Published : 16 Jun 2025, 09:44 PM
‘আটকা পড়ে আছি’—এই একটি শব্দই ইরানে এই মুহূর্তে জীবন কেমন তা বোঝাতে বিবিসি-কে বলেছেন অধিকাংশ মানুষ।
ইসরায়েলের তিনদিনের লাগাতার হামলার পর ‘সবাই কোনও না কোনওভাবে তেহরান ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছে,’ বিবিসি নিউজ পার্সিয়ানকে বলেন এক বাসিন্দা।
রোববার ইরানের রাজধানী তেহরানের শহরজুড়ে পেট্রোল স্টেশনগুলোতে দেখা যায় দীর্ঘ সারি। অনেকেই শহর ছেড়ে দূরের গ্রামে বা তুলনামূলক নিরাপদ জায়গায় যেতে চাইছেন। কিন্তু তীব্র যানজটে অনেকে প্রদেশের বাইরেই যেতে পারছেন না।
তেহরানের বাসিন্দারা আতঙ্কে আছেন। তারা কোথাও নিরাপদ বোধ করছেন না। বিবিসি-কে এক বাসিন্দা বলেন, “তেহরান মোটেও নিরাপদ নয়। ইসরায়েলের হামলা নিয়ে সরকার পক্ষ থেকে আমাদেরকে কোনও সাইরেন বা আগাম সতর্কতা দেওয়া হয় না।
“আমরা কেবল বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই। আর আশা করি যেন আমাদের ঘরে না লাগে। কিন্তু কোথায়ই বা যাব? কোথাও তো নিরাপদ মনে হয় না।”
তেহরান ছেড়ে অন্য প্রদেশে যেতে পেরেছেন এমন একজন বলেন, তিনি এখনও মেনে নিতে পারছেন না যে, তিনি একটি যুদ্ধক্ষেত্রে আছেন।
“এই বাস্তবতা মেনে নিতে কত দিন লাগবে জানি না। এই যুদ্ধ আমার নয়। আমি কোনও পক্ষকে সমর্থন করছি না। আমি কেবল আমার পরিবারসহ বাঁচতে চাই”, বলেন তিনি।
গত শুক্রবার থেকে ইসরায়েল ইরানের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিমান হামলা চালিয়েছে। এর পাল্টায় ইরানও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে।
ইসরায়েলের কর্মকর্তারা বলছেন, এই হামলায় দেশটিতে এখন পর্যন্ত অন্তত ১৯ জন নিহত হয়েছেন। আর ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, ইসরায়েলি হামলায় দেশজুড়ে এখন পর্যন্ত ২২৪ জন নিহত হয়েছেন।
তেহরানের এক নারী বলেন, “আমি দু’রাত ঘুমাতে পারিনি।” ১৯৮০ ‘র দশকের ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময়কার স্মৃতি ফিরে আসছে জানিয়ে এই নারী বলেন, তখন তিনি শিশু ছিলেন। তবে ওই সময় অন্তত সাইরেন বাজত। এখন তাও বাজে না, শুধু বিস্ফোরণের শব্দ কানে আসে।”
বিবিসি পার্সিয়ান সার্ভিসের সাংবাদিক হাবিবিয়াজাদ বলেন, ইরানের তরুণ প্রজন্ম—যারা যুদ্ধ দেখেনি—তাদের জন্য এই অভিজ্ঞতা একেবারেই নতুন।
তেহরানের আরেক নারী বলেন, “অনেকেই ছোট শহর বা গ্রামে চলে যেতে চাইছেন, কিন্তু আমাদের প্রিয়জনেরা এই শহরেই আছে। তাদের ফেলে যাওয়া যাচ্ছে না। আমরা যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তা আমাদের ইরানের জনগণের কারও জন্যই ন্যায্য নয়।
“ভয়, ক্লান্তি আর মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে আমরা সবাই দিন পার করার চেষ্টা করছি। এটা খুবই কঠিন আর যন্ত্রণাদায়ক। ”
আরেক বাসিন্দা বলেছেন, “আমি তো যেতে পারি না। আমার বাবা-মা বৃদ্ধ, ওরা দূরে কোথাও যেতে পারবে না। আমার নিজেও অফিসে যেতে হয়। আমি কী করব?”
দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ অনিয়মিত হওয়ায় অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করাও কঠিন হচ্ছে। দেশের বাইরে থাকা ইরানিরা তাদের প্রিয়জনের খোঁজে মেসেজ দিয়েও জবাব পাচ্ছেন না।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের সেনাবাহিনী ইরানিদের সামরিক স্থাপনার কাছাকাছি এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার সতর্কবার্তা দিয়েছে।
তেহরানের মানুষ এমন বার্তা পেয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। এক তেহরানবাসীর প্রশ্ন—“আমরা কীভাবে বুঝব কোনটা সামরিক এলাকা, আর কোনটা না?”
ইরানে হামলার দ্বিতীয় দিনে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানিদেরকে বার্তা দিয়ে বলেছিলেন, “এখন সময় এসেছে এক হওয়ার, স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়ানোর।”
কিন্তু বিবিসি নিউজ পার্সিয়ানের সাংবাদিক দারিয়ুশ কারিমি বলেছেন, ইরানে মানুষ এখনও নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। নেতানিয়াহুর আহ্বান সেখানে সাড়া জাগায়নি।
বিবিসি নিউজ পার্সিয়ানের আরেক সাংবাদিক জানান, ইরানে পারমাণবিক স্থাপনা এবং বিমানঘাঁটির ওপর ইসরায়েলের হামলার চেয়েও সাধারণ মানুষের মনে বেশি ধাক্কা লেগেছে আবাসিক ভবনগুলো হামলায় ধ্বংস হওয়ার ঘটনায়।
অনেক ইরানিই ইরাক-ইরান যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এমন দৃশ্য দেখেনি। বিশেষ করে রাজধানীর রাস্তায় এমন ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী হয়নি তারা।
তেহরানসহ অন্যান্য শহরের মানুষ এখনও গত শুক্রবারের বিভ্রান্তি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। আসলে সেদিন কী ঘটছিল? হামলা কতটা বিস্তৃত ছিল? কীভাবে নিজেদেরকে এবং পরিবারকে রক্ষা করবেন—এসব প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজে ফিরছেন তারা।
ইরানের সাধারণ মানুষের জীবন এখন এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে- যেখানে নিরাপত্তাহীনতা আর আতঙ্ক তাদের প্রতি মুহূর্তকে গ্রাস করে রেখেছে।