Published : 14 Feb 2024, 12:31 PM
চারদিকে শিমুল ফুল থেকে থেকে দোল খাচ্ছে বসন্তের পাগলা হাওয়ায়; সে মায়ায় চোখ না জুড়াতেই ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসা মনোমুগ্ধকর কোকিলের কুহুতান জানান দিচ্ছে বসন্ত এসে গেছে।
স্নিগ্ধ বাতাসে হালকা ঠাণ্ডার অনুভূতি, একপাশে পাহাড় আর মাঝখানে জাদুকাটা নদীর ঢেউ। অন্যদিকে নতুন গজানো সবুজ পাতায় যেন ফাগুনের আগুন ধরেছে সুনামগঞ্জের হাজি জয়নাল আবেদিন শিমুল বাগানে।
প্রায় দুই হাজার গাছের শিমুল বাগানটির অবস্থান তাহিরপুর উপজেলার সীমান্তগ্রাম মানিগাঁওয়ে বিস্তীর্ণ বালুপ্রান্তর ঘেরা প্রকৃতিসুন্দর স্থানে। প্রতি বছরের মতো এবারও ভালোবাসা দিবস আর ফাল্গুন উদযাপন করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এসেছেন এ শিমুল বাগানে।
বুধবার সকাল থেকেই দর্শনার্থীদের পদচারণার আরও রঙিন হয়ে ওঠে শিমুল বাগান। যাদুকাটা পাড়ে শিমুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় মানুষ; শত শত শিমুলও দোল খেয়ে বাসন্তী অভিবাদন জানায় তাদের। বসন্তরাঙা ভালোবাসার দিনের প্রিয় মানুষের হাতে হাত রেখে মনের অজান্তেই অনেকে গুনগুনিয়ে ওঠেন প্রেমের গান।
অনেকে আবার প্রাণ খুলে গলায় ধরেন এই অঞ্চলের বাউল মহাজন শাহ আবদুল করিমের গান ‘বসন্ত বাতাসে সইগো...’।
এই শিমুল বাগান তৈরির গল্পে বাগানের স্বত্ত্বাধিকারী রাকাব উদ্দিন জানান, দুই যুগেরও বেশি আগে তাহিরপুর উপজেলার সোহালা গ্রামের শিক্ষানুরাগী ও বৃক্ষপ্রেমি জয়নাল আবেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে মানিগাঁওয়ের যাদুকাটা নদীর দক্ষিণে বিস্তীর্ণ বালুময় প্রান্তরে দুটি শিমুল গাছ দেখেন। বালু ফুঁড়ে যেন বেড়িয়ে এসেছে নয়নাভিরাম স্বর্গীয় বৃক্ষ। ন্যাড়া মাথায় শিমুলের ফুল বসন্তের পাগলা হাওয়ায় দুলছে। আর ডালে লেজ দোলাচ্ছে পাখি।
এই দৃশ্য দেখে বৃক্ষপ্রেমি জয়নাল মনস্থির করেন, পুরোটা জায়গা কিনে শিমুল বাগান করবেন। যেই ভাবনা, সেই কাজ। তিনি প্রায় ৩৩ একর জায়গা কিনে পরিচিত উদ্ভিদ বিশারদ কয়েজনের পরামর্শ নিয়ে সংগ্রহ করেন শিমুল গাছের চারা। সারি সারি গর্ত খুঁড়ে শুরু হয় তার শিমুল গাছ লাগানোর কর্মযজ্ঞ।
বালুময় প্রান্তরে লাগিয়ে দেন দুর্বাঘাস। নাওয়া-খাওয়া ভুলে রাতদিন বাগানের তদারকি শুরু করেন। তার পুরোটা সময়ই কাটতো বাগান ঘিরে। পুরো জায়গায় গাছ লাগানো শেষ হলে সারি সারি শিমুল গাছ দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যায় তার। বৃক্ষগুলোতে বাঁচিয়ে রাখতে দুর্গম মরুময় প্রান্তরে পানি, গোবর সংগ্রহ করতে শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করেন। পরামর্শ নেন কিভাবে গাছগুলো বাঁচিয়ে রাখা যায়। এক বছর পরই গাছের ডালপালায় ছাতার মতো ছায়াময় হয়ে ওঠে পুরো বাগান।
ধিরে ধিরে গাছগুলো বড় হতে থাকলে, প্রাণ জুড়ায় জয়নাল আবেদিনের। অদ্ভুত ভালো লাগায় ভরে ওঠে তার মন। প্রতিদিন ঘুম ভাঙতেই বাড়ি থেকে বাগানে ছুটে আসতেন।
রাকাব জানান, ২০০৬ সালে ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় জয়নাল প্রাণ হারান। এর মধ্যে শিমুল গাছগুলো বড় হয়ে গেছে। তার শখের বাগানে ফাল্গুনে হাজার হাজার মানুষ শিমুলের সৌন্দর্য উপভোগ করছে, এই দৃশ্য দেখে যেতে পারেন নাই। অথচ এটা দেখার জন্যই তিনি এই বাগান করেছিলেন।
২০১১-২০১২ সালের দিকে শিমুল বাগানে ফুল ফুটতে শুরু করে বলে জানান বাগানের আরেক স্বত্ত্বাধিকারী আফতাব উদ্দিন। বলেন, “দুর্গম যোগাযোগহীন অজপাড়াগাঁয়ে বসন্ত রঙে আগুন হয়ে ওঠে বাগানটি। পত্রহীন ন্যাড়ামাথার ডালগুলোতে শুধুই লাল শিমুলের বিস্তার। কিন্তু যোগাযোগ বিড়ম্বমনার কারণে প্রকৃতিপ্রেমি বা ভ্রমণার্থীরা এসে দুর্ভোগে পড়েন।”
“২০১৩-২০১৪ সালের দিকে জাতীয় ও স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে শিমুল বাগান নিয়ে প্রতিবেদন হয়। পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ বাগানের খবর ছড়িয়ে পড়লে বিদেশের প্রকৃতি প্রেমিদের নজর কাড়ে। তারাও পরিবার নিয়ে ছুটে আসেন বসন্তকালে, ভালোবাসার দিনে হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করেন।”
এ বছর জেলা শিল্পকলা একাডেমি তাদের সঙ্গে কথা বলে শিমুল বাগানে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করেছে বলে জানান রাকাব।
বসন্ত উৎসবের জন্য হলুদ আভায় তৈরি করা হয়েছে আকর্ষণীয় মঞ্চ। এই মঞ্চে বসন্ত বরণের গান, নাচ, কবিতা আবৃত্তি ও আলোচনাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হবে। উন্মুক্ত এ অনুষ্ঠানটি দেখতে ইতোমধ্যে সংস্কৃতি অনুরাগী ও দর্শনার্থীরা ভিড় করেছেন।
এছাড়া ভ্রমণার্থীদের আনন্দ দিতে ব্যক্তি উদ্যোগে বাগানে ঘোড়া ও সাইকেল চড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে; রয়েছে নাগরদোলাও। অনেকে ক্যাম্প করে রাতেও অবস্থান করেছেন বাগানে।
সুনামগঞ্জ জেলার কালচারাল অফিসার আহমেদ মঞ্জরুল হক চৌধুরী পাভেল বলেন, “শিমুল বাগানের বসন্ত উৎসব উপভোগ করতে সারাদেশ থেকে লোকজন ছুটে এসেছেন। আমরা এই অঞ্চলের মহাজনদের বিভিন্ন সৃষ্টি পরিবেশনা করব। নাচ, কবিতা ও গানে গানে বসন্তকে স্বাগত জানাতে আমরা প্রস্তুত।”