Published : 21 Dec 2022, 10:47 AM
বিশাল মিশ্র ফলের বাগানে গাছে গাছে ঝুলছে থোকায় থোকায় কমলা। সবুজ গাছে ঝুলতে থাকা হলুদ টসটসে কমলার চুম্বকীয় আকর্ষণে অতিথিরা সেগুলো ছুয়ে দেখতে হাত বাড়িয়ে দেন। তখনই বাগান মালিকের অবাক ঘোষণা, “ছিড়ে খান, কমলা খাওয়া ফ্রি!”
এমন অভূতপূর্ব অনুভূতি মিলবে নাটোরের সদর উপজেলার হালসা এলাকার ড্রিম এগ্রো ফার্ম ও নার্সারিতে গেলেই। দুই বছরে ভালো ফলন পাওয়ায় বিক্রি না করে সবাইকে ফ্রিতে কমলা খাওয়াচ্ছেন এই নার্সারির মালিক ও তরুণ উদ্যোক্তা মো. আজিজুর রহমান।
নিজ চোখে গাছে বিভিন্ন রসালো ফল ঝুলে থাকার দৃশ্য, গাছের কমলা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখার আবেশ ও বাগানেই কমলার রস পরখ করে দেখতে প্রতিদিনই নাটোরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আজিজুরের বাগানে ভিড় জমান দর্শনার্থীরা।
বাগান দেখতে এসে কমলা ছিড়ে খেতে খেতে হাস্যোজ্জল মুখে নাটোর সদরের তোফিক আহমেদ রহমান বললেন, “পরিবার নিয়ে এসেছি। নিজে হাতে কমলা ছিড়ে খাওয়ার আনন্দ বলে বোঝাতে পারবো না।”
আরেক দর্শনার্থী হালসা আতিকুর রহমান মুকুল কমলা খেয়ে বললেন, “মিষ্টি একটু কম, তবে স্বাদটা দারুণ।”
গোল গোল কমলা থোকায় থোকায় ঝুলে থাকতে দেখে আর লোভ সামলাতে না পেরে কমলার দুটি চারা কিনে ফেললেন গুরুদাসপুরের খুবজীপুর এলাকার দর্শনার্থী মো. শাকিল আহমেদ।
তাদের মতো আরো কয়েকজন অতিথির সাথে কথা বললে তারাও হাসিমুখে কমলা বাগানে এসে তাদের ভালোলাগার অনুভূতি ব্যক্ত করেন।
গত বছর ফলন কম হলেও এবার খুব ভালো ফলন হয়েছে জানিয়ে কমলা চাষী আজিজুর রহমান বলেন, “প্রচুর কমলা ধরার পর আমার মনে হয়েছে আমি কমলা বিক্রি করব না। কারণ কমলার চারা লাগানোর সময় একমাত্র আমার বাবা ছাড়া অন্য কেউ আমাকে সাপোর্ট করেনি। বরং বলেছে, ছেলেটা পাগল হয়ে গেছে। বাবা-মায়ের টাকা নষ্ট করবে।
“আল্লাহর রহমতে কমলা আসার পর আমি সবাইকে দাওয়াত দেই- আপনারা আসেন বাগানে, কমলা খেয়ে যান।“
আজিজুজের ড্রিম এগ্রো ফার্ম ও নার্সারীতে নাগপুরি কমলা, চায়না থ্রি কমলা, দার্জেলিং কমলা, পাকিস্তানি কমলা, মিশরীয় মাল্টা, ইয়োলো কিং মাল্টা, ভিয়েতনামি মাল্টা, কাশমেরি কেন্যু, ইন্ডিয়ান মেন্ডারিনসহ নয়টি জাতের কমলা ও মাল্টা আছে। কমলা ও মাল্টার প্রায় ৩০০ চারা ভারত থেকে নিয়ে এসে বাগানে রোপন করেছেন তিনি।
আজিজুরের এই বাগানে শুধু কমলা নয় পেয়ারা, মাল্টা, লেবু, শরীফা, বরই. আমসহ আছে বাহারি সব ফুল। নানান ধরনের ফলের আশাতেই মিশ্র বাগানের পরিকল্পনা করেন তিনি।
দুই বছরে কমলা বাগানে সাথী ফসল হিসেবে লাগানো পেয়ারাই বিক্রি করেছেন দশ লাখ টাকার। আম, কচুর লতি, লেবুসহ বিভিন্ন ফলও তিনি বিক্রি শরু করেছেন। এছাড়া গাছের চারা তৈরি করেও বিক্রি করছেন তিনি।
তিনি বলেন, “আমি এক টাকারও কমলা-মাল্টা বিক্রি করিনি। করবোও না ইনশাআল্লাহ। দুই বছরের হয়তো তিন থেকে চার লাখ টাকার কমলা-মাল্টা বিক্রি করতে পারতাম। পাশে কচুর লতি আছে, সেখান থেকেও ভালো আয় হয়েছে, হচ্ছে।“
আজিজুর বলেন, “কমলা ফ্রি খাওয়াচ্ছি মানুষদের। পেয়ারা থেকে এবার ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা ঘরে তুলতে পারবো বলে আশা করছি। তবে, সামনে বছর যদি ভালো ফলন হয়, প্রতি বিঘায় কমলা বাগান থেকে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা আয় হবে।“
বাবার সহযোগিতায় ২০১৯ সালের শেষ দিকে ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগে ১০ বিঘা জমিতে মিশ্র বাগান শুরু করেন আজিজুর। দুই বছরে নার্সারি থেকে বিভিন্ন সাথী ফসল থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিক্রি হলেও বাগান পরিচর্যা, শ্রমিকদের বেতন, আনুষাঙ্গিক খরচ ও ব্যবসা বৃদ্ধির কারণে এখনো তেমন আয় ঘরে তুলতে পারেনি তিনি।
প্রতিদিন ছয় থেকে সাত জন লোক দৈনিক ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বেতনে বাগান পরিচর্যার কাজ করেন আজিজুরের নার্সারীতে।
বাগানে কাজের ফাঁকে শ্রমিক শমজান আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগাছা পরিস্কার, বাগান পরিচর্যাসহ নানা ধরণের কাজ করতে হয়। কমলা বাগানে কাজ করতে খুব ভালো লাগে, সংসারও ভালোভাবে চলে যায়।”
তরুণ উদ্যোক্তাদের বেকার না বসে থেকে বিভিন্ন ধরনের বাগান করার কথা বলেন আজিজুর রহমান। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের তরুণেরা যদি বসে না থেকে কৃষিতে আসে, সোনার এই দেশে নিশ্চিত কৃষি বিপ্লব হবে।“
আজিজুর রহমানকে একজন উদ্যমী কৃষক হিসেবে অবহিত করে নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, “আজিজুর রহমানের মিশ্র বাগানের পরিকল্পনা সত্যিই সাধুবাদ যোগ্য। ভোক্তারা এখন মাল্টি ফ্রুটস পেতে চায়। কমলার পাশাপাশি অন্য যে ফলগুলো আছে সেগুলোর ঠিকমতো পরিচর্যা করতে হবে।
“গাছ ঘন হলে কিছু সরিয়ে ফেলতে হবে। কোনো গাছে যদি টক কমলা হয়, সেটি কেটে ফেলতে হবে। উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে ফলের মানও ঠিক রাখতে হবে। আগে ফলের ব্যবসাটা প্রতিষ্ঠিত করে পরে চারা বিক্রিতে যাওয়াটা বেশি ভালো হবে।”
কৃষি বিভাগ থেকে সার্বিকভাবে আজিজুর রহমানকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান এই কৃষি কর্মকর্তা।