এশিয়ান কাপ বাছাই
Published : 04 Jun 2025, 08:30 AM
বাফুফে ভবনের চারপাশে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে, জাতীয় স্টেডিয়ামের ভেতরে-বাইরে এমন আবহ, ফুটবল নিয়ে প্রবল আগ্রহ শেষ কবে দেখা গেছে? নিকট অতীতে এমন উদাহরণ নেই। হামজা চৌধুরী বাংলাদেশের জার্সি গায়ে তোলার পর সবকিছু যেন ভোজবাজির মতো গেছে পাল্টে! ব্যর্থতার চোরাবালিতে নিমজ্জিত ফুটবল যেন ফিরে পাচ্ছে প্রাণ। সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ তো বটেই, ভুটান ম্যাচও এখন সবার আগ্রহের কেন্দ্রে।
সংস্কারের পর অনেকটা বদলে যাওয়া ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে বুধবার সন্ধ্যা ৭টায় প্রীতি ম্যাচে ভুটানের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। আগামী ১০ জুন এ মাঠেই হবে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের তৃতীয় রাউন্ডের ‘হাইভোল্টেজ’ ম্যাচ। ভুটান ম্যাচ তাই বাংলাদেশের জন্য বাছাইয়ের যুদ্ধে নামার আগের ‘মহড়া।’
যাদের বিপক্ষে এই মহড়া সেই সফরকারীরা স্রেফ গুটি হয়ে থাকতে রাজি নয়। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ দলে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেও জয়ের জন্য নিজেদের উজার করে দেওয়ার কথা বললেন ভুটানের জাপানি কোচ আতসুশি নাকামুরা ।
“বাংলাদেশ আগের চেয়ে খুব ভালো দল। তারা শারীরিকভাবে খুব শক্তিশালী এবং চাপ নিয়ে খেলতে পারে। সেক্ষেত্রে যদি বলি ভুটানের খেলোয়াড়েরা অতোটা শক্তিশালী নয়। জাতীয় স্টেডিয়ামে মাঠ খুব ভালো। আশা করছি, একটা ভালো ম্যাচ খেলব। অবশ্যই আমরা জিততে চাই। তবে আমি জানি না, কাল আমরা জিততে পারব কি না। তবে আমরা আমাদের সেরাটা দেব।”
“বাংলাদেশের বিপক্ষে শেষ দুটি ম্যাচ আমরা ঘরের মাঠে খেলেছি। সেখানে উচ্চতার সুবিধা পেয়েছিলাম। এবার সেই সুবিধা নেই। এখানকার আবহাওয়া খুবই আদ্র ও গরম। গতকাল খুব গরমে অনুশীলন করেছি। কালকে বেশ গরম থাকবে বলে আমার ধারণা। তাই সেই চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠা খুব জরুরি। হামজা খুব ভালো খেলোয়াড়। আমাদের ছেলেদের জন্য ভালো এক অভিজ্ঞতা হবে তার বিপক্ষে খেলা।”
অবিকল একই সুর মেলালেন দলের প্রতিনিধি হয়ে আসা নিমা ওয়াংদি। গত বছর সেপ্টেম্বরের দুই প্রীতি ম্যাচের প্রসঙ্গ টেনে বললেন, হামজার উপস্থিতিতে বদলে গেছে বাংলাদেশ, হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা দল।
“দক্ষিণ এশিয়ার সবাই জানে বাংলাদেশ শক্তিশালী দল। গত বছর আমরা দুটি প্রীতি ম্যাচ খেলেছি নিজেদের মাটিতে। প্রথমটিতে আমরা ১-০ গোলে হেরেছি, পরেরটিতে একই ব্যবধানে জিতেছি। কিন্তু বাংলাদেশ দল এখন বদলে গেছে। তাদের তিনজন প্রবাসী ফুটবলার আছে। হামজা খুবই ভালো খেলোয়াড়। শীর্ষ পর্যায়ের লিগে খেলছে। তাই আমি মনে করি, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সেরা দল।”
প্রতিপক্ষের প্রশংসা নিয়ে ভাবার সুযোগ এখন নেই বাংলাদেশের। প্রবাসী খেলোয়াড় থাকায় দলের কম্বিনেশন নিয়ে ভাবতে হচ্ছে কোচ হাভিয়ের কাবরেরাকে। খেলোয়াড়দের বোঝাপড়া বাড়ানোর জন্যও কাজ করতে হচ্ছে তাকে।
প্রবাসীদের ফুটবলারদের ঢেউ এখন দেশমুখী। জামাল ভূঁইয়া, কাজী তারিক রায়হান ও সৈয়দ কাজেম শাহ কিরমানি- এত দিন দলে ছিলেন এই তিন জন প্রবাসী। এরই মধ্যে যোগ হয়েছেন আরও দুই জন, হামজা চৌধুরী ও ফাহামিদুল ইসলাম। সামিত সোম যোগ হবেন বুধবার সকালে। ২৬ জনের প্রাথমিক দলে প্রবাসী ছয় জন।
এদের ঘিরেই টিকেটের চাহিদা এখন আকাশচুম্বি। ফুটবল জোয়ারে ভাসছে দেশ। সমর্থক, কোচ সবার প্রত্যাশার পারদ চড়ছে উঁচুতে। সেটা পূরণ করতে হলে মাঠে ভালো ফুটবল উপহার দেওয়ার পাশাপাশি ফলও পক্ষে আনতে হবে কাবরেরার দলকে। এর জন্য খেলোয়াড়দের মধ্যে বোঝাপাড়া ভালো থাকা জরুরি।
জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলন, বাফুফের গেটে টিকেটের দাবি নিয়ে বিক্ষোভ, স্টেডিয়ামের গেটে সমর্থকদের ভিড়- কোনো কিছুই নজর এড়ায়নি হাভিয়ের কাবরেরার। ক্রমশ বাড়তে থাকা প্রত্যাশাকে চাপ নয়, অনুপ্রেরণা হিসেবে নিচ্ছেন বলে জানালেন সংবাদ সম্মেলনে। এরপর এই স্প্যানিশ কোচ ডুব দিলেন ভুটান ম্যাচের প্রস্তুতিতে। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ভুটান (১৮২তম) ও বাংলাদেশ (১৮৩তম) পাশাপাশি।
একটু আগে-ভাগে ইতালি থেকে ঢাকায় আসা ফাহামিদুল শনিবার শুরুর দিন থেকেই অনুশীলন করেছেন সতীর্থদের সঙ্গে সাথে। গত মার্চে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে সৌদি আরবের ক্যাম্প থেকে ইতালি ফিরতে হয়েছিল তাকে। লাল-সবুজের জার্সিতে অভিষিক্ত হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে আবারও এসেছেন তিনি। এ কদিনের প্রস্তুতিতে দলের সাথে ‘মিশুক’ ফাহামিদুলের মিশে যাওয়ার কথা বলেছেন তার সতীর্থরাও। কাবরেরা ইঙ্গিত দিয়েছেন, ১৮ বছর বয়সী এই তরুণ ফরোয়ার্ডকে ভুটান ম্যাচে খেলাতে চান তিনি।
গোল যেন বাংলাদেশ দলের জন্য সোনার হরিণ। ভালো একজন স্ট্রাইকারের খোঁজ অনেক দিন ধরেই করছে। এলিটা কিংসলেকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট দিয়ে খেলানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সেই ভাবনা কাজে আসেনি। অনেকে ফাহামিদুলকে দেখছেন বাংলাদেশের গোল খরার সমাধান হিসেবে।
হামজা ক্যাম্পে যোগ দিয়েছেন সোমবার। ভুটান ম্যাচের আগেও তিনিও কিছুটা সময় পেয়েছেন সতীর্থদের সাথে বোঝাপড়ার বন্ধনটা আরেকটু শক্ত করে নেওয়ার। গত মার্চে শিলংয়ে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের জার্সিতে অভিষিক্ত হয়েছেন, এবার তিনি অপেক্ষায় দেশের মাঠে প্রথম খেলার। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারকে ভুটান ম্যাচের স্কোয়াডে রাখার নিশ্চয়তা দিয়েছেন, খেলার নিশ্চয়তা দেননি।
বুধবার সকালে সামিত সোমের কানাডা থেকে ঢাকায় ফেরার কথা। এদিন সন্ধ্যায় ভুটানের বিপক্ষে তাকে খেলানোর ভাবনা কাবরেরার নেই বললেই চলে। তবে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে কানাডি লিগে খেলা এই মিডফিল্ডারের অভিষেক হওয়ার জোরাল সম্ভাবনাই আছে। সেক্ষেত্রে তিনিও দলের সাথে মানিয়ে নিতে সময় পাবেন দিন পাঁচেক।
দলে স্থানীয়-প্রবাসীদের বনিবনা হলো কতটা, মাঝমাঠের সাথে আক্রমণভাগের বোঝাপড়া কতটা অটুট হলো, পোস্টে মিতুল মারমাকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য হামজা-সোহেল-তারিকদের মধ্যে সমন্বয় হলো কতখানি-বাংলাদেশের কোচের জন্য এগুলোই এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভুটান ম্যাচে এই বোঝাপড়ার পরীক্ষায় বসবে কাবরেরার দল। এর উপর অনেকটাই নির্ভর করবে সিঙ্গাপুর ম্যাচের জন্য কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ। ফুটবলের ফিরে আসা, সমর্থকদের আগ্রহের জোয়ারের গতিবেগ আরও বাড়বে নাকি ভাটার টান পড়বে, নির্ভর করবে এসবও।