Published : 23 Jun 2023, 07:25 PM
সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকা মার্কা বড় ব্যবধানে জয় পেলেও প্রদত্ত ভোটের ৫৩ শতাংশের মত পড়েছে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে।
বিএনপির বর্জনে এই নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী ছিলেন আটজন। বাকি সাত প্রার্থীর মধ্যে তিন জনের ভোট ছিল চমক জাগানিয়া। তবে তৃতীয় অবস্থানে থাকা স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহজাহান মিয়ার ভোটের সংখ্যা নিয়েই চলছে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ।
নির্বাচনের আগে গোটা শহরে তার তেমন কোনো পরিচিতি ছিল না। গোটা নির্বাচনী এলাকায় পোস্টারও ছিল না তার, ছিল না কর্মিবাহিনী, কেন্দ্রে ছিল না এজেন্ট। সেই ব্যক্তির প্রায় ৩০ হাজার ভোট পাওয়া নিয়ে ‘বিস্ময়ের ঘোর’ কাটছে না এখনও।
বিএনপির বর্জনে এই ভোটে জাতীয় পার্টির প্রার্থী দলের মহানগর শাখার আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম বাবুল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবেন বলে আলোচনায় ছিলেন। তার ৫০ হাজারের বেশি ভোট পাওয়াও চমক হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
আর ইসলামী আন্দোলন ভোট বর্জনের ঘোষণা দিলেও দলের প্রার্থী মাহমুদুল হাসান প্রায় ১৩ হাজার ভোট পেয়ে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছেন না।
গত বুধবার নগরীর ১৯০টি কেন্দ্রে এই ভোটে নৌকা নিয়ে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ১ লাখ ১৯ হাজার ৯৯১ ভোট পেয়ে জিতেছেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির নজরুল ইসলাম বাবুলকে তিনি হারিয়েছেন ৬৯ হাজার ১২৯ ভোটে।
নৌকা বড় ব্যবধানে জিতেছে বটে, তবে প্রদত্ত মোট ভোটের অর্ধেকের কিছু বেশি পেয়েছে।
নগরীতে ভোটার সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৮৭ হাজার ৭৪৭ জন। এদের মধ্যে বৈধ ভোট পড়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার ৬৪৩ জন। এর ৫২ দশমিক ৯৪ শতাংশ পেয়েছে নৌকা। তারপরেও বড় ব্যবধানে জয় পাওয়ার কারণ প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে ভোট ভাগ হয়ে যাওয়া।
আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী লাঙ্গল নিয়ে নজরুল ইসলাম বাবুল পেয়েছেন ৫০ হাজার ৮৬২ ভোট, স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. শাহজাহান মিয়া বাস প্রতীকে পেয়েছেন ২৯ হাজার ৬৮৮ ভোট। বর্জনের ঘোষণা দিয়েও ইসলামী আন্দোলনের মাহমুদুল হাসান হাতপাখা নিয়ে পেয়েছেন ১২ হাজার ৭৯৪ ভোট।
অন্য প্রার্থীদের মধ্যে আব্দুল হানিফ কুটু ঘোড়া নিয়ে ৪ হাজার ২৯৬, গোলাপ ফুল প্রতীকে জাকের পার্টির জহিরুল আলম ৩ হাজার ৪০৫, হরিণ প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোশতাক আহমেদ রউফ মোস্তফা ২ হাজার ৯৫৯ এবং ক্রিকেট ব্যাট প্রতীক নিয়ে আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী ছালাহ উদ্দিন রিমন ভোট পেয়েছেন ২ হাজার ৬৪৮ ভোট।
কে এই শাহজাহান
মনোনয়ন ফরমের সঙ্গে সম্পদ বিবরণী ও আয়কর রিটার্নের কপি জমা না দেওয়ায় শাহজাহান মিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে গিয়েছিল। আপিল শুনানির আগে সম্পদ বিবরণী ও আয়কর রিটার্নের কপি জমা দেওয়ায় প্রার্থিতা ফিরে পান তিনি।
হলফনামা অনুযায়ী, শাহজাহান মিয়ার শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক। সিলেট নগরীর ১০ ওয়ার্ডে একটি ভাড়াবাড়িতে থাকলেও তার আদি নিবাস ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলায়।
শাহজাহানের একেক সময় একেক কাজ করে আয় করেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘বিভিন্ন পাড়ার দোকানে নিজের বাইসাইকেলে স্যালাইন, খাতা, কলম, মোমবাতি, ব্লেড, মশার কয়েল বিক্রি করছি দীর্ঘদিন ধরে।
“এর আগে শহরের ৮০টি রেস্টুরেন্টে কাজ করেছি। গোয়াইনঘাট উপজেলার একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে চাকরিও করেছিলাম।”
ভোটের প্রচার ও মালামাল বিক্রি-দুটিই একসঙ্গে চলেছে বলেও জানালেন তিনি। বলেন, ‘‘আমার নিজের কোনো কর্মী নেই; ভোটকন্দ্রে কোনো এজেন্টও ছিল না। জনগণ ভালোবেসে ভোট দিয়েছে।
“প্রচারের সময় অনেকে ভালোবেসে চা, বিস্কুট ইত্যাদি খাওয়ান। নির্বাচনের ব্যয় মিটাতেও নগরবাসী সাহায্য করেছেন।”
অন্য প্রার্থীর মত প্রচার ও ‘খরচ’ করতে পারলে আরও অনেক ভোট পেতেন বলেও বিশ্বাস করেন শাহজাহান। ভোটের এই ফলাফল তাকে আশাবাদী করে তুলেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি এসব বিষয়কে সামনে রেখে আগাতে চাই।”
নগরবাসীর নানা ব্যাখ্যা
তৃতীয় অবস্থানে থাকা শাহজাহানের প্রায় ৩০ হাজার ভোট পাওয়ার খবরে অবাক হয়েছেন নগরীর জিন্দাবাজারের ব্যবসায়ী ফজলুর রহমান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘শাহজাহান মিয়া ভোট পাবেন, এটা ধারণা করেছিলাম। তবে প্রায় ৩০ হাজার ভোট পেয়েছেন; এটা আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য। ওই প্রার্থী বাইসাইকেলে নিজে-নিজে সবকিছু করেছেন। তার কোনো কর্মী বা সমর্থকও আমাদের কাছে আসেনি। তারপরও এত ভোট পেয়েছেন যা অবাক করার মত।”
নগরীর ১০ ওর্য়াডে শাহজাহান মিয়ার প্রতিবেশী হারিছ উদ্দিন বলেন, ‘‘শাহজাহান মিয়া সাইকেল চালিয়ে নগরীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে প্রতিদিন প্রচার চালাতেন। তার সহজ-সরল কথাবার্তা ভোটারদের মনে জায়গা করে নেয়। অনেকেই গাঁটের পয়সা খরচ করে তাকে লিফলেট ছাপিয়ে দেন।”
মহানগর আওয়ামী লীগের সম্পদক মণ্ডলীর সদস্য এক নেতা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, ‘‘নির্বাচনে বিএনপির বহিষ্কৃত ৪৩ ও জামায়াতের অন্তত ২০ নেতা কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছিলেন। এর মধ্যে বিএনপির ৯ জন ও জামায়াতের ৬ জন নির্বাচিত হয়েছেন। এই প্রার্থীদের কর্মী ও সমর্থকরা শাহজাহান মিয়া ও নজরুল ইসলাম বাবুলকে ভোট দিয়েছেন। না হলে তাদের এত ভোট হত না। মূলত সরকারবিরোধীদের ভোট ভাগ হয়ে গেছে তাদের মধ্যে।”
নাগরিক সংগঠনগুলোর কর্তা ব্যক্তিদেরও একই ধারণা।
‘নাগরিক মৈত্রী সিলেট’ এর সভাপতি সমর বিজয় সী শেখরের ভাষ্য, “সিলেটের সরকারবিরোধী ভোট পেয়েছেন শাহজাহান মিয়া ও নজরুল ইসলাম বাবুল। এই ভোটগুলো ছিল যিনি সিলেটে মেয়র প্রার্থী হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েও হননি উনার।”
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সিলেট শাখার সভাপতি চ্যাপ্টারের ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “মূলত নির্বাচন বর্জন করা দলগুলোর কাউন্সিলর প্রার্থীদের কর্মী ও সমর্থকরা ভোটকেন্দ্রে গেছেন। তারা ভোটও দিয়েছেন। তাদের ভোট পেয়েছেন শাহজাহান মিয়া ও নজরুল ইসলাম বাবুল। এছাড়া এই দুই প্রার্থীর ভোট এ রকম হওয়ার কথা না। কারণ ভোটের মাঠে তারা এত আলোচনায় ছিলেন না।”
ভোট বর্জন করার ঘোষণা দেওয়ার পরও ১২ হাজারের বেশি ভোট পড়ায় ইসলামী আন্দোলনে বাংলাদেশের মাহমুদুল হাসানের বিশ্বাস, সব কিছু ‘সাজানো।’
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘আমাদের কোনো নেতা-কর্মী ভোটকেন্দ্রে যাননি। নির্বাচনে আমার যে ফলাফল দেখানো হয়েছে তা সাজানো। এটা আগেই পরিকল্পনা করে রাখা হয়েছিল।”
বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর বর্জনের মধ্যে সিলেটে ভোট পড়েছে ৪৬ দশমিক ৭১ শতাংশ। সিটি নির্বাচনে এবারই ভোট পড়েছে সবচেয়ে কম।
২০০৮ সালে নগরে ভোট পড়ার হার ছিল ৭৫ শতাংশ। ২০১৩ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৬২ শতাংশে। ২০১৮ সালে ভোটের হার ছিল প্রায় ৬৩ শতাংশ।