Published : 19 Dec 2022, 04:30 PM
নির্ধারিত সময়ে ২-২ ড্র। অতিরিক্ত সময়ে ৩-৩ সমতা। অবশেষে পার্থক্য টানা গেল রুদ্ধশ্বাস টাইব্রেকারে। সেখানে ৪-২ গোলে জিতে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরল আর্জেন্টিনা। বিশ্বমঞ্চে অবসান হলো তাদের ৩৬ বছরের অপেক্ষার। শিরোপা ধরে রাখার অভিযানে এসে একটুর জন্য পারল না ফ্রান্স।
হ্যাটট্রিক করেছেন কিলিয়ান এমবাপে। আর্জেন্টিনার হয়ে জোড়া গোল করেছেন লিওনেল মেসি, অন্যটি আনহেল দি মারিয়ার। সব মিলিয়ে লুসাইলে স্নায়ু চাপের কঠিন পরীক্ষা নেওয়া ফাইনাল মুগ্ধ করে রেখেছে ফুটবল প্রেমীদের।
রোমাঞ্চ, উত্তেজনায় ঠাসা এই ম্যাচে বুঁদ হয়ে ছিলেন সাবেক ইংলিশ ডিফেন্ডার জেমি ক্যারাঘার। এক টুইটে তিনি জানান প্রতিক্রিয়া।
“সব সময়ের সেরা ম্যাচ। এই ম্যাচ দেখিয়েছে কেন ফুটবল সব খেলার সেরা। এটা একটা অল-টাইম ক্লাসিক।”
স্নায়ুক্ষয়ী এই লড়াই অ্যালান শিয়েরারের কাছে অবিশ্বাস্য এক ম্যাচ। বিবিসিকে সেই কথাই বললেন, সাবেক এই ইংলিশ স্ট্রাইকার।
“অবিশ্বাস্য এক ফাইনাল। এর আগে এমন কিছু আমি কখনও দেখিনি। আমার ধারণা, আমরা এমন কিছু এরপর আর দেখবও না। এটা ছিল বারবার রঙ পাল্টানো এক ম্যাচ।”
দুই ফুটবল পরাশক্তির তৃতীয় তারকার জন্য লড়াই। মেসির প্রথম আর এমবাপের দ্বিতীয় শিরোপার জন্য ‘যুদ্ধ।’ জমাজমাট ম্যাচের প্রতিশ্রুতি ছিল আগে থেকেই। তবে এতটা জমে যাবে কল্পনাও করতে পারেননি রিও ফার্ডিনান্ড।
“দুটি অসাধারণ দল সমানে-সমানে লড়াই করেছে, কেউ এক বিন্দু পিছনে সরেনি- এমন ঘটবে আমি ধারণাও করতে পারিনি। দুই দলের দুই তারকা সেটাই ঘটিয়েছে, গোলের বদলে গোল দিয়েছে… অসাধারণ।”
২৩তম মিনিটে সফল স্পট কিকে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে নেন মেসি। এই পেনাল্টি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। আনহেল দি মারিয়াকে হয়তো মৃদু টোকা দিয়েছিলেন উসমান দেম্বেলে।
৩৬তম মিনিটে দুর্দান্ত এক টিম গোলে ব্যবধান বাড়ায় আর্জেন্টিনা। ৭৯তম মিনিট পর্যন্ত ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে ছিল লাতিন আমেরিকার চ্যাম্পিয়নরা।
ফ্রান্স একটি পেনাল্টি পাওয়ার পর পাল্টে যায় খেলার চিত্র। ৮০তম মিনিটে ব্যবধান কমান এমবাপে। পরের মিনিটে দুর্দান্ত এক ভলিতে সমতা ফেরান তরুণ এই ফরোয়ার্ড।
তার দ্বিতীয় গোলে দারুণ অবদান কিংসলে কোমানের। তিনিই প্রতি-আক্রমণে যাওয়ার মুখে মেসির কাছ থেকে বল কেড়ে নিয়ে বাড়িয়েছিলেন মার্কাস থুরামকে। তার কাছ থেকে বল পেয়েই জাল খুঁজে নেন এমবাপে।
সমতা ফেরানোর পর যেন জেগে ওঠে ফ্রান্স। আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে প্রতিটি মিনিট সে সময় ছড়ায় দারুণ রোমাঞ্চ।
১০৮তম মিনিটে আর্জেন্টিনাকে ফের এগিয়ে নেন মেসি। ১০ মিনিট পর আরেকটি স্পট কিকে সমতা ফেরান এমবাপে। মাত্র দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে গড়েন ফাইনালে হ্যাটট্রিকের কীর্তি। মেসিকে ছাড়িয়ে ৮ গোলে জেতেন আসরে সেরা গোলদাতার পুরস্কার।
তবে কোমানের যে কর্নার থেকে ওই পেনাল্টির সূত্রপাত, সেটায়ও বিতর্কের অবকাশ আছে। টিভি রিপ্লে দেখে মনে হয়েছে, দায়দ উপেমেকানো মাথা দিয়ে নয়, হাত দিয়ে ডি-বক্সের মুখে বল দিয়েছিলেন এমবাপেকে। তার শট ঠেকানোর চেষ্টায় গনসালো মনতিয়েলের হাতে লাগলে পেনাল্টি পেয়েছিল ফ্রান্স।
অতিরিক্ত সময়ে ম্যাচ শেষ করে দেওয়ার সুযোগ এসেছিল দুই দলের সামনেই। আর্জেন্টিনার লাউতারো মার্তিনেসের দুটি শট দুর্দান্ত ব্লকে ব্যর্থ করে দেন উপেমকানো।
রন্দাল কোলো মুয়ানি বিপজ্জনক জায়গা থেকে একটি হেড করেন বাইরে। প্রতি-আক্রমণ থেকে গোলরক্ষককে একা পেয়েও জালের দেখা পাননি তিনি। পা বাড়িয়ে কোনোমতে রক্ষা করেন এমিলিয়ানো মার্তিনেস।
হ্যাটট্রিক যেমন মনে রাখবেন এমবাপে, তেমনি ভুলে যেতে চাইবেন অন্তিম সময়ের সুযোগ। বাঁদিকে বল পেয়ে দুই-তিন জনকে কাটিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন ভেতরে। অনায়াসেই নিতে পারতেন শট। কিন্তু আরেকটু এগিয়ে যেতে চাইলেন তিনি, সেই সুযোগ ছুটে গিয়ে বল বাইরে পাঠিয়ে দিলেন পাওলো দিবালা! হাতছাড়া হয়ে গেল দুর্দান্ত এক সুযোগ।
টাইব্রেকারে দুই দলের প্রথম শটে গোল করেন এমবাপে ও মেসি। ফ্রান্সের দ্বিতীয় শটে তালগোল পাকান কোমান। তার শট ঝাঁপিয়ে ফিরিয়ে দেন এমিলিয়ানো মার্তিনেস। পরের শটেও গোল পায়নি ফ্রান্স। অহেলিয়া চুয়ামেনি মারেন বাইরে, ঠিক দিকেই ডাইভ দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনা গোলরক্ষক।
লিওনেল স্কালোনির দলের জয়ের জন্য ফরাসিদের এই দুটি ব্যর্থতাই যথেষ্ট ছিল। আর্জেন্টিনার চার শটে জালের দেখা পান মেসি, পাওলো দিবালা, লেয়ান্দ্র পারেদেস ও মনতিয়েল।
প্রথম তিনটি শট ফেরানোর যথেষ্ট সুযোগ ছিল। মেসির শটে ততটা জোর ছিল না, খুব বেশি দূরেও ছিল না। দিবালার শটে জোর ছিল তবে তিনি শট নিয়েছিলেন মাঝ বরাবর, দাঁড়িয়ে থাকলে অনায়াসেই ফেরাতে পারতেন উগো লরিস। পারেদেসের শটে ঠিক দিকেই ডাইভ দিয়েছিলেন, কিন্তু একটুর জন্য ফেরাতে পারেননি।
শেষ সময়ে হ্যান্ডবলের দায় দারুণভাবে মিটিয়ে দেন মনতিয়েল। ঠাণ্ডা মাথার শটে খুঁজে নেন জাল। দেশের বিশ্বকাপ জয়ে উচ্ছ্বসিত সাবেক আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার পাবলো সাবালেতা।
“আমাদের দেশের জন্য, আমরা একটা ছবি দেখব, মারাদোনা ও মেসি- সব সময়ের সেরা দুই জনের হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি। এটা খুবই অসাধারণ ব্যাপার। আমরা খুব ভাগ্যবান।”
শুরু থেকে এই বিশ্বকাপের আলোচনার বড় অংশ জুড়ে ছিলেন মেসি। ফাইনালে এসে তো তাকে ঘিরেই হচ্ছিল সব কথা। গ্যারি নেভিল মনে করেন, পাদপ্রদীপের আলোয় থাকা মেসির প্রাপ্য।
“পুরো ক্যারিয়ারে যে ম্যাচই খেলেছে, সেটাতেই দ্যুতি ছড়িয়েছে মেসি। যদি আপনি মেসির খেলা সরাসরি দেখে থাকেন, আপনি ভাগ্যবান।”
১৯৮৬ সালে মারাদোনা যেভাবে বিশ্বকাপ জিতে পরবর্তী প্রজন্মের খেলোয়াড়দের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন, সাবেক ইংলিশ ডিফেন্ডার নেভিল মনে করেন মেসিদের এই জয় সেই একই প্রভাব ফেলবে।
“আমরা ফাইনালের আগে ১৯৮৬ বিশ্বকাপে মারাদোনার কিছু ভিডিও ক্লিপ দেখছিলাম। আমার ছেলেবেলাতেও এগুলো দেখেছি আমি। আমার তখনকার বয়সী যারা আজ রাতে এই ম্যাচ দেখেছে, তারা ফুটবলার হতে চাইবে। ফুটবল সংস্কৃতিতে নিমগ্ন ও মিশে যেতে চাইবে।”
কোনো হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ম্যাচের অনেক মুহূর্ত নিয়ে বহুদিন কথা হয়, আলোচনায় থাকে। কত কিন্তু, যদি, ইশ সঙ্গী হয়। কোমান, চুয়ামেনি হয়তো সারাজীবন মনে রাখবেন টাইব্রেকারে মিসের কথা। এমবাপেকে হয়তো সারা জীবন তাড়া করবে শেষের সেই সুযোগ কাজে লাগাতে না পারার কথা।
মেসি-দি মারিয়া-মার্তিনেস থেকে শুরু করে আর্জেন্টিনার মানুষের মনে কাতার বিশ্বকাপ এবং এই দল বেঁচে থাকবে অন্য কারণে। লাতিন আমেরিকার শ্রেষ্টত্বের লড়াইয়ে ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপা আমেরিকা জয়, ইউরোপের সেরা ইতালিকে হারিয়ে ফিনালিস্সিমা জেতা আর বিশ্বের সেরা দল ফ্রান্সকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জয়! এই চক্র তো সহজে ভোলার নয়।
আর সবচেয়ে বড় সাফল্য এলো এমন এক ম্যাচ দিয়ে, যে লড়াই ফুটবল গল্পগাঁথায়ও হয়তো জায়গা পেয়ে গেছে।