Published : 15 May 2025, 01:33 PM
ম্যানগ্রোভ বলতেই যেমন চোখে ভাসে সুন্দরবন, তেমনি সাভানা বলতেই অনেকে বোঝেন আফ্রিকার সহারা মরুর দক্ষিণে বিস্তৃত তৃণভুমিকে। যদিও ম্যানগ্রোভের মতোই সাভানা হচ্ছে একটি বিশেষ ধরনের বনাঞ্চল, যার বিস্তৃতি রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে, যেমন দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলে।
ব্রাজিলের ২০ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও বৈচিত্র্যময় সাভানা অঞ্চল সেরাদো। বড় এ সাভানায় আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে কেবল ৩০টি প্রজাতির গাছ।
কিন্তু কীভাবে?
বেশিরভাগ সময় অ্যামাজনের ছায়ায় ঢাকা পড়ে থাকলেও ব্রাজিলের পরিবেশ রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সেরাদো। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ এবং অ্যামাজন বন ও ব্রাজিলের নগরায়িত দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের মাঝখানে এক প্রাকৃতিক বাধা হিসেবে কাজ করে এটি।
অবাক করার মতো হলেও গাছের কেবল ৩০টি প্রজাতি এই বিশাল বনের বাস্তুতন্ত্রে আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে অর্থাৎ সেখানে পাওয়া সব গাছের প্রায় অর্ধেকই এই নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রজাতির গাছ বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট নোরিজ।
এ ঘটনাকে বলা হচ্ছে ‘হাইপারডমিন্যান্স’। এর মানে, কোনো অঞ্চলে বা বনে কিছু গাছের প্রজাতি খুব বেশি সংখ্যায় থাকা। বিজ্ঞানীরা আগে এমনটি অ্যামাজন বনে দেখেছেন। তবে সাভানার মতো জায়গায় এভাবে থাকবে তা আগে অনুমান করেননি তারা।
এ গবেষণাটি করেছেন ব্রাজিল, যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসের বিজ্ঞানীরা। গবেষণায় দুইশোটিরও বেশি মাঠ পর্যবেক্ষণ স্থান, স্যাটেলাইট ছবি ও স্থানভিত্তিক মডেল বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পেয়েছেন গবেষকরা।
গবেষণাটি প্রকাশ পেয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘কমিউনিকেশন বায়োলজি’তে।
৩০টি বেশি সংখ্যায় থাকা গাছের মধ্যে একটি প্রজাতি সবচেয়ে চোখে পড়ে, যার নাম ‘কোয়ালিয়া পারভিফ্লোরা’। সেরাদো’তে দেখতে পাওয়া প্রতি ১৪টি গাছের মধ্যে এ প্রজাতির গাছ একটি।
‘স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ মাতো গ্রোসো’র অধ্যাপক ড. ফাকুন্দো আলভারেজ বলেছেন, সাভানার এত বৈচিত্র্যের মধ্যে এই কয়েকটি গাছের এতটা আধিপত্য থাকবে, এটা একেবারেই আশা করেননি তারা।
গত কয়েক দশকে ভয়াবহ বন নিধনের কবলে পড়েছে সেরাদো। ১৯৮৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আনুমানিক আড়াই হাজার কোটি গাছ হারিয়েছে এ অঞ্চল।
এ সংখ্যা পৃথিবীর মানুষের মোট জনসংখ্যার তিন গুণ। এ ক্ষতি কেবল বিভিন্ন গাছকেই নয়, বরং এ অঞ্চলের পুরো বাস্তুতন্ত্রকেও হুমকির মুখে ফেলেছে। কারণ এ আধিপত্য বিস্তারকারী গাছগুলো সাভানার পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষকরা বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ এসব গাছের ক্ষতি হলে ব্রাজিলের পানির সরবরাহ, জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর গুরুতর প্রভাব পড়তে পারে।
‘ইউনিভার্সিটি অফ এক্সেটার’-এর অধ্যাপক টেড ফেল্ডপাউশ বলেছেন, কেবল ৩০টি প্রজাতির গাছের আধিপত্য সেরাদো’কে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি বিশেষভাবে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
তিনি বলেছেন, “যখন অনেক বাস্তুতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কেবল কয়েকটি প্রজাতির ঘাড়ে এসে পড়ে তখন যে কোনো ধরনের বাধা সাভানার স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।”
এসব প্রজাতির গাছের ওপর নির্ভরশীলতার মানে হচ্ছে যদি এ কয়েকটি প্রজাতির গাছ জলবায়ু পরিবর্তন বা আগুনের কারণে বাঁচতে না পারে তবে সাভানার পুরো বাস্তুতন্ত্র ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
এত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পরও এখনো সেরাদো’র বড় অংশই অরক্ষিত রয়েছে। এর মূল এলাকা থেকে অর্ধেকেরও বেশি বন নিধন হয়েছে এবং বর্তমানে এর কেবল আট শতাংশ অঞ্চল সংরক্ষিত আছে।
‘স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ মাতো গ্রোসো’র অধ্যাপক বিআট্রিজ মারিমন বলেছেন, কোন কোন প্রজাতির গাছ আধিপত্য বিস্তার করছে ও বনের বিভিন্ন পরিবর্তনের প্রতি এরা কীভাবে সাড়া দিচ্ছে তা বুঝতে পারলে সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় সাহায্য হতে পারে এবং হুমকির মুখে থাকা বিভিন্ন এলাকা পুনরুদ্ধারেও সহায়ক হতে পারে।
এ অঞ্চলের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতির গাছের ওপর নজর দেওয়ার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, ভবিষ্যতে তারা বুঝতে পারবেন সাভানা পরিবেশ কিভাবে জলবায়ু পরিবর্তন ও বন নিধনের ক্ষেত্রে সাড়া দেবে, যা বিভিন্ন পুনরুদ্ধার প্রকল্পকে পথ দেখাতে সাহায্য করতে পারে।