Published : 02 Dec 2024, 09:04 PM
আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের ফায়দা লুটতে কখনো ধর্ম, কখনো জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করেছে বলে মন্তব্য করেছেন জেএসএস নেতা ও আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য কে এস মং মারমা।
তিনি বলেছেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক সমস্যা রয়েছে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার ফায়দা লুটার জন্য কখনো ধর্মকে ব্যবহার করেছে, কখনো জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করেছে। ধর্মের অহমিকা থেকে বাংলাদেশকে পরিচালিত করেছে। একদিকে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা রেখেছে; অন্যদিকে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করেছে।”
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সোমবার বান্দরবান শহরে রাজার মাঠে এক গণসমাবেশে তিনি এসব কথা বলেন।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পাহাড়ের সংঘাত থামাতে জেএসএসের সঙ্গে চুক্তি করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। যার মধ্য দিয়ে পাহাড়ে তিন দশক ধরে চলা সহিংসতার অবসান ঘটে। এই চুক্তির অনেকগুলো ধারা ছিল। যার কিছু তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়; বাকিগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছিল। যদিও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অভিযোগ, সেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি।
বিগত সরকারের সমালোচনা করে কে এস মং বলেন, “স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এতটা দুর্গন্ধ ছড়াবে, এতটা পচে যাবে- এটা আমরা কেউ কল্পনা করিনি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অন্তর্বর্তী সরকারকেও সমলোচনা করব, আবার সহযোগিতাও করব। অনেক রক্ত ও প্রাণের বিনিময়ে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারকে বিফল হতে দেওয়া যাবে না।
“গণঅভ্যুত্থানের পর প্রতিবিপ্লব হতে পারে। ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসররা এখনও বহাল তবিয়তে আছে। তৎকালীন আওয়ামী লীগের কথায় পুলিশ চলত, সেনাবাহিনী চলত, আদালত চলত। জেএসএস নেতাকর্মীদের হত্যা করা হয়েছে। কোনো মামলা পর্যন্ত হয়নি। বিভিন্ন সময় উল্টো জেএসএস নেতাকর্মীদের মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। এসব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।”
তিনি বলেন, “অথচ টাকা পাচারকারী ও দুর্নীতিবাজ ভূমি খেকোদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত মামলা হয়নি। যে মামলা হয়েছে সেটা মুরগি চোর, গরু চোর ধরনের মামলা।”
পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সমস্যা মূল মন্তব্য করে কে এস মং বলেন, “৪০ বছর আগে হর্টিকালচার ও রাবার চাষের নামে এক লাখ একরের বেশি জমি লিজ দেওয়া হয়েছে। এসব লিজের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এগুলো আর কোনো অবস্থাতেই নবায়ন করা যাবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে যতগুলো অবৈধ লিজ আছে সেগুলো বাতিল করতে হবে।”
সমাবেশে আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য সাধুরাম ত্রিপুরা মিল্টন বলেন, “বাংলাদেশের মানুষ এখনো নানাভাবে পরাধীন। অর্থনৈতিকভাবে ও রাজনৈতিকভাবে পরাধীন রয়েছে। কেবল পাহাড়ি মানুষ হিসেবে নয়, দেশের জনগণও নানাভাবে বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হয়ে আছে। এর থেকে মুক্তির জন্য মানুষ লড়াই করে যাচ্ছে। জনসংহতি সমিতি ২৭ বছর ধরে সেই মুক্তির জন্য পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছে।
“এই চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন করতে গিয়ে জেএসএস কর্মীরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। কর্মীরা নেতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। দীর্ঘ বছর ধরে কোনো নেতাকর্মী এলাকায় থাকতে পারেননি। তাদের নামে বিভিন্ন মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে।”
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন বলেন, “বাংলাদেশের সব মানুষের আশা ছিল, পার্বত্য চুক্তির মধ্যে দিয়ে সারাবিশ্বে একটা দৃষ্টান্ত হবে। বহু ভাষার ও বহু জাতিসত্ত্বার মানুষ এখানে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করবে। কিন্ত ২৭ বছর ধরে নানাভাবে, নানা মাত্রায় প্রতারণা করে গেছে রাষ্ট্রযন্ত্র। পাহাড়ে মানুষকে ও গণতান্ত্রিক জনগণকে বলতে হচ্ছে, শান্তি চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চাই। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার যেন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করে।
“এখনো পাহাড়ে মানুষকে নিজেদের ভূমিতে টিকে থাকার সংগ্রাম করতে হচ্ছে। জনসংহতি সমিতিকে সবাইকে নিয়ে ২৪ বছর ধরে সশস্ত্র লড়াই করতে হয়েছে। আন্দোলন করতে হয়েছে জাতিগত অধিকারে জন্য, স্বায়ত্তশাসনের জন্য ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য। ২৭ বছর ধরে মনে হয়, রাষ্ট্রযন্ত্র এটা ধরে নিয়েছে যে প্রতারণা করতে হবে।”
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের জেলা কমিটির সভাপতি উলিসিং মারমা বলেন, “চুক্তির ধারা অনুযায়ী এখনো জেলা পরিষদ নির্বাচন করা হয়নি। ভূমি কমিশনকে কার্যকর করা হয়নি। পার্বত্য চুক্তি হয়েছে সরকার ও পার্বত্য অঞ্চলে মানুষের সঙ্গে। যে সরকার আসুক, চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে।”
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৭তম বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক সুমন মারমার সভাপতিত্বে সমাবেশে আরো বক্তব্য দেন আঞ্চলিক পরিষদের নারী সদস্য মিঞোচিং মারমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের জেলা কমিটির সহসভাপতি উশৈহ্লা মারমা এবং মংনু মারমা।
আলোচনা সভা শেষে রাজার মাঠ থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ঘুরে আবার রাজার মাঠে গিয়ে শেষ হয় মিছিলটি।
সমাবেশে আসা জেএসএস নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, প্রায় আট বছর প্রকাশ্যে কোনো সভা-সমাবেশ করতে পারেননি তারা। তাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে এলাকাছাড়া করেছিল বিগত সরকার।
সমাবেশে সাত উপজেলা থেকে বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী যোগদান করেন। তার মধ্যে বেশিরভাগ কর্মী-সমর্থক এসেছেন সদর ও রোয়াংছড়ি উপজেলা থেকে।
সেনা রিজিয়ন ও জেলা পরিষদের আয়োজন
এদিকে বান্দরবান সেনা রিজিয়নের সহযোগিতায় ও বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের আয়োজনে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইন্সটিটিউটের প্রাঙ্গণে শান্তি পায়রা উড়িয়ে, কেক কেটে আলোচনা সভা করে দিবসটি পালন করা হয়।
বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক থানজামা লুসাইয়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বান্দরবান সেনা রিজিয়নের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মেহেদী হাসান।
এ সময় জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ, পুলিশ সুপার শহিদুল্লাহ কাওছার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এস এম মঞ্জুরুল হক, জেলা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট মাধবী মারমা বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
কেক কাটা শেষে পার্বত্য শান্তি চুক্তি নিয়ে আয়োজন করা হয় আলোচনা সভার। এর আগে বান্দরবান সদর হাসপাতালে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচিরর আয়োজন করে পার্বত্য জেলা পরিষদ।