Published : 24 Sep 2024, 07:51 PM
নয়াদিল্লিতে একটি সেমিনারে অংশ নিতে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন জান্তার রাজনৈতিক ও সামরিক বিরোধীদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে ভারত।
মিয়ানমারের জান্তা সরকারের শীর্ষ জেনারেলদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সম্পর্ক বজায় রেখেছে ভারত, যে জেনারেলদেরকে বয়কট করে আসছে পশ্চিমা দেশগুলো। এমন পরিস্থিতিতে জান্তা বিরোধীদের ভারতের আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত উল্লেখযোগ্য এক নজিরবিহীন পদক্ষেপ।
২০২১ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ চলছে দেশটিতে।
ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারের ১ হাজার ৬৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। এছাড়া, দেশটিতে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পেও বিনিয়োগ আছে দিল্লির।
মিয়ানমারের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর নেতা এবং বিষয়টি সম্পর্কে সরাসরি অবহিত দুটি সূত্র জানায়, মিয়ানমারের জান্তা-বিরোধী জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) এবং চিন, রাখাইন ও ভারত সীমান্তবর্তী কাচিন সম্প্রদায়ের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে আগামী নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে নয়াদিল্লির সেমিনারে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও দুটি সূত্র জানিয়েছে, ভারত সরকারের অর্থায়নপুষ্ট সংস্থা ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স’ (আইসিডব্লিউএ) সেমিনারের আয়োজন করবে, যার শীর্ষ সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারকেও অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হবে কিনা তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। সূত্রটি জানিয়েছে, এ অনুষ্ঠানটি সংবিধান এবং কেন্দ্রীয় শাসন পদ্ধতি সেমিনারের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হতে পারে। তবে বিস্তারিত আর কিছু জানায়নি তারা।
২০২১ সালের অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে মিয়ানমারজুড়ে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ বিদ্রোহে রূপ নেয়। কিছু প্রতিষ্ঠিত জাতিগত বাহিনীর সঙ্গে মিলে শুরু হওয়া সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনে সামরিক জান্তা বাহিনী বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারায়।
জান্তা সরকার বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংলাপে বসতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। মিয়ানমার সরকার এই বিদ্রোহীদেরকে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে থাকে।
দিল্লির সেমিনারে যোগদানের বিষয়ে মিয়ানমারের জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের ভাইস চেয়ারম্যান সুই খার বলেন, “আমরা প্রতিনিধি পাঠাব।” তিনি বলেন, “আমি মনে করি, প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত রাষ্ট্রবহির্ভুত শক্তির সঙ্গে আলোচনায় বসবে। এটি একটি ভাল, ইতিবাচক উদ্যোগ।”
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্রকে রয়টার্স ফোন করলেও তিনি সাড়া দেননি।
নয়াদিল্লির সেমিনারে, রাখাইন রাজ্যের উল্লেখযোগ্য অঞ্চল দখলে রাখা আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমারের সবচেয়ে শক্তিশালী ও সংগঠিত বিদ্রোহী শক্তি ‘কাচিন ইনডিপেন্ডেন্স আর্মি’-কে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
তবে আরাকান আর্মি এবং কেআইএ এ বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি।
পশ্চিমা শক্তিগুলো জান্তার নিন্দা করা এবং মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও ভারত তার সরকার ও প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা মিয়ানমারের জেনারেলদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে।
ভারত প্রকাশ্যে জান্তার সমালোচনা করতে নারাজ। কারণ তাতে জেনারেলরা প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের দিকে ঝুঁকতে পারে। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
জান্তা বিরোধীদের সঙ্গে নয়াদিল্লির কোনও আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই। তবে ভারত কেন এই সেমিনারে তাদের সামিল করার পদক্ষেপ নিয়েছে তা নিয়ে এখনও স্পষ্ট নয়।
গত জুন মাসে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর সীমান্তে অস্থিতিশীলতা এবং মিয়ানমারে ভারতের প্রকল্পগুলোর নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভারত এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সমস্ত স্টেকহোল্ডারদের জড়িত করার জন্য উন্মুক্ত।
ভারত মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের কালাদান বন্দর ও মহাসড়ক প্রকল্পের উন্নয়নের পাশাপাশি মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে থাইল্যান্ডের সাথে তার স্থলবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিকে সংযুক্ত করার জন্য আরেকটি সড়ক প্রকল্পের জন্য প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা করছে।
সেমিনারের পরিকল্পনাটি মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানের একটি শান্তি প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে এসেছে। এটি এপ্রিল ২০২১ সালে প্রকাশের পর থেকে এখনও পর্যন্ত এর তেমন কোনও অগ্রগতি হয়নি। কারণ, কিছু আসিয়ান সদস্য দেশ জান্তার আলোচনা প্রত্যাখ্যানের কারণে বিরক্ত হয়েছে।
গত বছর আসিয়ানের সাবেক সভাপতি ইন্দোনেশিয়া বলেছিল, সংঘাতের প্রধান পক্ষগুলোর কাছ থেকে প্রাথমিক সংলাপের বিষয়ে তারা ইতিবাচক সংকেত পেয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত অগ্রগতির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
ভারত-মিয়ানমার বিষয়গুলো ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা সিঙ্গাপুরভিত্তিক গবেষক অংশুমান চৌধুরী বলেন,” নভেম্বরের বৈঠকটি ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের 'গণতন্ত্রপন্থি পক্ষের' কাছে যেতে নয়াদিল্লির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের এও দেখতে হবে যে, এটা কি নির্দিষ্ট পররাষ্ট্র নীতির ফলাফল অর্জনের উদ্দেশ্যে নাকি মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে পিছু হটাতে একটি সঙ্কেত মাত্র। কারণ, ভারত নিজেদের সীমান্তের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বিগ্ন।”