Published : 22 May 2025, 10:18 AM
প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজের উত্তেজনাপূর্ণ বৈঠকে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসাকে শ্বেতাঙ্গ গণহত্যা ও জমি দখলের মিথ্যা দাবির মুখোমুখি করে চাপে ফেলার চেষ্টা করেছেন।
বুধবারের এ বৈঠকটি ফেব্রুয়ারিতে হোয়াইট হাউজে ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে হঠাৎ আক্রমণের মাধ্যমে ট্রাম্প যেভাবে হতচকিত করে দিয়েছিলেন তার কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে; লিখেছে রয়টার্স।
বিশ্বের সর্বোচ্চ হারের হত্যাকাণ্ডের একটি দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু এসব খুনের পরিষ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ শিকার দেশটির কৃষ্ণাঙ্গরা।
জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্প দক্ষিণ আফ্রিকার অতি প্রয়োজনীয় সহায়তা বাতিল করেন, শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘু আফ্রিকানদের আশ্রয় দেওয়ার প্রস্তাব দেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেন এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দেশটির দায়ের করা গণহত্যার মামলার সমালোচনা করেন।
বুধবারের বৈঠকটিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার দেশের সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে ব্যবহার করার আশা করেছিলেন রামাফোসা, কিন্তু সাজানো ও পরিকল্পিত আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট আক্রমণাত্মক অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুতি নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছেন। তিনি তার প্রতিনিধি দলের অংশ করে দক্ষিণ আফ্রিকার জনপ্রিয় শ্বেতাঙ্গ গল্ফ খেলোয়াড়দের নিয়ে গিয়েছেন আর বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা করতে চান বলে জানিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার, তবে দেশটি ট্রাম্পের বর্তমানে স্থগিত আমদানি করের আওতায় ৩০ শতাংশ শুল্কের মুখোমুখি হয়েছে।
কিন্তু ওভাল দপ্তরের বৈঠকে সতর্কভাবে পরিকল্পিত ও সাজানো আক্রমণে ট্রাম্প দ্রুত শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকানদের সঙ্গে আচরণ নিয়ে উদ্বেগের এক তালিকা তুলে ধরেন, একটি ভিডিও দেখিয়ে ও সংবাদপত্রে প্রকাশিত নিবন্ধের স্তূপ তুলে ধরে তার অভিযোগ প্রমাণিত বলে দাবি করেন।
ট্রাম্পের অনুরোধে তার ওভাল দপ্তরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে একটি টেলিভিশনে ভিডিওটি প্রদর্শিত হয়। সম্ভবত এই বৈঠককে সামনে রেখে টেলিভিশনটি ওভাল দপ্তরে স্থাপন করা হয়। ভিডিওতে সাদা সাদা ক্রস দেখা যায়, যেগুলোকে শ্বেতাঙ্গদের কবর বলে দাবি করেন ট্রাম্প। ভিডিওতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরোধীদলীয় নেতাদের উত্তেজনাপূর্ণ বক্তব্য দিতে দেখা যায়। জুলিয়াস মালেমা নামের এই নেতাদের একজনকে গ্রেপ্তার করা উচিত বলে ট্রাম্প মন্তব্য করেন।
রয়টার্স জানিয়েছে, ওই ভিডিওটি ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে একটি প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলাকালে ধারণ করা হয়েছিল। এর এক সপ্তাহ আগে নিজেদের খামারে দুই ব্যক্তি নিহত হওয়ার প্রতিবাদে এই বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়েছিল। ওই ক্রসগুলো সত্যিকারের গোরস্তানের ছিল না। ওই সময় দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যমকে প্রতিবাদ বিক্ষোভ আয়োজনকারীদের একজন বলেছিলেন, এইসব ক্রস বছরের পর বছর ধরে নিহত কৃষকদের প্রতিনিধিত্ব করছে।
আর ট্রাম্প বিশেষভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের কথা উল্লেখ করে বলেন, “আমাদের এখানে অনেক মানুষ আছে যারা মনে করে তারা নির্যাতিত হচ্ছে আর তারা যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসছে। তাই আমরা অনেক স্থান থেকে নেই যদি আমরা মনে করি সেখানে নির্যাতন বা গণহত্যা ঘটছে।
“লোকজন নিজেদের নিরাপত্তার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে পালাচ্ছে। তাদের জমি দখল করে নেওয়া হচ্ছে আর বহু ক্ষেত্রে তাদের হত্যা করা হচ্ছে।”
ট্রাম্পের কথায়, তার মিত্র দক্ষিণ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত ইলন মাস্ক সোচ্চার সমর্থনে এক সময়ে অন্তত এক দশক ধরে বিশ্বব্যাপী অতি ডানপন্থি ডিজিটাল স্পেস ফোরামগুলোতে প্রচারিত ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। ওভাল দপ্তরে বৈঠকটি চলাকালে মাস্কও সেখানে ছিলেন।
রামাফোসা ট্রাম্পের পাশের একটি চেয়ারে বসেছিলেন আর ট্রাম্পের এসব অভিযোগের মুখেও স্থির ছিলেন আর কৌশলে কথা বলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট তার সফরসঙ্গী গলফ খেলোয়াড় আর্নি এলস ও রেটিফ গুসেন এবং ধনকুবের ইয়োহান রুপার্টদের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “যদি আফ্রিকার কৃষক গণহত্যা হতো, আমি আপনার সঙ্গে বাজি ধরতে পারি, এই তিন ভদ্রলোক তাহলে এখানে থাকতেন না।”
রামাফোসার ওই তিন সফরসঙ্গীর সবাই শ্বেতাঙ্গ আর তারা বৈঠকের সময় ওভাল দপ্তরে উপস্থিত ছিলেন।
তবে এতে ট্রাম্প সন্তুষ্ট হননি। তিনি বলেন, “এই নিয়ে কথা বলার মতো হাজার হাজার গল্প আছে আমাদের কাছে। আমাদের কাছে তথ্যচিত্র আছে, নতুন গল্প আছে। এর জবাব দিতে হবে।”
রামাফোসা বলেন, ওই ভিডিওটি তিনি আগে দেখেননি এবং ঘটনাস্থলটি বের করার চেষ্টা করবেন।
এ পর্যায়ে ট্রাম্প প্রিন্ট করা সংবাদ নিবন্ধের কপি তুলে ধরে জানান, এসব নিবন্ধে নিহত শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকানদের কথা বলা হয়েছে। একের পর এক সংবাদ নিবন্ধের কপি উল্টাতে উল্টাতে তিনি বলেন, “মৃত্যু, মৃত্যু” আর এরপর কপিগুলো রামাফোসারর হাতে দিয়ে দেন।
রামাফোসা বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় অপরাধ আছে আর এগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ শিকারই কৃষ্ণাঙ্গরা। ট্রাম্প কথার মাঝখানে তাকে বাধা দিয়ে বলেন, “কৃষকরা কৃষ্ণাঙ্গ না।”
উত্তরে রামাফোসা বলেন, “এই উদ্বেগগুলো নিয়ে আমরা আপনার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছুক।”
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট শান্তি স্থাপনকারীর উদাহরণ হিসেবে ম্যান্ডেলার কথা উল্লেখ করলেও তাতে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে টলানো যায়নি, যার সমর্থকদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীরাও অন্তর্ভুক্ত। দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘শ্বেতাঙ্গ গণহত্যা’ যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য জায়গার উগ্র ডানপন্থিদের মধ্যে একটি আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে।
ট্রাম্প উল্লেখ করেন, “আমি বলবো: বর্ণবৈষম্য, ভয়াবহ। এটা বর্ণবাদের বিপরীত এক ধরন।”
এই ওভাল দপ্তরে ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ট্রাম্প ও মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের কাছে তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হওয়ার তিন মাস পর বিদেশি এক রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে আরেকটি নজিরবিহীন বৈঠক হল। এতে বিদেশি নেতারা ট্রাম্পের আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে আর প্রকাশ্যে বিব্রত হওয়ার ঝুঁকি নিতে ইতস্তত করতে পারেন বলে লিখেছে রয়টার্স।
তবে জেলেনস্কি ট্রাম্পের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে সময়ের আগেই হোয়াইট হাউজ ছাড়তে বাধ্য হলেও রামাফোসা পুরো সময়জুড়েই স্থির ছিলেন, ট্রাম্প যেভাবে তার দপ্তর সাজিয়েছেন তার প্রশংসা করেন আর জানান, তিনি জি ২০-র সভাপতিত্ব হস্তান্তর করার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
নভেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জি২০ সম্মেলনে ট্রাম্প উপস্থিত থাকবেন কিনা তা জানাতে রাজি হননি। দক্ষিণ আফ্রিকার পর জি২০-র সভাপতি হবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।
বৈঠকের রামাফোসা সাংবাদিকদের জানান, দুই দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ খনিজ নিয়ে আলোচনা বিষয়ে সম্মত হয়েছে। তার বাণিজ্যমন্ত্রী জানান, দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার একটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রস্তাব জমা দিয়েছে যেটিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস কেনার কথা বলা হয়েছে।
আর রামাফোসা তার দেশে শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী সহিংসতার কথিত ঢেউ নিয়ে করা ট্রাম্পের অভিযোগ পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, “দক্ষিণ আফ্রিকায় কোনো গণহত্যার নেই।”