Published : 21 May 2025, 06:17 PM
চা দিবস আন্তর্জাতিকভাবে ২১ মে পালিত হলেও বাংলাদেশে দিবসটি পালিত হতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চা বোর্ডে যোগদানের তারিখ ৪ জুন। তবে দেশের নতুন প্রেক্ষাপটে এবারের চা দিবস আন্তর্জাতিক তারিখের সঙ্গে মিলে রেখেই পালিত হয়েছে।
তবে দিবস যাই হোক বাংলাদেশি চায়ের অতীত ঐতিহ্য ধরে রাখতে হলে চায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে কেসস্টাডির মাধ্যমে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ শ্রী গোবিন্দ্রপুর চা বাগানের মালিক ও ন্যাশনাল টি কোম্পানির পরিচালক মহসীন মিয়া মধু বলেছেন, চায়ের এখন মহাদুর্যোগ চলছে। যেখানে চায়ের উৎপাদন ব্যয় ২২০ টাকার ওপর সেখানে অনেক বাগানের চা বিক্রি হয় ২০০ টাকার অনেক নিচে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়বে এ শিল্প।
তিনি বলেন, বিগত ৭ বছর চায়ের মূল্য বাড়েনি। অথচ চায়ের উৎপাদন ব্যয় কতগুণ বেড়েছে। এর ভিতরে বেড়েছে বিদ্যুতের দাম, মেশিনারির দাম, সারের দাম, চাল ও আটার দাম, বেড়েছে শ্রমিকের মজুরি। এই অবস্থায় পড়ে অনেক বাগান বন্ধের পথে। তবে অবস্থার উন্নতি করতে হলে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ।
তিনি বলেন, এই শিল্পকে বাঁচাতে হলে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। যেভাবেই হোক উৎপাদন ব্যয় কমাতে হবে। বাগানগুলোকে লাভজনক অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে।
তিনি বলেন, কিছু কিছু বাগান হয়তো অতিরিক্ত পুঁজি দিয়ে বাগানকে আধুনিকীকরণ করে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন ধরে রেখেছেন। কিন্তু সব বাগানের পক্ষে তা সম্ভব নয়। এই জন্য অভিজ্ঞদের দিয়ে গবেষণা করে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।
“শেষ কথা উৎপাদন হেক্টর প্রতি ৩ হাজার কেজির উপরে নিয়ে যেতে হবে। তাহলে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি থেকে শুরু করে তাদের যৌক্তিক দাবিগুলোও পূরণ করা যাবে। তেমনি দেশের অর্থনীতির চাকাও গতিশীল হবে।”
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ চা গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আব্দুল আজিজ বলেন, চায়ের উৎপাদন ব্যয় কমানোর জন্য প্রয়োজন হেক্টর প্রতি উৎপাদন বাড়ানো। এ জন্য প্রয়োজন আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, বিদ্যুতের সাশ্রয় ও ৫০-৬০ বছরের পুরাতন গাছ তুলে সেখানে বর্ধিত উৎপাদনের ক্লোন চা চারা সৃজন করা।
বিশেষ করে পুরোনো চাষাবাদ পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন আনা জরুরি বলে জানান এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
আর বাংলাদেশ চা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ইসমাইল হোসেন বলেন, চা উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকারের নীতিগত পরিবর্তন এনে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং জ্বালানি মূল্য হ্রাস করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চায়ের প্রচারের ব্যাপারে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
এ ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের হাইকমিশনগুলোর মাধ্যমে ‘বাংলাদেশি চা এক্সপো’ জাতীয় কিছু করা যেতে পারে।
শ্রীমঙ্গল জেরিন চা বাগানের মহাব্যবস্থাপক সিনিয়র টি-প্লান্টার সেলিম রেজা বলেন, বাংলাদেশে এখন চায়ের গড় উৎপাদন হেক্টর প্রতি প্রায় ১ হাজার ৮০০ কেজি। অথচ উন্নত রাষ্ট্রে তা তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার কেজি। এটা বাড়াতে হবে।
“পাশাপাশি সম্প্রতি নতুন সৃজিত ক্ষুদ্র অনেক চা বাগানে মানহীন চা তৈরি করছে। তাদের চায়ের মূল্য কেজি প্রতি ১০০ টাকার নিচে। এতে গুণগত মানের চা উৎপাদন করে অনেকের চা পড়ে থাকে গুদামে। বিষয়গুলো অবশ্যই নজরে আনা জরুরি।”
বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের পরিচালক রফিকুল হক বলেন, “বাংলাদেশে এখন চা বাগানের সংখ্যা ১৭০টি। প্রত্যেকটি চা বাগানকেই গুণগত মানের চা চাষের জন্য কড়া বার্তা দিয়েছেন চা বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন। তিনি গুণগত চায়ের জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করেছেন।”
এই অবস্থায় বাংলাদেশ চা বোর্ড এ শিল্পের উন্নয়নে নিয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ। চলেছে বাস্তবায়ন।
চা বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন বলেন, চায়ের ক্রান্তিকালকে কাটিয়ে ওঠাকে তিনি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন।
তিনি বলেন, চায়ের রপ্তানি বাড়াতে হলে চায়ের গুণগতমান বাড়াতে হবে। রপ্তানি বাড়লে দেশে চা মজুদ থাকবে কম এবং মালিকরা দামও পাবেন বেশি। তাই এখন রপ্তানিযোগ্য করেই চা তৈরি করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ২০২৩ সালে ১২টি দেশে ১০ দশমিক ৪ মিলিয়ন কেজি চা রপ্তানি করা হয়েছিল। আর ২০২৪ সালে আমরা তা দ্বিগুণে নিয়ে যেতে পেরেছি। গত বছর ১৯টি দেশে চা রপ্তানি হয়েছে ২ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন কেজি। তবে এটিও যথেষ্ট নয়। এর পরিমাণ আরও অনেকগুণ বাড়াতে হবে।
এ ক্ষেত্রে চায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে যার যার সেক্টর থেকে কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি।