এশিয়ান কাপ বাছাই
Published : 10 Jun 2025, 08:12 PM
স্টেডিয়ামের গেট খোলার কথা ছিল দুপুর ২টায়। তার আগেই গেটে সমর্থকদের ভীড়। স্টেডিয়ামের বাইরেই নানা রঙের স্মোক ফ্লেয়ার ছুঁড়ে ম্যাচ শুরুর আগে উচ্ছ্বাস-উল্লাসে মেতে উঠলেন তারা। এর ধারাবাহিকতায় কিক অফের বাঁশি বাজতে ফুটবলপ্রেমীদের তুমুল হর্ষধ্বনি, করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠল চারপাশ। কিন্তু এত সমর্থক পাশে পেয়েও প্রথমার্ধে জ্বলে উঠতে পারল না বাংলাদেশ। পিছিয়ে থেকে বিরতিতে গেল, এরপর ফিরে গোল হজম করল আরও একটি। রাকিব হোসেন এক গোল শোধ দিলেন বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘরের মাঠে হারের তেতো স্বাদই পেল হাভিয়ের কাবরেরার দল।
জাতীয় স্টেডিয়ামে মঙ্গলবার এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের তৃতীয় রাউন্ডের ম্যাচের ম্যাচে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ২-১ গোলে হেরেছে বাংলাদেশ। ‘সি’ গ্রুপের অন্য ম্যাচে হংকংয়ের কাছে ১-০ গোলে হেরেছে ভারত। তাতে ৪ করে পয়েন্ট হংকং ও সিঙ্গাপুরের। ১ করে পয়েন্ট বাংলাদেশ ও ভারতের।
ভারতের বিপক্ষে গোলশূন্য ড্রয়ে বাছাই শুরু করায় সিঙ্গাপুর ম্যাচ নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিল বাংলাদেশ। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা হামজা চৌধুরীর সাথে কানাডার লিগ খেলে আসা শোমিত সোম এবং ইতালির সেরি ডি’তে খেলা ফাহামিদুল ইসলাম যোগ হওয়ায় প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বি। কিন্তু মাঠের লড়াইয়ে প্রত্যাশার সাথে পারফরম্যান্সের সম্মিলন হলো না। ফলে ১০ বছর পরের দেখায়ও হারের তেতো অভিজ্ঞতাই হলো বাংলাদেশের।
সবশেষ ভুটান ম্যাচের একাদশ থেকে তিনটি পরিবর্তন এনে সিঙ্গাপুর ম্যাচ শুরু করেন কাবরেরা। নিয়মিত অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়াকে বেঞ্চে রেখে শোমিতকে রাখেন তিনি। এ ম্যাচ দিয়ে লাল-সবুজের জার্সিতে অভিষেক হলো কানাডা প্রবাসী লিগে খেলা এই মিডফিল্ডারের। ভুটান ম্যাচের গোলদাতা সোহেল রানার বদলে মোহাম্মদ হৃদয় ও লেফট ব্যাক তাজ উদ্দিনের জায়গায় শাকিল আহাদ তপুকে রেখে একাদশ সাজান তিনি।
ম্যাচে প্রথম ভালো সুযোগটি অবশ্য তৈরি করে সিঙ্গাপুর। নবম মিনিটে হ্যারিস স্টুয়ার্টের লং থ্রোয়ের পর জটলার মধ্যে ডিফেন্ডাররা ক্লিয়ার করতে ব্যর্থ হলে বল চলে যায় দূরের পোস্টে। সেখানে সন উই-ইয়াং পা ছোঁয়ালেও বল পোস্টে রাখতে পারেননি। এই আক্রমণেই সিঙ্গাপুর বুঝিয়ে দেয় ‘ট্যুরিস্ট’ হিসেবে ঢাকায় আসেনি তারা।
পঞ্চদশ মিনিটে বাম প্রান্ত দিয়ে শাকিল আহাদ তপুর ক্রসে রাকিবের দুর্বল শট এক ডিফেন্ডারের পায়ে লেগে সরাসরি গোলকিপারের কাছে যায়। পরের ইখসান ফান্দির হেড বেরিয়ে যায় পোস্ট ঘেঁষে। মিতুল মারমা ঠাঁই দাঁড়িয়ে ছিলেন। হেড লক্ষ্যে থাকলে কিছুই করার থাকত না বাংলাদেশ গোলরক্ষকের।
২৮তম মিনিটে চোট পেয়ে স্ট্রেচারে করে মাঠের বাইরে যান রক্ষণের নির্ভরতা কাজী তারিক রায়হান। চিকিৎসা নিয়ে তিনি মাঠে ফিরলে স্বস্তি ফিরে বাংলাদেশের তাঁবুতে। দুই মিনিট পর বাংলাদেশের ত্রাতা মিতুল। বাম দিক দিয়ে আক্রমণে ওঠা ফান্দির শট ঝাঁপিয়ে আটকান তিনি।
এরপরই আক্রমণে ওঠে বাংলাদেশ। শোমিতের রক্ষণচেরা পাসে গতি একটু বেশি থাকায় রাকিব ছুটে গিয়েও পাননি বলের নাগাল। সিঙ্গাপুর গোলকিপার ছুটে এসে গ্লাভসবন্দি করেন বল। ৩৫তম মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে হামজার ফ্রি কিক ক্রসবারের উপর দিয়ে বেরিয়ে যায় দীর্ঘশ্বাস বাড়িয়ে।
ভালো সুযোগ ৪০তম মিনিটে এসেছিল ফাহামিদুলের সামনে। কিন্তু বাম দিক দিয়ে আক্রমণে ওঠা এই তরুণ ফরোয়ার্ড সময়ক্ষেপণ করে শেষ পর্যন্ত দুই ডিফেন্ডারের প্রতিরোধে ঠিক মতো শট নিতে পারেননি।
এর একটু পরই গ্যালারির গর্জন থামিয়ে ৪৫তম মিনিটে এগিয়ে যায় সিঙ্গাপুর। হারিসের শট এক ডিফেন্ডারের গায়ে লেগে বল উচুঁতে উঠে যায়, মিতুল পোস্ট ছেড়ে বেরিয়ে ফিস্ট করলেও পুরোপুরি বিপদমুক্ত করতে পারেননি, বল চলে যায় হ্যারিসের পায়ে। তার ক্রস থেকে সাইড ভলিতে জাল খুঁজে নেন উই-ইয়াং। হামজা ছুটে গিয়ে ক্লিয়ার করার চেষ্টা করলেও লাভ হয়নি, বল আগেই পেরিয়ে যায় গোললাইন। তাতে পিছিয়ে থেকে বিরতিতে যায় বাংলাদেশ।
বিরতিতে স্টেডিয়ামের আলো বন্ধ করে দিয়ে লেজার শো’র প্রদর্শনী চলে। মোবাইলের আলো জ্বেলে তা উপভোগও করেন মাঠে আসা সমর্থকেরা। কিন্তু দল পিছিয়ে থাকায় বিরতির ফাঁকের এই উদযাপনে ছিল না বাঁধনহারা উল্লাস।
একটি পরিবর্তন এনে দ্বিতীয়ার্ধ শুরু করে বাংলাদেশ। রাইট উইংয়ে নিজেকে মেলে ধরতে ব্যর্থ হওয়া কাজেমকে তুলে শাহরিয়ার ইমনকে নামান কাবরেরা। তাতে খেলার গতি বাড়বে কী, উল্টো ৫৮তম মিনিটে ব্যবধান দ্বিগুণ করে নেয় সিঙ্গাপুর। হামি শাহিনের জোরাল শট মিতুল ফিস্ট করার পর বল চলে যায় ফান্দির পায়ে। মোহাম্মদ হৃদয় পারেননি প্রতিরোধ গড়তে, ফান্দির শটে বলে হৃদয়ের পায়ের ফাঁক গলে দূরের পোস্ট দিয়ে জড়ায় জালে।
এরপরই ফাহামিদুলের বদলি নামেন ফয়সাল আহমেদ ফাহিম। স্তব্ধ গ্যালারিতে উন্মাদনা ফিরে ৬৭তম মিনিটে। হামজা আবারও দেখালেন তার ঝলক। এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের থ্রু পাস ধরে শট নেন রাকিব। সিঙ্গাপুর গোলরক্ষকের গায়ে লেগে বলের গতি কমে গেলেও শেষ পর্যন্ত তা পেরিয়ে যায় গোললাইন।
একটু পর শাকিল আহাদ ও হৃদয়কে তুলে শেখ মোরসালিন ও আল আমিনকে নামান কাবরেরা। ৭৭তম মিনিটে হামজার বাঁকানো ফ্রি কিক কর্নারে ক্লিয়ার করে সিঙ্গাপুর। মোরসালিনের কর্নারও কাজে আসেনি। ৭৯তম মিনিটে ইমনের শট সোজা যায় গোলরক্ষকের কাছে। সমতায় ফিরতে মরিয়া বাংলাদেশ ৮২তম মিনিটে সিঙ্গাপুরের রক্ষণে চাপ বাড়াতে থাকে। কিন্তু টানা চারটি কর্নারের কোনোটাই কাজে লাগাতে পারেনি দল।
দ্বিতীয়ার্ধের যোগ করা সময়ে রাকিবের ক্রসে এক ডিফেন্ডার হেড করলে বল চলে যায় ফাহিমের পায়ে। চলন্ত বলে এই ফরোয়ার্ডের ভলি ক্রসবারের অনেক উপর দিয়ে উড়ে যায়। একটু পর বক্সে ফাহিম ফাউলের শিকার হলে পেনাল্টির আবেদন করে বাংলাদেশ, সাড়া মেলেনি রেফারির।
এরপর হামজার শট যায় বাইরে। শেষ মুহূর্তে মোরসালিনের ক্রসে তারিকের হেড গোলকিপারের হাত ছুঁয়ে পোস্টে লেগে ফিরে। এরপরই বাজে শেষের বাঁশি। সমর্থকে ঠাসা গ্যালারিতে শ্মশানের নীরবতা এনে জয়ের উৎসবে মাতে সিঙ্গাপুর।