Published : 20 Feb 2023, 08:34 PM
নিজের মাতৃভাষার বর্ণমালা শেখানোর জন্য গত ১৯ বছর ধরে লড়াই করে যাচ্ছেন ইনজেব চাকমা। খাগড়াছড়ির দীঘিনালার নিভৃতপল্লী পূর্ব কাঠালতলী গ্রামের তরুণ ইনজেব পেশায় একজন কৃষক। ব্যক্তিজীবনে আর্থিক টানাপোড়নের মাঝেও চাকমা জনগোষ্ঠীকে বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন তিনি।
মাতৃভাষার প্রচারের জন্য নোয়ারাম চাকমা সাহিত্য পরিষদ নামে একটি সংগঠনও গড়ে তুলেছেন তিনি। এরই মধ্যে ১১ হাজারের বেশি মানুষকে চাকমা বর্ণমালা শিখিয়েছেন ইনজেব ও তার সংগঠনের প্রশিক্ষকরা। খাগড়াছড়ি ছাড়াও রাঙামাটি, বান্দরবানে চাকমা বর্ণমালা শেখানো হয়।
সবশেষ জনশুমারি অনুসারে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমাদের সংখ্যা প্রায় চার লাখ ৮৩ হাজার। খাগড়াছড়ি ছাড়াও রাঙামাটি ও বান্দরবানে এই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বসবাস। পাহাড়ের অন্যতম বৃহৎ এ জনগোষ্ঠীর নিজস্ব বর্ণমালা ‘অঝাপাত’ থাকলেও তার লিখিত রূপের চর্চা নেই বললেই চলে। চাকমা ভাষায় কথা বললেও তারা বর্ণমালা না জানায় লিখতে পারেন না।
ইনজেব চাকমার উদ্যোগের ফলে এখন বিভিন্ন স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও বর্ণমালা শিখতে আগ্রহী হচ্ছেন।
শুক্রবার দীঘিনালা সরকারি ডিগ্রি কলেজে বর্ণমালা ক্লাসে কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়।
এ সময় চাকমা বর্ণমালা শিখতে আসা জেকি চাকমা বলেন, “জাতিতে চাকমা হলেও আমাদের নিজস্ব ভাষা ঠিকমতো বলতে পারি না। আমাদের সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। নিজেদের ভাষার বর্ণমালা শেখা দরকার। এখনো চাকমা বর্ণমালা চিনি না । এটা আমাদের ব্যর্থতা। ব্যর্থতা দূর করার জন্যই বর্ণমালা শিখছি।”
আরেকজন শিক্ষার্থী হিতৈষী চাকমা বলেন, “নিজের মায়ের ভাষাটা জানা দরকার। এজন্যই নিজের ভাষার বর্ণমালা শিখছি।”
নোয়ারাম চাকমা সাহিত্য পরিষদ থেকে বর্ণমালা শিখে এখন শিক্ষার্থীদের শেখাচ্ছেন বেশ কয়েকজন প্রশিক্ষক।
তাদের একজন রিমি চাকমা বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের বসবাস। আমাদের বর্ণমালা ‘অঝাপাত’ আছে। বলতে পারলেও আমরা তা লিখতে পারি না। আমরা নোয়ারাম চাকমা সাহিত্য পরিষদ থেকে বর্ণমালা শিখেছি। এখন নিজেই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের তা শেখাচ্ছি। এখন অনেকেই চাকমা বর্ণমালা লিখতে পারে।”
তিন পার্বত্য জেলায় ২১৮টি কেন্দ্রের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ১১ হাজার ১১৮ জনকে চাকমা বর্ণমালা শিখিয়েছে ইনজেব চাকমা ও তার সংগঠন। এ ছাড়া ৪১টি বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ, হেডম্যান, কার্বারি ও চেয়ারম্যানদের চাকমা বর্ণমালা শেখানো হচ্ছে।
ইনজেব চাকমা বলেন, “চাকমারা আমাদের দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ জনগোষ্ঠী। চাকমা ভাষাও দ্বিতীয়। সমৃদ্ধ ভাষা ও বর্ণমালা থাকার পরেও তার লিখিত রূপের চর্চা না থাকার কারণে তা হারিয়ে যাচ্ছে। ২০০৪ সাল থেকে আমরা মাতৃভাষায় কার্যক্রম শুরু করেছি।”
“সরকার এখন মাতৃভাষায় প্রাথমিকে বই দিয়েছে। কিন্ত মাতৃভাষায় প্রশিক্ষিত পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকায় শ্রেণিতে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। এরই মধ্যে আমরা প্রাথমিকের শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তারা এখন বিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন।“
ইনজেব বলেন, “আমার লক্ষ্য, ২০৫০ সালের মধ্যে পুরো চাকমা জাতিগোষ্ঠীকে নিজস্ব বর্ণমালা সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।”
ভাষা রক্ষায় এমন উদ্যোগ বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারি অর্থায়নে নিজস্ব মাতৃভাষায় কবিতা, ম্যাগাজিন, সাহিত্য পত্রিকা, বই প্রকাশের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জিতেন চাকমা।
খাগড়াছড়ির ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের এই উপ-পরিচালক বলেন, “ইনজেব চাকমা নিজ উদ্যোগে বর্ণমালা শেখাচ্ছেন। বর্ণমালার চর্চা বাড়ানোর জন্য এরই মধ্যে আমরা ইনস্টিটিউট থেকে চাকমা, ককবরক ভাষায় বই প্রকাশ করেছি।”
তবে সরকারিভাবে এই উদ্যোগ আরও বাড়াতে হবে বলে মনে করেন জিতেন চাকমা।