Published : 15 Feb 2023, 08:58 AM
কেউ এসেছেন কোনো নিকটাত্মীয় বেঁচে না থাকায়, কয়েকজনকে রেখে গেছেন প্রতিষ্ঠিত সন্তানরাই, আবার কেউ বা সন্তানের সংসারে অশান্তি এড়াতে নিজেই এখানে চলে এসছেন। তবে এই ‘স্নিগ্ধা আশ্রমে’ এসে তারা খুঁজে পেয়েছেন মমতার আশ্রয়।
শেরপুর সদর উপজেলার চরমোচারিয়া ইউনিয়নের নিভৃত নলবাইদ গ্রামের এই স্নিগ্ধা আশ্রমে বর্তমানে ঠাঁই পেয়েছেন আট জন বৃদ্ধা, পাঁচ জন বৃদ্ধ আর এক পথশিশু।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এই আশ্রমে আশ্রয় পাওয়াদের সেবা ও তদারকির দায়িত্বে থাকা ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম মানিক জানান, ২০১৯ সালে সাড়ে তিন একর জমিতে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছেন এলজিইডির সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম আকন্দ। স্ত্রী ‘স্নিগ্ধা’র পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমিতে তার নামে মনোরম ও নির্মল পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত এই আশ্রমে নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা থাকার ব্যবস্থা আছে।
প্রকৌশলী শফিকুল তার স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় থাকেন। তাদের দুই ছেলে-মেয়ে কানাডায় থেকে পড়াশোনা করছেন।
ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম মানিক বলেন, “পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি আশ্রমের বাসিন্দাদের যখন যার যেটা প্রয়োজন কাপড়-চোপড় থেকে শুরু করে ওষুধ পথ্যাদি সবকিছুরই ব্যয়ভার আশ্রমের মালিক বহন করছেন। আর আমি যার যেটা যখন প্রয়োজন সেটা সরবরাহ করে এই আশ্রম পরিচালনা করছি।
“ম্যানেজার হিসেবে সবাইকে সুস্থ রাখার জন্য চেষ্টা করছি। প্রতিদিনের খাওয়ার রুটিন হচ্ছে সপ্তাহে মাংস দুইদিন, তিনদিন মাছ, বাকি দুইদিন ডিম আর সবজি। এ ছাড়া প্রতিদিন রাতে সবার জন্য খামারের গাভীর টাটকা দুধ বরাদ্দ আছে।”
তিনি জানান, আশ্রমের রান্না-বান্নার দায়িত্বে থাকা নারী দুই সন্তান নিয়ে এখানেই থাকেন, খাওয়া দাওয়া করেন। আরেকজন নারী পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন। আরও দুজন ছেলে কর্মী আছেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পুরুষদের সেবার জন্য।
আশ্রম চত্বরে থাকা সবজি ক্ষেত ও গরুর খামার দেখাশোনার জন্য লোক নিয়োগ দেওয়া আছে। এরা সবাই বেতনভুক্ত। এ ছাড়া মাঝে মধ্যে বাইরে থেকে অতিরিক্ত লোক নিয়ে আশ্রম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়।
আশ্রমের ভেতরে কবুতরের খামার আছে এবং কিছু দেশি মুরগিও পালন করা হয়। এই চত্বরে সব মৌসুমের নানা ধরনের সবজি উৎপাদন করে খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আশ্রমের চারপাশে আম, কাঠাঁল, কলাসহ বিভিন্ন মৌসুমে যে ফল পাওয়া যায়, তা আশ্রমে থাকা আশ্রিতরাই খেতে পান।
শেরপুরের এই স্নিগ্ধা আশ্রমের সর্বকনিষ্ঠ বাসিন্দা বাবা-মার পরিচয়হীন ১২ বছরের পথশিশু সাব্বিরকে ঢাকার ‘পারী ফাউন্ডেশন’ এক বছর আগে এখানে রেখে যায়। সে এখন স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে।
এখানে আশ্রিতদের অনেকের সন্তানেরা প্রতিষ্ঠিত ও বিত্তের মালিক হলেও বাবা-মায়ের খোঁজখবর নেন না। তবে তা নিয়ে এই বৃদ্ধদের মনের কোণে লুকানো কষ্ট থাকলেও সন্তানদের বিরুদ্ধে তাদের কোনো অভিযোগ নেই।
শেরপুর শহরের সজবরখিলা এলাকার বাসিন্দা এক সময়ের বিড়ি শ্রমিক এবং পরবর্তীতে নানা কাজের সঙ্গে জড়িত থাকা ৯০ বছরের বৃদ্ধ নিপু আহমেদ জানান, ছেলেরা তাকে এই আশ্রমে রেখে গেছে। প্রায় আট মাস ধরে তিনি এখানে আছেন।
তার স্ত্রী মারা গেছেন। তিন ছেলে ও এক মেয়ে, সবাই বিবাহিত। ছেলেরা ব্যবসা করে। নাতি ও নাতনি রয়েছে। কিন্তু এখন তার সেবা করার কেউ নেই।
“আমার বাসা ছিল। ছেলে তা বিক্রি করে দিয়ে শ্বশুরবাড়িতে থাকে। এতে আমি দুঃখিত নই।”
১৯৭৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ পাশ করা ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার বাসিন্দা ৭২ বছর বয়সের বৃদ্ধ মোকাররম হোসেন প্রায় তিন বছর ধরে এই আশ্রমে আছেন।
তিনি জানান, ১৯৮২ সালে সৌদি আরবে গিয়ে ২০১২ সালে ফিরে আসেন। মুক্তাগাছায় স্ত্রীর জমিতে বাড়ি বানিয়েছিলেন। তার স্ত্রী একজন পশু ডাক্তার। আগে জামালপুর ছিলেন। এখন কোথায় আছেন বলতে পারেন না। ছেলে ও ছেলের বউ ডাক্তার। ঢাকায় একটি প্রাইভেট হাসপাতালে কর্মরত। কিন্তু তারা কেউ তার কোনো খোঁজ-খবর নেয় না।
“ছেলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি, মনে হয় আমার মোবাইল নাম্বারটা ব্ল্যাকলিস্ট করেছে। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখে স্নিগ্ধা আশ্রমে এসে আশ্রয় নিয়েছি।
“আমি খুব সুখী ছিলাম। দুঃখটা মনে হয় আল্লাহ্ দিয়ে রেখেছেন। এ ছাড়া আমি কিছুই জানি না।”
শেরপুর শহরের বটতলা গোপালবাড়ির বাসিন্দা ৬২ বছরের একরামের স্ত্রী মারা গেছেন, দুই ছেলে আছে। কিন্তু অসুস্থ অবস্থায় তার সেবা করার কেউ না থাকায় দেড় বছর ধরে এখানে আছেন।
কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী গ্রামের ৭০ বছরের জরিনা খাতুন জানান, চার বছর ধরে এই আশ্রমে আছেন। তার কেউ নাই। বোনের নাতি এখানে রেখে গেছে। এরপর থেকে আর কেউ খোঁজখবর করে না। আল্লাহর ওপর ভরসা করে থাকেন। এখানে খাওয়া-দাওয়া সবকিছু ভালো।
এক সময় কাপড়ের ব্যবসা করা ঢাকার কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা ৭২ বছরের বৃদ্ধ শাহবুদ্দিন মোল্লা জানান, তার স্ত্রী, চার মেয়ে ও দুই ছেলে আছে। ছেলেরা ঋণগ্রস্ত। তিনি মেয়ের জামাই বাড়িতে থাকতেন। কিন্তু সেখানে অশান্তি। থাকতে ভালো লাগে না।
“তারপর পত্রিকায় দেখলাম এখানে আশ্রম আছে। এখানে চলে আসি। আসার পর তারা আমারে ভর্তি করে নেয়। দেড় বছর ধরে এখানে আছি। আশ্রম চত্বরে থাকা সবজি ক্ষেতে মাঝে মাঝে কাজ করি। এভাবেই চলছে।”
শেরপুর সদর উপজেলা নলবাইদ গ্রামের ৭০ বছরের বৃদ্ধা রেহানা বলেন, “স্বামী মারা গেছে। দুই ছেলে ও এক মেয়ে ছোট থাকতেই মারা যায়। আমার ভাতিজা এখানে রেখে গেছে। তারপর থেকে এখানেই আছেন।”
এ বৃদ্ধাশ্রমের কর্মচারী ও নালিতাবাড়ীর বাসিন্দা সালমান ফার্সি বলেন, “এখানে অনেক পুরুষ ও মহিলা মুরুব্বি থাকেন। আমি সবার সেবা যত্ন করি। শিশু আছে তার সেবা করি। কবুতর ও গরু আছে, খাবার দেই। ফুল গাছে পানি দেই। জায়গা পরিষ্কার রাখি। আমি এখানে চাকরি পেয়ে মাসে ছয় হাজার টাকা বেতন পাই। তাতে অনেক খুশি আমি।”
গত ৩ ফেব্রয়ারি কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, রাজনৈতিক দলের কর্মী, সাংবাদিক, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান, আইনজীবী এই স্নিগ্ধা আশ্রম পরিদর্শন করেন। তারা এখানে আশ্রিত ও কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলেন, সার্বিক খোঁজ খবর নেন।
তাদের মধ্যে জেলা সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, মুক্তিযুদ্ধ-৭১ এর সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মওলা বলেন, “বাংলাদেশে এমন মানুষ আছে যারা মানবতার সন্ধানে ঘুরে। তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই নলবাইদে এসে দেখলাম। খুব মনোরম পরিবেশে সুন্দরভাবে বৃদ্ধ নারী ও পুরুষেরা থাকছে তা দেখে খুব ভালো লাগল।
“আমি দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছে আহ্বান জানাব তারা যেন এখানে সহযোগিতা করেন কিংবা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে এ রকম আরও বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলেন। তাতে আল্লাহ্র কাছে এবং দেশের মানুষের কাছে সমাদৃত হবেন। এই প্রতিষ্ঠানের জন্য শফিকুল ইসলাম আকন্দকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।”
বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট প্রদীপ দে কৃষ্ণ বলেন, “বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দারা অনেকে আছেন স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে থাকা সত্ত্বেও তাকে এখানে বসবাস করতে হয়। তারা যেসব কাহিনী বললেন – শুনতে খুব অবাক লাগে। কেন বৃদ্ধাশ্রমে আসতে হলো এ প্রশ্ন করা হলে তারা কোনো উত্তর দিতে পারেন না।
“তবে মানুষ যে মানুষের জন্য, জীবন যে জীবনের জন্য এই বৃদ্ধাশ্রমে এসে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।”
বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ফকির আখতারুজ্জামান বলেন, “যারা দরিদ্র, নিরাশ্রয় এবং যাদের অনাহার আছে তারা এখানে এসে স্থান পেয়েছে। এই রকম প্রতিষ্ঠান এখানে প্রতিষ্ঠা করাটা একটি মহৎ কাজ।”
আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও জেলা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক হারেজ আলী বলেন, “অজ পাড়াগাঁয়ের এই বৃদ্ধাশ্রমের সুন্দর পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। এটার প্রতি সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলকে সুদৃষ্টি দেওয়ার অনুরোধ করছি।”
চরমোচারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম শিপন বলেন, “খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের সুব্যবস্থা এ আশ্রমে রয়েছে। শেরপুর ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে অবহেলিত লোকজন এসে আশ্রয় পান। এ মহতি উদ্যোগকে এলাকাবাসী স্বাগত জানিয়েছে।”
এই প্রতিষ্ঠানের বাসিন্দাদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার জন্য শেরপুর জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে আশ্রম চত্বরে স্বাস্থ্যসেবা ভবন নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে।