Published : 29 Aug 2024, 09:09 AM
কিছু বুঝে ওঠার আগে জলোচ্ছ্বাসের মতো গোঁ গোঁ করে স্রোত এসে ঘরবাড়ি তলিয়ে গেল, রাস্তাঘাটের কিনারা নেই, কে কোথাও আছে, বেঁচে আছে না মরে গেছে; তাও জানা নেই। চারদিক থই থই। যেন মৃত্যুর কুহু ডাক দিয়ে যাচ্ছে প্লাবিত প্রান্তরে। দিনরাত সাপ-ব্যাঙ, গরু-ছাগল আর মানুষ মিলে ‘সর্বপ্রাণ’ হয়ে মৃত্যুভয় জাগানিয়া ফেনীর বন্যার্ত জনপদের সন্তান হিসেবে শুধু পেশাগত দায়িত্ব পালনই তার কাছে যথেষ্ট মনে হয়নি।
হঠাৎ দানব হয়ে আসা হড়কা বানের দিনগুলোতে সাঁতার না জেনেও গলা পানি ভেঙে, ইট-পাথর, শামুক-ঝিনুক আর কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হওয়া পা টেনে টেনে কীভাবে যে আটকেপড়া মানুষের কাছে পৌঁছে গেছেন, কাঁধে-পিঠে করে তাদের উদ্ধার করেছেন, তা এখন ভাবলেই তার গা শিউরে ওঠে।
বিদ্যুৎ নেই, মোবাইল চলে না; চারটি রাতের সঙ্গে হাহাকার ও আর্তি মিলে দিনগুলোও যেন ঘোর বিপদের সংকেত বাজিয়ে গেছে তাদের জীবনে। তবু থেমে থাকা হয়নি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেনী প্রতিনিধি নাজমুল হক শামীমের। নিজের সেই অভিজ্ঞতার কথা পাঠককে জানাচ্ছেন তিনি।
‘এমন অবর্ণনীয় দুর্ভোগ যেন জীবনে না আসে’
বন্যার ফেনী, ভয়াল ফেনী। এ যেন এক অচেনা জেলা, অচেনা সময়, অচেনা ঘটনা। কিছু বুঝে উঠার আগেই সব যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন হয় যোগাযোগ, রাত কাটে নির্ঘুম। দুর্গতদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠে চারপাশ।
২০ অগাস্ট, মঙ্গলবার রাতে আমার এক সহকর্মী নজির আহমদ রতন ফোনে বললেন, ‘শামীম, ফুলগাজীতে পানি তো বাড়ছে, কাল সকালে (২১ অগাস্ট) ফুলগাজী যাবে তুমি?’ আমি বললাম, ‘অবশ্যই যাবো।’
পরদিন মানে ২১ অগাস্ট ভোর সাড়ে ৬টায় মোটরসাইকেল নিয়ে ফুলগাজীর উদ্দেশে রওনা দিলাম। সহকর্মী নিউজ২৪ এর রতন ভাইয়ের সকালে লাইভ আছে। এজন্য ৭টার আগেই পৌঁছাতে হবে আমাদের। আমরা ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়কের ফুলগাজীর মুন্সীরহাট যাওয়ার আগেই সড়কে হাঁটু পরিমাণ পানিতে আটকে যাই। তখন আমরা বাইক নিয়ে আনন্দপুর এলাকায় দাঁড়িয়ে যাই।
ফুলগাজী থেকে আসা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে, ছবি তুলতে ও ফুটেজ নিতে নিতেই আমরা দেখতে থাকি হু হু করে পানি বাড়ছে। এ সময় মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলে আমরা স্থানীয় একটি একতলা বাড়িতে আশ্রয় নেই। তখনো ওই বাড়ির উঠোনে হাঁটু পানি ছিল। দুপুর ১২টা না বাজতেই ওই ঘরে পানি উঠতে শুরু করে।
একপর্যায়ে আমি ওই বাড়ির গৃহকর্তার কিছু ফার্নিচার দোতলার সিঁড়ির উপর তুলতে সহায়তা করি। সকালে নাস্তা না করে বের হওয়ায় আমরা বেলা ১১টার দিকে কিছু মুড়ি-চানাচুর, বিস্কুট খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করি।
দুপুর ২টার দিকে ঘরটি হাঁটু পানিতে ডুবে গেলে আমরা ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেই। আমাদের আরেক সহকর্মী আমাদের ছাতাটি নিয়ে যাওয়ায় অগ্যতা বৃষ্টিতে ভিজেই ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। তখন আমরা বুক সমান পানিতে।
ততক্ষণে সড়কের পাশে আমাদের বাইকটি পানিতে তলিয়ে যায়। আমরা কোনোরকম বাইকটি পানি থেকে খোঁজ করে ঠেলে ঠেলে এক কিলোমিটার সামনে নিয়ে যাই। একদিকে মুষলধারে বৃষ্টি, অপরদিকে কোমর পরিমাণ পানিতে হাঁটতে হচ্ছে আমাদের। আশপাশের মানুষজন শুধুই ঘর থেকে বেরিয়ে নিরাপদ আশ্রয় ছুটছেন।
আমরা আরো কিছুদূর এগিয়ে আনন্দপুর বাজারের একটা মসজিদে বাইকটি পার্কিং করে রাখি। পরে আমরা পাশের গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে গিয়ে পানিবন্দি মানুষের বক্তব্য সংগ্রহ করি। তখন ওই ঘরগুলো কোমর ও বুক পর্যন্ত পানিতে নিমজ্জিত।
আমরা তথ্য সংগ্রহ করে যখন আঞ্চলিক সড়কে উঠি তখন সড়কের পানি কোমর ছাড়িয়ে বুকের উপরে উঠে যায়। আমরা সিদ্ধান্ত নিই দ্রুত ফেনী ফিরতে হবে।
এ সময় বাসা থেকে আম্মু ফোন করে বলেন, “ফেনী শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানি উঠছে। তুই কোথায়?” আমি বলেছিলাম, “ফুলগাজীতে আছি- গলা পর্যন্ত পানিতে।” আম্মু বলেছিলেন, “তুই তো সাঁতার জানিস না! কেন বসে আছিস? তাড়াতাড়ি ফেনী চলে আয়।” আমি বলেছিলাম, “আসার চেষ্টা করছি, তবে দোয়া করিয়েন।”
এদিকে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আমাদের জানান, ফুলগাজী ও পরশুরামে বন্যা দুর্গতদের উদ্ধারের জন্য সেনাবাহিনীর ট্যাগবোট পাঠানো হচ্ছে। ফেনী-পরশুরাম পুরো সড়কটি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে প্রায় তিন কিলোমিটার হেঁটে আমরা কাজিরবাগ বাজারে আসি, তখন ঘড়ির কাঁটায় বিকাল ৫টা।
সেখানে সেনাবাহিনীর কিছু ট্যাগবোট কাজিরবাগ হয়ে আনন্দপুরের দিকে যাওয়া সেনাবাহিনীর ট্রাক থেকে নামানো হচ্ছিল।
ঝুম বৃষ্টির মধ্যে আমাদের হাঁটা চলমান ছিল। একপর্যায়ে আমরা কাজিরবাগ ইকো পার্কের সামনে এলে মাগরিবের আজান দিচ্ছিল। আমরা তখন কাজিরবাগ ইকোপার্কের সামনে একটি হোটেল খোলা পেয়ে নাস্তা করতে বসে পড়ি।
আমি ও আমার সহকর্মী ভেজা শরীরে ডিম ও পরোটা খেয়ে কিছুটা ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করি। পুরো ভেজা কাপড়ে মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে আমরা ফেনী ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠি। এর আগেই আমাদের অনেক সহকর্মী আমাদের ছেড়ে বিকালের মধ্যেই শহরে চলে যায়।
সন্ধ্যা ৭টা ছুঁয়ে বুক পরিমাণ পানি ঠেলে যখন সামনের দিকে এগোচ্ছি এমন সময় ফুলগাজীগামী সেনাবাহিনীর বোট বহনকারী একটি ট্রাক ও অপরদিকে ফুলগাজী থেকে ফেনী অভিমুখী স্বেচ্ছাসেবকদের উদ্ধারকাজে নিয়োজিত আরেকটি ট্রাক অতিক্রম করতে গিয়ে আমি সড়কের পাশে খাদে পড়ে যাই। প্রাণটা রক্ষা হয় কোনোমতে।
ডুবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার দুটো মোবাইল সেট, ওয়ালেট, চাবির গোছাসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ব্যাগটি পানিতে হারিয়ে ফেলি। প্রায় আধাঘণ্টা পর যখন ব্যাগটি উদ্ধার করি ততক্ষণে আমার সহকর্মী রতন ভাইকে আমি হারিয়ে ফেলি।
পানি মাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে যখন ফেনী ফিরি তখন শহরের কলাবাগান এলাকায় আমার বাসার সামনে হাঁটু পরিমাণ পানিতে তলিয়ে গেছে।
একদিকে বিদ্যুৎ নেই অপরদিকে বাসার টাংকিতে পানি নেই। গোসল করার জন্য নিরুপায় হয়ে বাসায় না ঢুকে আরও দুই কিলোমিটার হেঁটে রাজাঝির দিঘিতে যখন গোসল করি; তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত ১০টা।
একপর্যায়ে ক্লান্ত শরীরে আবার পানি মাড়িয়ে বাসায় না ফিরে অফিসে রাত যাপন করার সিদ্ধান্ত নেই।
অফিসে যখন চেয়ারে হেলান দিয়ে বসি তখন মোবাইলে নেই ফ্রিকোয়েন্সি, যাচ্ছে না কোথাও কল, পাওয়া যাচ্ছে না ইন্টারনেট সংযোগ। আমি আর বাসার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না।
দীর্ঘ ২০ কিলোমিটারের বেশি পথ হাঁটায় ক্লান্ত শরীরে রাতে কিছু না খেয়েই সেই চেয়ারে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়ি।
বৃহস্পতিবার ভোরে ঘুম ভাঙতেই দেখি পুরো শহরে কোথাও কোমর কোথাও বুক পর্যন্ত পানি। দ্রুত বাসায় ছুটে গিয়ে দেখি আমার ঘরের একতলা পুরো ডুবে গেছে। ততক্ষণে আম্মুসহ ঘরের সকলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
শুরু হয় এক নতুন যুদ্ধ। যে যুদ্ধের জন্য আমি, আমার পরিবার, আমার এলাকা, আমার জেলা কখনোই প্রস্তুত ছিল না।
এদিকে কারো সঙ্গে যোগাযোগও করা যাচ্ছিল না। কোন স্বজন কোথায় আছে, তাদের ঘর কতটুকু ডুবেছে, কোন সহকর্মী কোথায় আছে, কার বাসায় কতটুকু পানি উঠেছে, কোন উপজেলায় কতটুকু পানিতে নিমজ্জিত, কে নিখোঁজ কারো খোঁজই কেউ নিতে পারছিল না।
এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার বিকাল থেকেই ত্রাণ তৎপরতায় নিয়োজিত হয়ে যাই। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে স্বজনদের খোঁজে ছুটে বেড়াই এই এলাকা থেকে ওই এলাকা। কারো খোঁজ মেলে তো কারো খোঁজ মেলে না।
শহরের প্রধান প্রধান সড়কে ততক্ষণে চলতে শুরু করে নৌকা, স্পিডবোট। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে এই প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে চলি মানুষদের উদ্ধারে ও ত্রাণ তৎপরতায়।
একদিকে ঘরে খাওয়ার পানি নেই, অন্যদিকে নেই পয়োনিষ্কাশনের পানি। অপরদিকে স্বজনদের বন্ধু-বান্ধবদের পরিবারের জীবন রক্ষায় ছুটে বেড়াতে থাকি। এভাবেই চলে আসে ২৩ অগাস্ট, শুক্রবার।
সীমান্তবর্তী পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর ও সোনাগাজী এবং দাগনভূঞা উপজেলায় অন্তত ১০ লাখ লোক পানিবন্দি হয়ে পড়ে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিখোঁজদের সন্ধানে বাড়তে থাকে তালিকা।
ত্রাণ তৎপরতায় সারা দেশ থেকে ছুটে আসে শতশত স্বেচ্ছাসেবক ও ত্রাণবাহী বিপুল সংখ্যক গাড়ি। উদ্ধার অভিযানে আকাশপথে যোগ দেয় সেনাবাহিনী ও বিভিন্ন বাহিনীর একাধিক হেলিকপ্টার।
২৪ অগাস্ট, শনিবার সকাল থেকে শহরের বিভিন্ন স্থানে ধীরগতিতে কমতে থাকে পানি। তখনো চারদিন ধরে ছিল না বিদ্যুৎ, ছিল না মোবাইল সংযোগ কিংবা ইন্টারনেট সংযোগ। দূরদূরান্ত থেকে স্বজনরা খোঁজ নিতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
জেলার সাড়ে ছয় শতাধিক মোবাইল টাওয়ারে বিদ্যুৎ না থাকায় শুধুমাত্র বাংলালিংকের কিছু সিম সংযোগ পেলেও পরিপূর্ণ ক্লিয়ার কথা বলতে পারা যাচ্ছিল না।
এরই মধ্যে ঢাকার কিছু গণমাধ্যমকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক মিলে আমরা ছুটে চলি ত্রাণ তৎপরতায়।
এদিকে টানা চারদিন প্রতিদিন ১৫/১৬ ঘণ্টা করে পানিতে ডুবে কাজ করতে গিয়ে আমার পায়ের দশ আঙুল ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ে। পায়ের পাতায় ও হাঁটুতে ব্যাপক আঘাত পাওয়ায় গায়ে জ্বর চলে আসে। জ্বর নিয়ে ২৪ ও ২৫ অগাস্ট শনিবার-রোববার বানভাসি মানুষের জন্য আমার ছুটে চলা অব্যাহত থাকে। এর মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন আম্মু।
২৫ অগাস্ট, রোববার রাত থেকে শহরের কিছু কিছু জায়গায় বিদ্যুৎ সংযোগ এলে মোবাইল চার্জ দেওয়া সম্ভব হয়। অসুস্থ শরীর নিয়ে সোমবার থেকে সংবাদ সংগ্রহে নিরন্তর ছুটে চলা শুরু হয় ।
২১ অগাস্ট থেকে ২৫ অগাস্ট এ পাঁচ দিন ছিল এক বিভীষিকাময় সময়। প্রতিটি রাত কেটেছে ঘরের বাহিরে। কখনও অফিস তো, কখনও মসজিদে।
এই সময়টিতে কোথাও জীবন বাঁচানোর আকুতি, কারো স্বজন হারানোর কান্না, কখনও ক্ষুধার্ত মানুষের আর্তনাদ, কিংবা ভেলায় ভেসে থাকা লাশ দেখে মনকে করেছিলাম পাথর।
নিজেকে দিয়েছি সান্ত্বনা। অন্তত সেসব মানুষ থেকেও আমি, আমার পরিবার, স্বজন, আমার সহকর্মী ও বন্ধুরা অন্তত কিছুটা তো ভালো থাকতে পেরেছি।
জেলাজুড়ে হাজার হাজার কোটি টাকার পণ্য ও সম্পদের ক্ষতির পাশাপাশি হয়তো স্বজন হারিয়েছে অর্ধশত পরিবার। এখন (২৭ অগাস্ট) পর্যন্ত বহু গ্রাম ডুবে আছে পানিতে, সরকারি-বেসরকারিভাবে চলছে ত্রাণ তৎপরতা।
তবে আমি বা আমরা আর কেউই চাই না এমন অবর্ণনীয় দুর্ভোগ যেন ভবিষ্যতে আমাদের জীবনে নেমে আসে। রেমিটেন্স জেলা হিসেবে খ্যাত ফেনী আবার ঘুরে দাঁড়াতে সংগ্রাম করতে থাকবে নিরন্তর।