Published : 04 Nov 2024, 12:37 AM
যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনি দৌড়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস সামিল হওয়ার পর থেকেই শক্ত প্রতিপক্ষ ডনাল্ড ট্রাম্পের বিপরীতে তাকে সমর্থন দিতে এক কাতারে দাঁড়াচ্ছেন স্যোশাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা-সহ তারকারা।
স্যোশালা মিডিয়ায় হ্যারিস হয়ে উঠেছেন জনপ্রিয়। কমলা হ্যারিস তার নির্বাচনি প্রচার শুরুর পর এক সপ্তাহেই শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা থেকে শুরু নানা শ্রেণির মানুষ তাকে সমর্থন জানাতে জুম কল করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর এসব বড় বড় জুম কলে অল্প সময়ের মধ্যেই হ্যারিসের নির্বাচনি তহবিল বেড়ে পৌঁছে যায় রেকর্ড পর্যায়ে।
হ্যারিসের ভার্চ্যুয়াল নির্বাচনী সমাবেশগুলোতেও দেখা গেছে তারকাদের মেলা। সমাবেশ সঞ্চালনা করেছেন মার্কিন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, অভিনেত্রী ও সঞ্চালক অপরাহ উইনফ্রের মতো ব্যক্তিত্ব। আর সমাবেশে যোগও দিয়েছিলেন জেনিফার লোপেজ, মেরিল স্ট্রিপ, ক্রিস রক, বেন স্টিলার ও জুলিয়া রবার্টসের মতো খ্যাতনামা সব হলিউড তারকা।
ইন্টারনেট এবং স্যোশাল মিডিয়ার কথা বলতে গেলে কমলা হ্যারিস সেখানে অত্যন্ত জনপ্রিয় বললেও অত্যুক্তি হবে না। ব্যবহারকারীরা হ্যারিসের পাশাপাশি তার রানিং মেট টিম ওয়ালজ এরও গুনমুগ্ধ।
নির্বাচনি দৌড়ে হ্যারিসকে তর তর করে সামনে এগিয়ে দেওয়ার চাবুক হিসাবে কাজ করেছে এই স্যোশাল ইনফ্লুয়েন্সার বাহিনী। ভোটারদের কাছে পৌঁছতে হ্যারিসের জন্য তারা সহায়ক হয়েছে। ২০১৯ সালে হ্যারিসের নির্বাচনি প্রচারের তুলনায় এবার পুরো বিপরীত চিত্র দেখা গেছে।
কমলা হ্যারিসের প্রতিপক্ষ রিপাবলিকান প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্পেরও স্যোশাল মিডিয়ায় জনসমর্থন অনেক বেশি ছিল, যখন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচনী দৌড়ে ছিলেন। কারণ, বাইডেন এবং ট্রাম্পের মধ্যে পরেরজন পপ-কালচার দর্শকশ্রোতার মধ্যে বেশি পছন্দনীয় ছিলেন।
কিন্তু পরে বাইডেনের জায়গায় হ্যারিস নির্বাচনি দৌড়ে চলে আসায় এখন তরুণ-যুবাদের কাছে সবকিছুই বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আর সেটি হয়েছে অনলাইনে হ্যারিসের টিকটক মিম এবং এমন আরও অনেককিছুর কারণে।
হ্যারিস ধীরে ধীরে ইন্টারনেটে রকস্টারের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পারায় গত অগাস্টে ডেমোক্র্যাটিক দলের জাতীয় সম্মেলনের আগে দিয়ে তার অনুকুলেই স্যোশাল মিডিয়ায় মানুষ মত দিয়েছে বেশি।
অনলাইন ট্রাফিকে হ্যারিস উত্তরোত্তর নামিদামী দর্শকশ্রোতাও পেয়েছেন। ‘সুইং লেফ্ট ইয়াং পিপল ফল হ্যারিস’ ভার্চুয়াল সমাবেশে তাকে ‘কুইন ব্রাট’ উপাধি দেওয়া হয়।
ড্যান্স-পপ কুইন চার্লি এক্সসিএক্স এর সঙ্গে মিল রেখে হ্যারিসকে ওই তকমা দেওয়া হয়। আর সেটিই হ্যারিসকে ‘স্যোশাল মেডিয়া স্ট্যাটাস’ এনে দেয়, যা সরাসরি তরুণ আমেরিকানদের মধ্যে সাড়া ফেলে।
খোদ চার্লি এক্সসিএক্স এর সমর্থনও হ্যারিস পেয়েছেন। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচনি দৌড় থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে কমলা হ্যারিসকে সমর্থন দেওয়ার পরই চার্লি এক টুইটে ‘কমলা ইজ ব্রাট’ লিখে তাকে সমর্থন দেন।
চার্লি ৭ জুনে প্রকাশিত তার ষষ্ঠ স্টুডিও অ্যালবাম ‘ব্রাট’ এর নামানুসারে হ্যারিসকে ওই উপাধি দেন। এরপর কমলা হ্যারিসও তার প্রচারশিবিরের অনলাইন উপস্থিতি বদলে ফেলেন চার্লির ‘ব্রাট’ অ্যালবাম কভারের স্যোশাল মিডিয়া ট্রেন্ডকে কাজে লাগিয়ে একটি নতুন পেজ খুলে।
চার্লির ব্রাট অ্যালবামের কভারের পটভুমিটি হচ্ছে, সবুজ রঙের একটি চৌকোনা। তাতে লেখা রয়েছে ‘ব্রাট’ শব্দটি। হ্যারিসের প্রচারশিবিরও ঠিক একইভাবে সবুজ রঙের চৌকোনার ওপর ‘কমলাএইচকিউ’ লেখা একটি ইনস্টাগ্রাম ক্যাম্পেইন পেজ তৈরি করে।
সেই ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্টে চার্লির টুইটের একটি স্ক্রিনশট দেওয়া হয়। পাশাপাশি ‘ওয়েলকাম টু কমলা হ্যারিস এইচকিউ’ লেখা একটি ব্রাট-সবুজ চৌকোনাও বসিয়ে দেওয়া হয়।
কেবল এই রদবদলটুকু করাতেই ভাইরাল হয় হ্যারিসের ইন্সটাগ্রামের নতুন নির্বাচনি প্রচার পাতা। মাত্র চার ঘণ্টাতেই পাতাটি দেখে ফেলে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ।
হ্যারিসের প্রচার দল স্যেশাল ইনফ্লুয়েন্সার এবং কন্টেন্ট ক্রিয়েটর বা বিষয়বস্তু নির্মাতাদের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়েও তরুণদের ভোট টানার চেষ্টা করেছে।
গত অগাস্টে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জাতীয় সম্মেলনে সম্মানিত অতিথি ছিল ইনফ্লুয়েন্সার বিষয়বস্তু নির্মাতারা। কনভেশন সেন্টারে আলাদা করে একটি ঘেরা দেওয়া জায়গা রাখা হয়েছিল কেবল বিষয়বস্তু নির্মাতাদের জন্য। আর ইনফ্লুয়েন্সারদের ভিডিও ধারণের জন্য পাতা ছিল নীল কার্পট।
এই সম্মেলনেই প্রথমবারের মতো ২০০ ইনফ্লুয়েন্সার এবং কন্টেন্ট ক্রিয়েটরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাদের আছে লাখ লাখ অনুসারী। কমলা হ্যারিসকে সমর্থন দিতে তারা জাতীয় সম্মেলনে যোগ দিয়েছে কিংবা তাদের অনুসারীদেরকে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছে।
টিকটকে টিভি হোস্ট ও কমেডিয়ান হিদার গার্ডনারের অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। তিনি বিশ্বাস করেন, রাজনৈতিক বার্তা সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার ভবিষ্যৎ হচ্ছে ইনফ্লুয়েন্সাররা।
গার্ডনার বলেন, “লাখো জেনারেশন জেড ভোটার আছে। যারা প্রথমবারের মতো ভোট দিচ্ছে। আর তারা তথ্য দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে পাচ্ছে না। সিএনএন ক্যাবল নিউজ থেকেও পাচ্ছে না। তারা তথ্য পাচ্ছে স্যোশাল মিডিয়া থেকে।”
হ্যারিসের নিজস্ব স্যোশাল মিডিয়া চ্যানেল আছে। কমলা এইচকিউ ইন্সটাগ্রাম পেজ আছে। সেগুলো পরিচালনা করছে তার স্যোশাল মিডিয়া কৌশল পরিকল্পনা টিম। তাদের বেশিরভাগেরই বয়স ২০ এর মাঝামাঝি।
ডেমোক্র্যাটিক জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠান এবার প্রথমবারের মতো উল্লম্ব (ভার্টিক্যাল) স্ট্রিমিং করা হয়েছে অনলাইন দর্শকশ্রোতাদের কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কারণ, আনুভূমিকের (হোরাইজোন্টাল) তুলনায় উল্লম্ব ভিডিও স্ট্রিমিং টিকটক এবং ইন্সটাগ্রামের মতো মোবাইল স্যোশাল মিডিয়া প্লাটফর্মের জন্য আদর্শ হওয়ায় অনেক বেশি দর্শকশ্রোতার কাছে তা পৌঁছতে পারে।
দাতা নেটওয়ার্ক ‘ওয়ে টু উইন’ এর সহপ্রতিষ্ঠাতা জেনিফার ফার্নান্দেজ অ্যানকোনার তথ্যমতে, ডেমেক্র্যাটিক জাতীয় সম্মেলনে আমন্ত্রিত ইনফ্লুয়েন্সাররা তিন শ্রেনির ছিল।
তাদের মধ্যে প্রথম শ্রেনিতে ছিল বিষয়বস্তু নির্মাতারা, রাজনীতিতে যাদের অভিজ্ঞতা আছে। দ্বিতীয় শ্রেনিতে ছিল, গণমাধ্যম তারকারা। আর তৃতীয় শ্রেনিতে ছিল, একদল ইনফ্লুয়েন্সার, যাদের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যোগ আছে খুব কমই।
এই ইনফ্লুয়েন্সররা হ্যারিস-পন্থি বার্তা তাদের অনুসারীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ায় সহায়ক হয়েছে, যারা স্যোশাল মিডিয়া ফিডে হ্যারিসের প্রচারের বিষয়বস্তু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না বিশেষত, তাদের কাছে।
এছাড়াও, ছিল কিছু ক্ষুদ্র কন্টেন্ট ক্রিয়েটররা। যাদের লাখ লাখ নয় বরং হাজার হাজার অনুসারী আছে। তবে তারপরও এই কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের অবস্থান দোদুল্যমান রাজ্যগুলোতে যথেষ্ট মজবুত। সেকারণে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভোটারদের কাছে পৌঁছতে সক্ষম। তাছাড়া, নির্বাচনের সময় একটি প্রজন্মের রাজনৈতিক চিন্তাধারার মোড়ও ঘুরিয়ে দিতে পারে কন্টেন্ট ক্রিয়েটররা।
ফলে গোটা সপ্তাহ ধরেই ডেমোক্র্যাটিক জাতীয় সম্মেলনে ইনফ্লুয়েন্সার এবং কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের বিপুল অনুসারীর কাছে লাইভস্ট্রিমিং এবং ভিডিও কন্টেন্ট পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে হৗারিসের প্রচারশিবির অনেকটাই লাভবান হয়েছে।
সমালোচকরা হয়ত বলবে, হ্যারিস/ওয়ালজের এমন নির্বাচনি প্রচার দেখে মনে হয়, এতে সারবস্তুর চেয়ে আড়ম্বর আর সহজেই মনে গেঁথে যায় এমন কথার ছাড়াছড়ি বেশি।
একথা অবশ্য ঠিক যে, জনমানুষের অনেকেই ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অনেক বেশি করেই জানতে চাইবে যে, হ্যারিস ক্ষমতায় গেলে কী কী করবেন। তিনি কী নীতিমালা নেন, স্বাস্থ্যসেবা খাতে কী করেন-সেদিকে তাকিয়ে থাকবেন অনেকেই।
কিন্তু অনলাইনে ইনফ্লুয়েন্সারদের যে প্রভাব আছে সেটিও সাফল্যের চাবিকাঠি হয়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে- তরুণ জনগোষ্ঠীকে স্ক্রিনের পেছন থেকে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে।
আর কমলা হ্যারিস নিজেও স্যোশাল মিডিয়ায় খুবই সক্রিয় হওয়ার কারণে তিনি প্রতিদিনের ট্রেন্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেন। তাই স্যোশাল মিডিয়া তারকা এবং রকস্টারের মতো জনপ্রিয়তা শেষ পর্যন্ত হোয়াইট হাউজে পৌঁছেও দিতে পারে হ্যারিসকে।