Published : 02 Jan 2023, 05:23 PM
গেল বছরের প্রথম দিনেই শেয়ার বাজারে ছিল অ্যাপলের নতুন মাইল ফলক, ইতিহাসের প্রথম তিন লাখ কোটি ডলারের কোম্পানি! পিছিয়ে ছিল না গুগল-মাইক্রোফটও; বিশ্লেষকদের আলোচনার বিষয় ছিল কোম্পানিগুলোর পাঁচ লাখ কোটি ডলার বাজার মূলধন ছোঁয়ার সম্ভাব্যতা।
২০২২ সালের বাকিটা জুড়ে বিশ্ববাজারে প্রযুক্তি শিল্পের আধিপত্য আরও বাড়বে বলেই ধরে নিয়েছিলেন সবাই। মহামারীর লকডাউনে ডিজিটাল পণ্য আর সেবার বাড়তি চাহিদা শাপে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলোর জন্য। মার্কিন বাজারে সুদের হার প্রায় শূন্যের কাছাকাছি হওয়ায় স্টার্টআপ কোম্পানিগুলো জন্যেও চলছিল সুদিন।
কিন্তু ২০২২ শেষ হয়েছে ভিন্ন বাস্তবতায়। ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বাস্তবতায় বছর ঘুরতে না ঘুরতে বিশ্ববাজারের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পখাতে পরিণত হয়েছে সিলিকন ভ্যালিকেন্দ্রীক ব্যবসা খাতটি।
মহামারীর সময়ে যে চাহিদা বেড়েছিল, ২০২২ বছর জুড়ে তা কমে এসেছে, বেড়েছে মুদ্রাস্ফীতি আর সুদের হার, মন্দার শঙ্কায় খরচ কমিয়েছেন ভোক্তা ও বিজ্ঞাপনদাতা উভয় পক্ষ। বিশেষ করে বিজ্ঞাপনদাতারা খরচ কমানোয় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো; এ খাতের বহুল পরিচিত কোম্পানিগুলোর সিংহভাগের আয় আসে বিজ্ঞাপন থেকেই।
সার্বিক পরিস্থিতির ফলাফল– বিপর্যয় নেমে এসেছে সিলিকন ভ্যালিতে। পুরো শেয়ারবাজারে পতনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দাম কমেছে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর শেয়ারের; চাকরি হারিয়েছে প্রযুক্তিখাতের হাজারো কর্মী। খরচ কমাতে কর্মী ছাঁটাইয়ের পন্থা বেছে নিয়ে অ্যামাজন এবং মেটার মত জায়ান্ট থেকে শুরু করে লিফট, পেলোটন এবং স্ট্রাইপের মত ছোট কোম্পানিগুলোও। অন্যদিকে, কার্যত ধস নেমেছে ক্রিপ্টো মুদ্রা বাজারে।
বাজার ধসের উত্তাপ লেগেছে ২০২১ সালে বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তকমা পাওয়া মানুষটির গায়েও। ২০ হাজার কোটি ডলারের সম্পদ খুইয়েছেন ইলন মাস্ক।
সিএনএন বলছে, সিলিকন ভ্যালি তথা আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি শিল্পকে ঘিরে যে ‘অপরাজেয়’ আবহ বিরাজ করতো, তা কেটে গেছে ২০২২ সালে এসে। বছরের পর বছর কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতাদের দূরদর্শী নেতৃত্ব হিসেবে উপস্থাপন করে এসেছে সিলিকন ভ্যালি; কিন্তু হঠাৎ করেই সেই দূরদর্শী নেতারা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে দু বছরের মধ্যে কী হতে পারে তার কিছুই আঁচ করতে পারেননি তারা।
নভেম্বর মাসেই ফেইসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের উদ্দেশ্যে পাঠানো এক বার্তায় ১১ হাজার কর্মী ছাটাইয়ের ঘোষণা দিয়ে লিখেছিলেন, “দুর্ভাগ্যবশত, বিষয়টা আমি যেভাবে ভেবেছিলাম সেভাবে হয়নি।”
ঘোর কেটেছে সিলিকন ভ্যালির
২০২০ সালের শুরুর দিকে মহামারীর তোপে বিশ্ব অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রযুক্তি শিল্পের দৃশ্যপট ছিল একেবারেই ভিন্ন; আকারে বড় হচ্ছিল কোম্পানিগুলো, মানুষ ঘরে বসে কাজ করতে বাধ্য হওয়ায় যেন ক্ষমতাও বাড়ছিল তাদের। ওই সময়ের মধ্যে ফেইসবুক তথা হালের মেটা কর্মীদের সংখ্যা বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করেছে; ইন্টারনেটের কল্পিত ভবিষ্যৎ সংস্করণ ‘মেটাভার্স’ নির্মাণে শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে কোম্পানিটি।
অনলাইনে কেনাকাটার চাহিদা বাড়তে থাকায় নতুন কর্মী নিয়োগ দিয়ে মোট কর্মী সংখ্যা দ্বিগুণ করেছে ই-কমার্স জায়ান্ট অ্যামাজন।
“কোভিডের শুরুতে পুরো বিশ্ব খুব দ্রুত ইন্টারনেটমুখী হয়েছিল এবং ই-কমার্সের আকার বাড়ায় আয়ের আকারও বড় হচ্ছিল অস্বাভাবিক হারে। অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন যে মহামারী শেষেও এ পরিস্থিতি বজায় থাকবে। আমিও তাই ভেবেছিলাম, বিনিয়োগ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা,” কর্মীদের উদ্দেশ্যে লেখা মেমোতে বলেছিলেন জাকারবার্গ।
কিন্তু সে পরিস্থিতি একেবারেই পাল্টে গেছে।
“মানুষের ভবিষ্যৎ বোঝার ক্ষমতা খুবই বাজে এবং আমরা ধরেই নেই যে, যা এখন হচ্ছে সেটাই স্থায়ী হবে,” সিএনএনকে বলেছেন কলাম্বিয়া বিজনেস স্কুলের প্রোফেসর অ্যাঞ্জেলা লি। “বাস্তবতা হচ্ছে মহামারী ছিল একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা এবং আমাদের কেউই জানতো না যে সামনে কী হবে।”
একে একে নিজেদের ভুল স্বীকার করে নিয়েছেন সিলিকন ভ্যালির সেই ‘দূরদর্শী’ নেতারা। কোম্পানির আকার যে খুব দ্রুত বড় করেছেন এবং মহামারী পরবর্তী বিশ্ব নিয়ে অতিআশাবাদী ছিলেন – তা স্বীকার করে নিয়েছেন স্ট্রাইপ, ফেইসবুকের প্রতিষ্ঠাতারা।
নভেম্বর মাসে ১৪ শতাংশ কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দিয়ে কর্মীদের স্ট্রাইপ সিইও প্যাট্রিক কোলিশন বলেছেন, “২০২২ ও ২০২৩ সালে ইন্টরনেট অর্থনীতির বৃদ্ধি নিয়ে আমরা অতি আশাবাদী ছিলাম এবং সার্বিক বাজারে মন্দার শঙ্কাকে ছোট করে দেখেছি।”
ভোক্তারা অফলাইন জীবনে ফেরায় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে– এমন নয়। সিএনএন বলছে, মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর গায়ে সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়ানোর ফলে। অন্যান্য শিল্পখাতের চেয়ে সিলিকন ভ্যালি কেন্দ্রীক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চাকাঙ্ক্ষী নতুন প্রকল্পগুলোর তহবিলের জন্য কম সুদের ঋণের ওপর নির্ভর করতো বেশি।
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ২০২২ সালে সাতবার সুদের হার বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বছরের শেষে এসে অ্যাপলের বাজার মূলধনের আকার কমে স্থিতিশীল হয়েছে দুই লাখ কোটি ডলারের কিছুটা ওপরে। বছর জুড়ে অ্যামাজন শেয়ারের দরপতন হয়েছে ৫০ শতাংশ। আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফেইসবুকের মূল কোম্পানি মেটা; ২০২২ সালে বাজার মূলধনের দুই-তৃতীয়াংশই খুইয়েছে কোম্পানিটি।
প্রযুক্তি শিল্প কী হারানো জৌলুসে ফিরতে পারবে?
নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্রযুক্তি শিল্প ভাবনাই পাল্টে গেছে বলে লিখেছে সিএনএন। বিনিয়োগের লাগাম টেনে ধরেছেন সিংহভাগ বিনিয়োগকারী। ২০২০ বা ২০২১ সালে যে বিনিয়োগ চুক্তিগুলো নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবেননি বিনিয়োগকারীরা, ঠিক একই ধরনের চুক্তি থেকে তারা পিছিয়ে আসছেন বলে লিখেছে সিএনএন।
এতে প্রযুক্তি উদ্যোক্তারা আপাতত বিপাকে পড়লেও এ পরিস্থিতি দীর্ঘমেয়াদে পুরো শিল্পের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা। শিল্পখাতের ‘আগাছাগুলো’ পরিষ্কার করার জন্য এ ধরনের একটা পরিস্থিতির প্রযোজন ছিল বলে আগেই থেকেই বলে আসছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে। দিনশেষে এতে প্রতিশ্রুতিশীল কোম্পানিগুলোর টিকে থাকার সম্ভাবনাই বাড়বে বলে মত তাদের।
সিএনএন লিখেছে, বর্তমান পরিস্থিতিকে প্রযুক্তি শিল্পের স্বাভাবিক পর্যায়ে ফেরা হিসেবে দেখছেন প্রযুক্তি খাতের বিশেষজ্ঞরা। তবে, আপাতত খুব শিগগিরই কোনো সুদিনের আভাস নেই সিলিকন ভ্যালির কোম্পানিগুলোর জন্য।
২০২৩ সালেও কর্মী ছাঁটাই অব্যাহত থাকবে বলে কর্মীদের উদ্দেশ্যে লেখা এক চিঠিতে বলেছেন অ্যামাজন প্রধান অ্যান্ডি জ্যাসি। অন্তত ১০ হাজার কর্মী ছাটাইয়ের পরিকল্পনা করে রেখেছে অ্যামাজন।