Published : 10 Jun 2025, 01:04 PM
পেরুর অ্যামাজনে সোনার খনি খননের পর বন আর আগের চেহারায় ফিরে আসছে না বলে উঠে এসেছে সাম্প্রতিক এক গবেষণায়।
গবেষকদের দাবি, এমনটি কেবল মাটির ক্ষতির কারণে নয়, বরং ওই মাটি পানি ধরে রাখার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, যেটি গাছপালার বেড়ে ওঠার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ‘সাকশন মাইনিং’ নামে পরিচিত এক সাধারণ খনন পদ্ধতিতে অ্যামাজনের ওই অঞ্চলের মাটি এতটাই শুকিয়ে গিয়েছে, সেখানে নতুন গাছ লাগালেও তা আর ঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে না।
গবেষণাপত্রটি প্রকাশ পেয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘কমিউনিকেশনস আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’-এ। গবেষণায় উঠে এসেছে, কেন ওই অঞ্চলে বনায়ন বা গাছ লাগানোর চেষ্টার বেশিরভাগই ব্যর্থ হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া’ বা ইউএসসি’র আর্থ সায়েন্সের বিভাগের অধ্যাপক জশ ওয়েস্ট বলেছেন, এটি কেবল মাটি নষ্ট হওয়ার বিষয় নয়, বরং “খনি খনন প্রক্রিয়ায় জমি এতটা শুকিয়েছে, সেটি নতুন গাছের জন্য বসবাসের উপযোগীই নেই।”
গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন ‘উডওয়েল ক্লাইমেট রিসার্চ সেন্টার’-এর বিজ্ঞানী আবরা অ্যাটউড। তিনি ইউএসসি থেকে পিএইচডি করেছেন ও এ গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্র ও পেরুর বেশ কয়েকটি ইউনিভার্সিটি’র গবেষকদের সঙ্গে মিলে কাজ করছেন।
একসঙ্গে পেরুর ‘মাদ্রে দে দিওস’ অঞ্চলের দুটি পরিত্যক্ত খনির জায়গা নিয়ে গবেষণা করেছেন তারা। এই এলাকা ব্রাজিল ও বলিভিয়ার সীমানার কাছে অবস্থিত।
ওই অঞ্চলে কী ঘটছে তা বোঝার জন্য ড্রোন, মাটির সেন্সর ও ভূগর্ভস্থ ছবি তোলার যন্ত্র ব্যবহার করেছে গবেষণা দলটি। মূলত ‘সাকশন মাইনিং’ পদ্ধতির ওপর নজর দিয়েছেন তারা, যেটি সাধারণত ছোট আকারের খনির কাজে ব্যবহৃত হয়। এ পদ্ধতিতে জোরালো পানির কামান দিয়ে মাটি ভেঙে আলাদা করা হয়।
সাকশন মাইনিংয়ের সময় মাটি ভেঙে সোনা আলাদা করার কারণে এর সঙ্গে গাছের জন্য জরুরি উপকারী বা পুষ্টিকর মাটি ধুয়ে যায়। ফলে সেখানে পানি জমে থাকার অনেক বড় গর্ত ও তিনতলা বাড়ির সমান উঁচু বালির স্তূপ বা টিলা তৈরি হয়, যা জায়গাটাকে বনের জন্য সম্পূর্ণ অনুপযোগী করে তোলে।
অন্যান্য খনন পদ্ধতির তুলনায় সাকশন মাইনিং প্রায় পুরোপুরিভাবে উপকারী মাটি ধুয়ে ফেলে। ফলে সেখানে নতুন গাছপালা জন্মানোর জন্য মাটির প্রয়োজনীয় উপাদান একেবারেই কমে যায়।
মাটির মধ্যে পানি কীভাবে চলাচল করে তা বুঝতে ‘ইলেকট্রিক্যাল রেজিস্টিভিটি ইমেজিং’ নামে পরিচিত এক পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন গবেষকরা।
তারা বলছেন, সোনা খননের পর জমে থাকা বালির স্তূপ দিয়ে বৃষ্টির পানি প্রায় একশ গুণ দ্রুতগতিতে মাটি থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর, বৃষ্টি হলেও ওইসব এলাকা পাঁচ গুণ দ্রুত শুকিয়ে যায়। ফলে শিকড় পর্যন্ত পানি না পৌঁছানোর কারণে নতুন গাছের বেড়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে।
গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, এসব ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল সুস্থ বনের তুলনায় অনেক বেশি উত্তপ্ত। এখানে বালির স্তূপের ওপর তাপমাত্রা পৌঁছায় প্রায় ১৪৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা একটি চুলার মতো গরম। নতুন গাছ লাগানোর চেষ্টা করলেও এত গরম ও শুষ্কতার কারণে গাছের ছোট কুঁড়িগুলো দ্রুত মরে যায়।
গবেষণা দলটি বলছে, পুকুর ও নিচু জমির কাছাকাছি কিছু গাছপালা আবার জন্ম নিলেও সোনার খনি খননের পর জমির বড় অংশে গাছপালা জন্মেনি, বিশেষ করে যেসব অঞ্চলে বালি বেশি সেসব অঞ্চলে। এসব শুষ্ক এলাকা বন ফিরিয়ে আনার জন্য সবচেয়ে কঠিন জায়গা হিসেবে বিবেচিত।
১৯৮০ সাল থেকে ছোট আকারের সোনার খনি খননের কারণে এ অঞ্চলের ৯৫ হাজার হেক্টরের বেশি চিরহরিৎ অংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো শহরের সাতগুণের বেশি বড় এলাকা।
এদিকে, ‘তাম্বোপাটা ন্যাশনাল রিজার্ভ’-এর মতো সংরক্ষিত এলাকায় খনন কাজ বাড়ছে, যা বন্যপ্রাণী ও স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য বড় হুমকি। বর্তমানে অ্যামাজনে মোট বন ধ্বংসের প্রায় ১০ শতাংশ কারণ এই সোনার খনি।
গবেষকরা বলছেন, কেবল গাছ লাগানোই যথেষ্ট হবে না। জমির আকৃতি পরিবর্তন করা, যেমন বালির স্তূপ সমান করে ফেলা ও বিভিন্ন পুকুর ভরাট করতে হবে, যাতে মাটি পানিকে ধরে রাখতে ও নতুন গাছ বেড়ে উঠতে পারে। প্রাকৃতিকভাবে এ পরিবর্তন ধীরে হয় ও অনেক বেশি সময় লাগে। দ্রুত ফলাফলের জন্য মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে।
ওয়েস্ট বলেছেন, “অ্যামাজন তো কেবল একটাই আছে। এটি পৃথিবীর অনন্য ও জীবন্ত এক পরিবেশ। একবার হারিয়ে ফেললে এটিকে আর ফিরে পাব না আমরা।”