Published : 04 Apr 2025, 09:38 AM
সামরিক আইন জারির কারণে প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলকে অভিশংসনের যে সিদ্ধান্ত দক্ষিণ কোরিয়ার পার্লামেন্ট নিয়েছিল, তাতে সম্মতি দিয়েছে দেশটির সাংবিধানিক আদালত।
আদালতের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মুন হিউং-বে শুক্রবার রায় ঘোষণার শুরুতেই বলেন, প্রেসিডেন্ট ইউনকে অপসারণের ‘যথেষ্ট কারণ’ রয়েছে।
"বিবাদী (প্রেসিডেন্ট ইউন) সামরিক ও পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব দুর্বল করেছেন এবং জনগণের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করেছেন।
“আর এর মধ্য দিয়ে তিনি সংবিধান রক্ষার সাংবিধানিক দায়িত্বের জলাঞ্জলি দিয়েছেন এবং কোরিয়ার জনগণের সঙ্গে গুরুতর বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।"
বিবিসি লিখেছে, সাংবিধানিক আদালতের এই রায় সর্বসম্মত। এই রায়ের ফলে দক্ষিণ কোরিয়াকে ৬০ দিনের মধ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হবে।
বিদ্রোহের আরো একটি অভিযোগ রয়েছে ইউন সুক-ইওলের বিরুদ্ধে। বিষয়টি এখনো বিচারের অপেক্ষায়।
গতববছর ৩ ডিসেম্বর হঠাৎ সামরিক আইন জারি করে সবাইকে হতভম্ব করে দেন প্রেসিডেন্ট ইউন। তিনি দাবি করেন, সরকারে ‘রাষ্ট্রবিরোধী ও উত্তর কোরিয়াপন্থি’ শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
জনগণ ও পার্লামেন্টের চাপে প্রায় ছয় ঘণ্টা পর তিনি সামরিক আইন তুলে নিলেও দক্ষিণ কোরিয়া গভীর রাজনৈতিক সংকটে পড়ে যায়।
পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেছেন, বিরোধী রাজনীতিবিদদের আটক করার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ইউন, যাতে পার্লোমেন্ট প্রেসিডেন্টের আকস্মিক সামরিক শাসন প্রত্যাহার করতে না পারে।
এই সামরিক আইন জারিকে কেন্দ্র করে ১৪ ডিসেম্বর পার্লামেন্ট প্রেসিডেন্ট ইউনকে অভিসংশিত করে। অভিশংসিত হওয়ার পর তাকে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। এখন একজন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট দক্ষিণ কোরিয়ার প্রশাসনিক কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন।
রায়ে বিচারক বলেন, "এ ধরনের বেআইনি ও অসাংবিধানিক কার্যকলাপ সংবিধানের আওতায় কোনোভাবেই সহ্য করা যায় না।
"এই কর্মকাণ্ডের গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে এবং এর প্রতিক্রিয়া হতে পারে দীর্ঘমেয়াদী। একজন প্রেসিডেন্টের পদচ্যুত করার কারণে জাতীয়ভাবে যতটা ক্ষতি হবে, তার চেয়ে সংবিধানিক শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
এই বিচার প্রক্রিয়ায় অভিশংসন প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ডেমোক্রেটিক পার্টির পার্লামেন্ট সদস্য জাং চুং-রে এই রায়কে বর্ণনা করেন ‘সংবিধান, গণতন্ত্র ও জনগণের বিজয়’ হিসেবে।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “আমি সেই জনগণকে ধন্যবাদ দিতে চাই, যারা গণতন্ত্র দিয়ে গণতন্ত্রের শত্রুকে পরাজিত করেছে।”
অন্যদিকে ইউনের আইনজীবী ইউন গ্যাপ-গান বলেন, “এই বিচার প্রক্রিয়া পুরোপুরি বেআইনি, এটা স্রেফ অবিচার।”
রায়ের পর সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে এই রায় আমাদের কাছে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এটা পুরোপুরি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যা খুবই দুঃখজনক।”
এই রায় ঘিরে ইউন সুক-ইওলের বিরোধিতাকারী ও পক্ষের লোকজন সকাল থেকেই সিউলের কেন্দ্রস্থলে জড়ো হন। সংঘাতের আশঙ্কায় শহরে নেওয়া হয় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
রায়ের পর উল্লাসে ফেটে পড়েন ইউন সুক-ইওলের বিরোধিতাকারীরা। বিবিসি লিখেছে, তাদের উচ্ছ্বাস দেখে মনে হচ্ছিল, দক্ষিণ কোরিয়া বুঝি বিশ্বকাপ জিতেছে।
শহরের কেন্দ্রে একটি স্কয়ারে জড়ো হওয়া হাজারো মানুষ টিভি পর্দায় রায় শোনার পর একসঙ্গে লাফিয়ে ওঠেন, যেন এই মাত্র জয়সূচক গোলটি হয়েছে।
ইউন সুক-ইওলের অভিশংসনে সাংবিধানিক আদালত সম্মতি দেওয়ার পর জনতা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গোল হয়ে নাচতে শুরু করে। বাতাসে উড়তে থাকে শত শত পতাকা। একটি বুদবুদ ছাড়ার মেশিনও সেখানে দেখা যায়।
৬৬ বছর বয়সী উন সনহি বলেন, “আমি নিজেকে শান্ত রাখতে পারছি না। এই রায়ে আমি খুব খুশি। শুধু দুঃখ হয় যে, এই সিদ্ধান্ত নিতে এত দেরি হয়েছে।”
২৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থী জুনহা লি বলেন, “ডিসেম্বরে যখন সামরিক শাসন জারি করা হয়, তখন মনে হয়েছিল এপ্রিল ফুল অনেক আগেই চলে এসেছে।”
তিনি বলেন, “আজকের এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত প্রত্যক্ষ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আমি আবেগে কাঁপছি।”
দক্ষিণ কোরিয়ার সংবাদ সংস্থা ইয়োনহাপ জানিয়েছে, পার্লামেন্টের বিরোধী দল ডেমোক্রেটিক পার্টি সাংবিধানিক আদালতের রায়কে ‘জনগণের জন্য একটি বিশাল বিজয়’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
অন্যদিকে ইউন সুক-ইওলের সমর্থক শিবিরে তখন ক্ষোভ আর হতাশা। তাদের ভাষায়, আদালতের এই সিদ্ধান্ত ‘কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়’।
৬০ বছর বয়সী কিম ইয়ংতায়ে বিবিসিকে বলেন, “এটি কোরিয়ান সমাজের পতনের সংকেত।”
তিনি বলেন, “আমরা এখন বিরোধীদের দ্বারা শাসিত হচ্ছি। জনগণের উচিত গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য জেগে ওঠা। আমি বিচারকদের কখনও ক্ষমা করব না, তারা পুরোপুরি দুর্নীতিগ্রস্ত।”
বিচারককে যখন টিভিতে রায় পড়তে দেখা যাচ্ছিল, তখন ইউনের সমর্থকদের দিক থেকে তীব্র গালাগাল শোনা যাচ্ছিল।
একজন নারী চিৎকার করে বলছিলেন, “মিথ্যাবাদী! বিচারকরা সবাই মিথ্যাবাদী!”
তবে ইউনের দল ক্ষমতাসীন ‘পিপল পাওয়ার পার্টি’ বলেছে, তারা আদালতের রায় মেনে নিচ্ছে এবং কোরিয়ার জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছে।
এদিকে সাংবিধানিক আদালতের কাছে এক পুলিশ বাসের জানালা ভাঙচুরের অভিযোগে ইউনপন্থী এক বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে খবর দিয়েছে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম।
প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, বডি আর্মার, গ্যাস মাস্ক ও হেলমেট পরিহিত এক ব্যক্তি লম্বা একটি লাঠি দিয়ে বাসের জানালায় আঘাত করছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, কয়েকজন তাকে থামানোর চেষ্টা করেছিল। পরে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের বরাতে বিবিসি লিখেছে, দক্ষিণ কোরিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হান ডাক-সু জননিরাপত্তার স্বার্থে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন।
তিনি বলেছেন, তার প্রশাসন দেশের নিরাপত্তা বজায় রাখবে এবং পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত তিনিই ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
বিবিসি লিখেছে, ইউনের বিদায় হলেও দক্ষিণ কোরিয়ার সংকট এখনো কাটেনি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল–ইউন ও তার সমর্থকরা রায় মেনে নেবেন কি না।
ইউন ও তার আইনজীবীরা বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে আদালতের সমালোচনা করেছেন। তার উগ্র সমর্থকেরা আদালতকে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ বলেছে।
যদি তারা সাংবিধানিক আদালতের রায় মেনে না নেন, তাহলে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক সংকট আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।
ইউন যদি রায় মেনেও নেন, কোরিয়ায় যে গভীর বিভক্তি তৈরি হয়েছে, তা সহজে দূর হওয়ার নয়। সামনের নির্বাচনও হবে অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনায় পরিপূর্ণ।