Published : 14 Jun 2025, 12:37 PM
ইসরায়েলের হামলার পর তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আদৌ আর আছে কি না, তা নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প সন্দেহ প্রকাশ করলেও এখন পর্যন্ত ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ক্ষয়ক্ষতি খুব একটা বেশি নয় বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
শুক্রবার ভোররাত থেকে ইসরায়েল ইরানের সামরিক নেতৃত্ব, পরমাণু বিজ্ঞানী, একাধিক সামরিক স্থাপনা ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় সফল হামলা চালাতে পারলেও পারমাণবিক স্থাপনায় তাদের হামলায় তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলেই উপগ্রহের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এমনটাই বলেছেন একাধিক বিশেষজ্ঞ।
“প্রথম দিনের লক্ষ্য ছিল চমকে দেওয়া, নেতৃত্বকে হত্যা করা, এরপর পরমাণু বিজ্ঞানীরা, তারপর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও পাল্টা আঘাতের সক্ষমতা কমানো। কিন্তু আমরা ফোরদো বা ইস্ফাহানে কোনো দৃশ্যমান ক্ষয়ক্ষতি দেখিনি। নাতাঞ্জে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু ভূগর্ভস্থ সাইটটি ধ্বংস হয়েছে এর কোনো প্রমাণ নেই,” বলেছেন ইনস্টিটিউট ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটির পরমাণু বিশেষজ্ঞ ডেভিড অলব্রাইট।
শুক্রবার জাতিসংঘের আনবিক শক্তি সংস্থার (আইইএই) প্রধান রাফায়েল গ্রোসি নিরাপত্তা পরিষদকে বলেছেন, ইরানের নাতানজ পারমাণবিক স্থাপনায় মাটির উপরে থাকা সমৃদ্ধকরণের পাইলট কেন্দ্র ধ্বংস হয়ে গেছে এবং ইরান তাদের ফোরদো ও ইস্ফাহানের পারমাণবিক স্থাপনায়ও হামলা হওয়ার খবর দিয়েছে।
গ্রোসি বলেছেন, নাতানজের বৈদ্যুতিক কাঠামোও ধ্বংস হয়েছে এবং ক্যাসকেড হলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় সেখানে হয়তো সেন্ট্রিফিউজগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তবে নাতাঞ্জের বাইরে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা বদলায়নি এবং স্বাভাবিক রয়েছে, বলেছেন তিনি।
বিস্তৃত নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনাই ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র। এ স্থাপনার মধ্যে আছে বিশাল ভূগর্ভস্থ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র এবং মাটির উপরে একটি ছোট পাইলট সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র।
টেলিফোনে রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছেন, ইসরায়েলের হামলার পর ইরানের আদৌ কোনো পরমাণু কর্মসূচি আছে কি না তা নিয়ে তিনি সন্দিহান।
“কেউ জানে না। কিন্তু এটা ছিল বিধ্বংসী আঘাত,” বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
শুক্রবারের হামলায় ইরানের অন্তত ২০ সামরিক কমান্ডার নিহত হয়েছে বলে দুটি আঞ্চলিক সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে; গত বছর লেবাননের হিজবুল্লাহ মূল নেতৃত্বকেও ইসরায়েল এভাবেই মাত্র অল্প সময়ের ব্যবধানেই ছেঁটে ফেলেছিল।
ইসরায়েলের হামলায় ছয় শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীর মৃত্যুর খবরও নিশ্চিত করেছে ইরান।
অলব্রাইট বলছেন, তিনি ইরানের পরমাণু স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে যে পর্যালোচনা দিয়েছেন, তার ভিত্তি হচ্ছে শুক্রবার তেহরান সময় সকাল ১১টা ২০ পর্যন্ত পাওয়া ছবি।
স্থাপনাগুলোর টানেলে ড্রোন দিয়ে হামলা হতে পারে, হতে পারে সাইবার হামলাও। এসবে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হলেও উপর থেকে তা বোঝা নাও যেতে পারে।
“দৃশ্যমান ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় খুব একটা কিছু হয়নি, দেখা যাক আজ রাতে কি হয়,” ইসরায়েলের হামলা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে মনে করে শুক্রবার এমনটাই বলেছেন তিনি।
ইসরায়েলি বাহিনী ওই রাতেও ইরানের বেশ কয়েকটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার দাবি করেছে, তবে তাতে কী ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা এখনও স্পষ্ট নয়।
অলব্রাইট বলছেন, ইরানের কাছে কি পরিমাণ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে তা অজানা। হতে পারে, ইসরায়েল পরমাণু স্থাপনাগুলোতে বড় ধরনের হামলা থেকে বিরত থেকেছে সেখানে থাকা আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের কথা ভেবে।
নাতাঞ্জের ভূগর্ভস্থ কেন্দ্রে অন্তত কয়েক হাজার সেন্ট্রিফিউজ আছে, এবং সেখানে বৈদ্যুতিক সরবরাহ বন্ধ হলে ব্যাকআপ ব্যাটরি চালু হওয়ার কথা, বলছেন অলব্রাইট।
সম্ভবত ইরান ‘নিয়ন্ত্রিত উপায়ে’ ওই ভূগর্ভস্থ কেন্দ্রের সেন্ট্রিফিউজগুলো বন্ধ করছে, যা বেশ ‘বড়সড় অপারেশন’।
“ব্যাটারি সাধারণত অনেকক্ষণ থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা শেষ হয়ে আসবে এবং যদি অনিয়ন্ত্রিত উপায়ে সেন্ট্রিফিউজগুলো বন্ধ করা হয়, তাহলে অনেক কিছুই ঘটতে পারে,” বলেছেন তিনি।
ইসরায়েল বলছে, ইরানে তাদের অভিযান ‘রাইজিং লায়নস’ কেবল শুরু, এবং তেহরানের পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর সক্ষমতা পুরোপুরি অকার্যকর করে দেওয়ার এ অভিযান কয়েক দিন ধরে চলতে পারে।
সামরিক ও পরমাণু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েলের কাছে যেসব অস্ত্র আছে তার সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে হয়তো ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের সম্ভাবনা খানিকটা কমানো যাবে, কিন্তু একেবারে শেষ করা যাবে না।
ইরান যদিও বলছে, পারমাণবিক অস্ত্র বানানো তাদের লক্ষ্য নয়, তাদের কর্মসূচি একেবারেই শান্তিপূর্ণ। কিন্তু তেল আবিব ও তার মিত্রদের ধারণা, তেহরান এরই মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।
মিডলবুরি ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তাররোধ বিশেষজ্ঞ জেফরি লুইস বলছেন, তার ধারণা নাতাঞ্জের স্থাপনার ক্ষতি হয়েছে ‘মাঝারি ধরনের’।
“ইসরায়েল পাইলট জ্বালানি সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র ধ্বংস করেছে, সঙ্গে ধ্বংস করেছে কিছু সহায়ক ভবন যেগুলো বিদ্যুৎ সরবরাহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
“ভূগর্ভস্থ সমৃদ্ধকরণ হল, তার পাশাপাশি কাছাকাছি পাহাড়ে থাকা সুবিশাল ভূগর্ভস্থ স্থাপনা মনে হচ্ছে অক্ষতই আছে,” বলেছেন তিনি।
ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায় কেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না। ইরান পরমাণু অস্ত্র বানালে এই স্থাপনাটিই ব্যবহারের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি বলে অনেকে মনে করেন। এটি মাটির অনেক গভীরে বিস্তৃত।
“প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা ছাড়া ইসরায়েলের কাছে ফোর্দোকে ধ্বংস করার মতো অস্ত্র নেই,” এক পডকাস্টে এমনটাই বলেছেন থিংকট্যাঙ্ক ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসির প্রধান মার্ক ডুবোউইটজ।
যুক্তরাষ্ট্রের ভাণ্ডারে ৩০ হাজার পাউন্ড (১৪ হাজার কেজি) ওজনের শক্তিশালী বাঙ্কার বিস্ফোরক বোমা আছে।
ইরান যদি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে রাজি না হয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তার বিটু বোমারু বিমানগুলো ফরদো ধ্বংসে কাজে লাগাতে পারে, বলছেন ডুবোউইটজ।
ক্যান কর্প গবেষণা গোষ্ঠীর কৌশল বিশ্লেষক ডেকার এভেলেথের মতে, ইসরায়েলের অভিযানের আসল লক্ষ্যই এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়।
“তারা হয়তো ইরানের কমান্ড ও কন্ট্রোল ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়া, বিমানবাহিনী ধ্বংস করা, এবং ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি সংশ্লিষ্ট নানা লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়ে সফল হতে পারে। (তবে) যদি তাদের মূল লক্ষ্য হয় পারমাণবিক বিস্তার রোধ করা, তাহলে প্রশ্ন হলো—তারা কি ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামোর এতটা ক্ষতিসাধন করতে পারবে, যাতে সত্যিই সেটা ঠেকানো যায়?” বলেছেন তিনি।