা আমাদের সবার’, ‘দেশকে ভালোবাসলে আগলে রেখো’, ‘সংস্কার করবে কে?’, ‘আমরাই বিকল্প’, ‘খেটে বড় হও, চেটে নয়’, ‘হোক প্রতিবাদ’, ‘ভেঙে ফেল কর রে লোপাট’, ‘দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার হে’, ‘ভয়ের দেওয়াল ভাঙলো, এবার জোয়ার এলো ছাত্র-জনতার’, ‘জিজ্ঞেস করো যদি কথা বলে উঠবে পাহাড়’, ‘দুর্নীতি ঠেকাতে আওয়াজ তুলুন’, ‘দুর্নীতি দেখলেই মাইর’সহ ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী, সন্ত্রাসবিরোধী, আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতি সংবলিত বিভিন্ন স্লোগান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির নানা উদাহরণ।
দেওয়াল লিখনে ব্যস্ত ঢাকার শান্তা মারিয়ম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহবুবা তাবাচ্ছুম ইমা বলেন, “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সময়টা কাজে লাগাচ্ছি দেওয়াল অঙ্কন করে। আমার ভাইরা দেশটাকে পুনরায় স্বাধীন করতে জীবন দিয়েছে, আমরা তাদেরকে স্মরণে রাখতে ক্ষুদ্র প্রয়াস চালাচ্ছি।”
ফেনী সরকারি কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী কাজি জামিল হোসেন চয়ন বলেন, “যেসব দেওয়ালে এতদিন শ্যাওলা জমেছিল কিংবা রাজনৈতিক ব্যানার-পোস্টার-বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সেঁটে ছিল, সেসব দেওয়ালে এখন শোভা পাচ্ছে আমাদের আঁকা ’২৪ এর সাহসিকতা বা বিপ্লবের নানান স্লোগান।”
রং-তুলিতে দেওয়াল লিখনে ব্যস্ত ফেনী সরকারি গার্লস স্কুলের শিক্ষার্থী রাইসা রাওয়ান বলেন, “অনেকেই বলে আমাদের এ প্রজন্ম মোবাইলে আসক্তির প্রজন্ম। অথচ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সফল করেছে বর্তমান প্রজন্ম। রাজপথের পাশাপাশি অনলাইন যোদ্ধা হয়েও অনেকে কাজ করেছেন। সে অবদানগুলোই আমাদের দেওয়ালে তুলে ধরা হচ্ছে।”
ফেনী ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী প্রমিলার নেতৃত্বে এক ঝাঁক শিক্ষার্থী মাস্টার পাড়ার প্রবেশ মুখের দেওয়ালে অংকন করছিলেন।
সেখানে ফেনীর সেন্ট্রাল হাই স্কুলের শিক্ষার্থী নাফিসা তাবাসসুম বলেন, “আবু সাঈদ এ প্রজন্মকে দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে বুক চিতিয়ে লড়াই করতে হয়। তাকে পুলিশ যেভাবে হত্যা করেছে, আমরা সে চিত্র দেওয়ালে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। যাতে আবু সাঈদ সম্পর্কে সবাই জানতে পারে। এছাড়া ছাত্র আন্দোলনে পুলিশ যে নির্বিকার গুলি চালিয়েছে তাও তুলে ধরছি ।”
ফেনী সরকারি কলেজের স্নাতকের আরেক শিক্ষার্থী মেহেদি হাসান বলেন, “আমরা ‘৫২ দেখিনি, ’৭১ দেখিনি; তবে বই পড়ার মাধ্যমে আমরা সেসব বীরত্বের সম্পর্কে জানতে পেরেছি। গত এক মাসের ছাত্র আন্দোলন থেকে স্বৈরাচার পতন, এ সময়টা তরুণ প্রজন্ম পার করেছে। সে বিষয়গুলো দেওয়ালচিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে।”
দেওয়াল অঙ্কনের পাশাপাশি কেউ কেউ আরবি ক্যালিওগ্রাফিও করছেন। ফেনী আলিয়া মাদরাসা এলাকার ও হার্ট ফাউন্ডেশনের পাশের দেওয়ালে আরবিতে বিভিন্ন লেখা ও দেশাত্মবোধক নানা চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। আলিয়া মাদরাসার সামনে ক্যালিওগ্রাফিও অঙ্কনের নেতৃত্বে ছিলেন মাদরাসার শিক্ষার্থী মাহবুবুর রহমান।
জেলার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি নিয়ে গড়ে ওঠা প্ল্যাটফর্ম ‘স্বেচ্ছাসেবী পরিবারে’র একজন সংগঠক ইমন-উল হক বলেন, সাড়ে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী স্বেচ্ছাসেবক পরিবারের সঙ্গে সভা করে দেওয়াল চিত্র, গ্রাফিতি ও ক্যালিওগ্রাফি এঁকেছে। স্বেচ্ছাসেবক পরিবার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে তাদের রং-তুলি, উপকরণ ও নাস্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কাজি ইকবাল আহমেদ পরান নামের এক অভিভাবক বলেন, “কিছুদিন আগে দেখলাম শিক্ষার্থীরা শহরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করেছে, ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ করেছে। এখন তারাই দেওয়াল লিখন কর্মসূচি পালন করছে। এভাবে তরুণরা সবাই এগিয়ে এলে দেশটা আসলেই সুন্দর না হয়ে পারে না।”
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ফেনীর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জাহিদ হোসেন বাবলু বলেন, ধর্ম নিরপেক্ষ অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে তারুণ্যের এ বাঁধভাঙা জোয়ার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে লালন করতে হবে।
“নোবেলজয়ী ডক্টর ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে তারুণ্যের ভাষা বুঝে দেশ সংস্কার করে বাংলাদেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাবে এই প্রত্যাশা করছি। ”