Published : 06 Feb 2025, 11:40 PM
ইতালি গিয়ে পরিবারের সচ্ছলতা ফেরানোর স্বপ্নে তারা দালালকে টাকা দিয়েছিলেন, কেউ নিজের ভিটে-মাটি বিক্রি করে, কারও বাবা উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে। কিন্তু ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে তাদের মৃত্যুর সঙ্গে ডুবে গেছে তাদের পরিবারের স্বপ্নও।
সন্তান, স্বামী বা ভাই হারানো পরিবারগুলোয় তাই আজ শোকের মাতম। তেমনটাই দেখা গেল গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার রাঘদী ইউনিয়নের তিন বাড়িতে।
বৃহস্পতিবার সকালে এ ইউনিয়নের চরপ্রসন্নদী গ্রামের সাত্তার খন্দকারের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের সামনে সাত্তারের ছোট ছেলে চার বছর বয়সী আব্দুল্লা আল সাইদ ও আট বছর বয়সী মেয়ে হালিমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন এলাকাবাসী।
বাকরুদ্ধ হয়ে আছেন স্বামীকে হারিয়ে ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়া লাবনী খন্দকার। বিলাপ করতে করতে পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন সাত্তারের শ্বশুর-শাশুড়ি।
থেকে থেকে বিলাপ করছেন সাত্তারের ভাই আবুল খায়ের খন্দকার। ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ের স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠছে সেখানের পরিবেশ, এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
৪০ বছরের সাত্তার খন্দকার বৈধপথে সুযোগ না পেয়ে অবৈধভাবেই ইতালি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেজন্য ভিটে মাটি বিক্রি ও সুদে টাকা নিয়ে দিয়েছিলেন দালালকে।
কিন্তু সম্প্রতি ভূমধ্যসাগরে নৌযান ডুবে লিবিয়া উপকূলে ভেসে আসা ২৩টি লাশের মধ্যে সাত্তার খন্দকারের লাশও আছে।
জানতে চাইলে আবুল খায়ের খন্দকার বলেন, “একই ইউনিয়নের মোল্লাদী গ্রামের হামেদ শেখের ছেলে শহীদ শেখের সঙ্গে আমার ভাইয়ের ১৬ লাখ চুক্তি হয় ইতালি পৌঁছে দিবে।
“অবৈধভাবে যাওয়ার জন্য আমার সম্মতি ছিল না। কিন্তু সাত্তার শহীদকে প্রথমে ৫ লাখ টাকা দেওয়ার সময় আমাকে জানায়, তখন অনিচ্ছাসত্ত্বেও সম্মতি দিতে হয়। ওই সময় আমার ভাইয়ের সামনে শহীদের কথা হয় বাকি টাকা ইতালি পৌঁছানোর পরে পরিশোধ করতে হবে।”
ভাইয়ের যাত্রাপথের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “গত বছরের ১৭ নভেম্বর ইতালির উদ্দেশে বাড়ি ছাড়ে সাত্তার। প্রথমে ঢাকা থেকে দুবাইয়ে যায়। সেখানে কয়েক দিন থেকে সৌদি ও মিশর হয়ে ২১ ডিসেম্বর লিবিয়ায় যায়।”
লিবিয়ার আজদাবিয়া শহরের একটি বন্দিশালায় তার ভাইকে রাখা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “সেখানে গেম ঘরে (বন্দিশালা) জিম্মি রেখে ২৬ লাখ টাকা আদায় করে। আমার ভাইয়ের জীবনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ভিটেমাটি বিক্রি ও চড়া সুদে টাকা নিয়ে দালাল শহীদ শেখের কাছে টাকা দেই।”
“সর্বশেষ ২৩ জানুয়ারি তার স্ত্রী লাবনী খন্দকারের সঙ্গে কথা বলে। তখন সে জানায় ‘আজ আমাদের থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে নিবে’। তাড়াতাড়ি গেম দিবে (ভূমধ্যসাগর পার করে দিবে)।”
এর ২৮ তারিখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবিতে অনেক লোক মারা গেছে বলে জানতে পারেন তারা।
“তখন দালাল শহীদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে সে জানায় আমার ভাই সাত্তার খন্দকার ইতালী পৌঁছেছে। কিন্তু আমরা কোনোভাবে নিজেদের সান্ত্বনা দিতে পারছিলাম না।”
সেদিন রাতেই আবুল খায়েরের ভাগ্নী (বোনের মেয়ে) সুইটি সুলতানা লিবিয়ান একটা পেজের (লিবিয়া ইতালী গেম খবর পেজ) মাধ্যমে দুর্ঘটনার বিষয় জানতে পারেন।
পেজে দুর্ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আজদাবিয়া শহরের উপকূলের একজন ব্যবসায়ী কমেন্ট করেন। আইয়ূব শেখ নামের এ ব্যবসায়ীর বাড়ি বাংলাদেশের নরসিংদী জেলায়।
তখন সাত্তারের পরিবার ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি লিবিয়ার প্রশাসনের ভয়ে সব তথ্য জানতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে তিনি ওই উপকূলে দায়িত্বরত লিবিয়ার একজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন।
এ বিষয়ে আবুল খায়ের খন্দকার বলেন, “ওই কর্মকর্তা নৌ-দুর্ঘটনায় নিহতদের ছবি ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে আমাদের দেখায়। তার মধ্যে আমার ভাইয়ের ছবি দেখে আমরা নিশ্চিত হই আমার ভাই আর নেই।”
লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ জানুয়ারি সন্ধ্যায় দেশটির আজদাবিয়া শহরের উপকূল থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌযানে করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন একদল অভিবাসন প্রত্যাশী।
৫৬ জন আরোহী নিয়ে নৌযানটি ২৫ জানুয়ারি ভূমধ্যসাগরে ডুবে যায়। এরপর ২৮–৩১ জানুয়ারির মধ্যে ২৩টি লাশ সৈকতে ভেসে আসে।
গলিত লাশগুলোর পরিচয় নিশ্চিত না হওয়া গেলেও স্থানীয় সূত্রের বরাতে দূতাবাস বলছে, তাঁদের প্রায় সবাই বাংলাদেশি।
পরে বিভিন্নভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়, ওই নৌ-দুর্ঘটনায় শুধু সাত্তার খন্দকার নয়, একই গ্রামের মেহেদী হাসানের ছেলে আরাফসান আশিক (১৮) এবং একই ইউনিয়নের মোল্লাদী গ্রামের আব্দুল মজিদ শেখের ছেলে রফিকুল শেখও (২০) নিহত হয়েছেন।
আরাফসান আশিক তিন ভাই বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। ২০২৪ সালে ঢাকার ধামরাই জালশাহ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে এ বছর তিনি মাদারীপুরে রাজৈর ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন।
বৃহস্পতিবার তাদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়- দোচালা টিনের ঘরের সামনে একটি খুঁটির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আশিকের বাবা মেহেদী হাসান।
ছেলের শোকে কাঁদতে কাঁদতে এই ফার্নিচার ব্যবসায়ীর চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। ছেলের মৃত্যুর কথা শোনার পর থেকে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন মা খাদিজা বেগম। এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কারো সঙ্গে কথা না বলায় চার মাস বয়সী ছোট ভাইকে নিয়ে বিপাকে পড়েছেন বোন।
আশিকের বাবা জানান, তার ছেলের স্বপ্ন ছিল ইউরোপে গিয়ে অনেক টাকা আয় করবে। বাবার কষ্ট লাঘব করবে। বোনকে ধুমধাম করে ভালো পাত্রের হাতে তুলে দিবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। বরং সর্বস্ব খুইয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন তিনি।
তিনি আর জানান, ছেলেকে ইতালী নিয়ে যাওয়ার জন্য ওই ইউনিয়নের শ্রীচাদপুর গ্রামের লোকমান হাওলাদারের ছেলে বাবু হাওলাদারের (মুরগী বাবু) সঙ্গে ১৭ লাখ টাকায় চুক্তি হয়। এর মধ্যেই ১৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা পরিশোধও করেছেন।
মেহেদী হাসান বলেন, “আমার ছেলেকে নিয়ে অনেক আশা ভরসা ছিল। ওরা আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। দালাল বাবু বলেছিল, লিবিয়ার ত্রিপোলি থেকে গেম দিবে। সেখান থেকে ইতালি পৌঁছাতে মাত্র ৮ ঘণ্টা সময় লাগে।
“কিন্তু দালাল বেঈমানি করেছে। ত্রিপোলির পরিবর্তে আজদাবিয়া থেকে গেম দিছে। আজদাবিয়া থেকে সাগর দিয়ে ইতালি থেকে ৩-৪ দিন সময় লাগে। এটা জানলে আমার ছেলেকে পাঠাতাম না।”
ছেলে হারা এই বাবা আকুতি জানান, “আমার দাবি ছেলের লাশটা অন্তত ফেরত দিক। বাড়ির সামনে কবর দিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিব। আমি দালালদের উপযুক্ত শাস্তি চাই। আমার মত কোনো অভাগা পিতা যেন তার সন্তানকে অকালে না হারায়। ”
এ ঘটনায় নিহত অপর যুবক রফিকুল শেখ। তার বাড়ি ওই ইউনিয়নের মোল্লাদী গ্রামে। ওই গ্রামের আব্দুল মজিদ শেখের ছেলে রফিকুল।
কথা হয় তার বড় ভাই ফল ব্যবসায়ী ফিরোজ শেখের সঙ্গে।
তিনি বলেন, “আট মাসের মধ্যে বাবা, মা ও এক ভাইয়ের মৃত্যু শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আরও একটি শোক আমার জীবন থেকে সব কিছু কেড়ে নিয়েছে।”
কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমি কীভাবে বেঁচে থাকবো। এ দুনিয়ায় আমার আপন বলতে কেউ রইল না। বাবা, মা ও মেজ ভাই মারা যাওয়ার পরে সবার ছোট ভাইকে নিয়ে ব্যবসা করে ভালোই চলছিল। কিন্তু দালাল বাবু হাওলাদার ভাইটাকে ফুঁসলে নিয়ে হত্যা করলো “
তিনি বলেন, “আমি সব কিছু বিক্রি করে ভাইয়ের জন্য টাকা দিয়েছি। যাতে আমার ভাইটা একটু ভালো থাকে। সেও আমাকে ফাঁকি দিল। এখন আমি রাস্তার ফকির। আমি কাকে নিয়ে বাঁচবো?”
এসব বিষয় জানতে দালাল শহীদ শেখ ও বাবু হাওলাদারের বাড়িতে গিয়ে বাড়ি তালা বন্ধ পাওয়া যায়। এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায় এ ঘটনার পর থেকে পরিবারসহ তারা গা ঢাকা দিয়েছে । তাদের মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।
জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর গোপালগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ষষ্ঠীপদ রায় বলেন, “এমন ঘটনা বারবার ঘটছে। গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর ও মাদারীপুর জেলায় দালাল চক্রের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে।
“এ চক্রের তালিকাসহ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ নির্বাহী বিভাগের কাছে সুপারিশ করে প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। কিন্তু এ চক্রের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ”
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হলে দালালরা এ কাজ থেকে বিরত হবে আশা জানিয়ে তিনি বলেন, “দালালের খপ্পরে পড়ে অবৈধপথে ইতালি গমনকারীরা আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করে না। এমনকি আমাদের সাথে পরামর্শও করে না। তাই এমন ঘটনা ঘটছে।
“এটি প্রতিহত করতে দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি ইতালিগামীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।”
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, “প্রশিক্ষণ নিয়ে বৈধভাবে ইতালি, জাপান, কোরিয়া যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে সরকার। আমরা এ ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছি। অবৈধভাবে ইতালি যেতে নিরুৎসাহিত করছি।”