Published : 17 Feb 2025, 02:14 PM
স্টেডিয়ামের তুমুল ভিড়, ধুমধাড়াক্কা বাজনার গান, দেড় ঘণ্টার স্বতস্ফূর্ত নির্বাচনি বক্তৃতা—- সব গায়েব। ডনাল্ড ট্রাম্প এখন হোয়াইট হাউজে ফিরেছেন, সঙ্গে ফিরেছে চমকও।
রিপাবলিকান এ প্রেসিডেন্ট এবার সামনে নিয়ে এসেছেন মার্কিন জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের নতুন এক পদ্ধতি, যার সাহায্যে নিত্যনতুন বার্তা নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই হাজির হচ্ছেন মার্কিনিদের ড্রয়িংরুমে।
দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রায় চার সপ্তাহ হতে চলল, এ সময়ের মধ্যেই ট্রাম্প ঐতিহাসিক ওয়েস্ট উইংয়ের এ অফিসের জাঁকজমককে কাজে লাগিয়ে একের পর এক মিডিয়া সমাবেশ করেছেন, যেখান থেকে তার বক্তব্য রেকর্ড হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে নিউজ চ্যানেলগুলোতে।
“তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের ক্ষমতা ও প্রভাব আরও বেশি দৃশ্যমান করতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। প্রেসিডেন্টের ওভাল অফিস ব্যবহারের চেয়ে বেশি কর্তৃত্বপরায়ন আর কিছু হতে পারে না,” বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এমনটাই বলেছেন ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট বিষয়ক ইতিহাসবিদ থমাস অ্যালান শোয়ার্জ।
ট্রাম্প যেন এবার নিজেই নিজের বার্তাবাহক, নিজের ওপর প্রেসিডেন্টের এই নির্ভরতার বিষয়টি হোয়াইট হাউজের এবারের যোগাযোগ কৌশলে বেশ স্পষ্ট।
“এই হোয়াইট হাউজে যতজন আছে তার মধ্যে প্রেসিডেন্টই সেরা মুখপাত্র। আমি আপনাদের এটা নিশ্চিত করতে পারি যে, এবার আপনারা আমার এবং তার কাছ থেকে যতটা সম্ভব বেশি কথাই শুনবেন,” হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট ২৮ জানুয়ারি তার প্রথম প্রেস ব্রিফিংয়ে এমনটাই বলেছিলেন।
চারপাশের দেয়ালে রোনাল্ড রিগান, জর্জ ওয়াশিংটন আর থমাস জেফারসনের মতো প্রেসিডেন্টদের প্রতিকৃতি, পাশে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ স্টিফেন মিলার ও অন্যান্য উপদেষ্টাদের রেখে ট্রাম্প তার সাংবাদিক সম্মেলনগুলোতে ইউক্রেইন থেকে শুরু করে গাজা, কাগজের স্ট্র নিয়ে ব্যাপক আপত্তি সবকিছু নিয়েই খোলামেলা কথা বলেছেন।
এ মিডিয়া সেশনগুলোতে প্রেসিডেন্টকে সাধারণত ঐতিহাসিক রেজোলুট ডেস্কের পেছনে বসে থাকতে দেখা যায়; রানি ভিক্টোরিয়ার উপহার দেওয়া এই ডেস্ক তৈরি হয়েছে আর্কটিক অনুসন্ধানের দায়িত্বে থাকা ব্রিটিশ জাহাজ রেজোলুট থেকে। একাধিক প্রেসিডেন্ট এই ডেস্ক ব্যবহার করেছেন। ট্রাম্প তার বিখ্যাত ‘রেড বাটন’ বা ‘লাল বোতাম’টিও ফিরিয়ে এনেছেন, প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকার সময়ও তার ডেস্কে এই বোতাম দেখা গেছে, যা টিপলে সহকারীর হাত ধরে চলে আসে ডায়েট কোক।
পূর্বসূরী জো বাইডেনের তুলনায় ট্রাম্প সাংবাদিকদের সুযোগ দিচ্ছেন অনেক অনেক বেশি। বাইডেন অবশ্য তার স্বল্প সংখ্যক মিডিয়া সেশনে সমালোচনাকে স্বাগত জানাতেন, যদিও রুজভেল্ট রুম, ইস্ট রুম বা অন্যান্য জায়গায় তার দেওয়া বক্তৃতার বেশিরভাগটাই আসতো টেলিপ্রম্পটার হয়ে।
আর এরই মধ্যে ট্রাম্প করে ফেলেছেন ৩৪টি সেশন, যার ১৬টিই হয়েছে ওভাল অফিস থেকে, জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বিশেষজ্ঞ মার্থা জয়ন্ত কুমার। প্রথম মেয়াদের শুরুর দিকে ওভাল অফিসে ট্রাম্পের এমন সেশন হয়েছিল এবারের এক-তৃতীয়াংশেরও কম, মাত্র ৫ বার। একই সময়ের মধ্যে বাইডেন করেছিলেন ২২টি ছোটখাট প্রশ্ন-উত্তর সেশন, এর ৯টি হয়েছিল ওভাল অফিসে।
দায়িত্ব পাওয়ার চার সপ্তাহের মধ্যে প্রেসিডেন্টের এত ঘন ঘন ওভাল অফিসে আসা নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল লেভিটের কাছে।
উত্তরে হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি বলেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রায় প্রতিদিনই সাংবাদিকদের জন্য ওভাল অফিস খুলে দিতে পেরে খুশি, যারা সারা বিশ্বের সামনে তাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার সুযোগ পান।”
প্রেসিডেন্ট ঘন ঘন সামনে এলেও লেভিটকে কিন্তু সাংবাদিকদের সামনে খুবই কম আসতে দেখা যাচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে ব্রিফিংয়ে হাজির হয়েছেন তিনি মাত্র চারবার।
ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদে যেভাবে তার কার্যালয়কে কাজে লাগাচ্ছেন, তাকে নজিরবিহীন বলছেন প্রেসিডেন্ট বিষয়ক ইতিহাসবিদ ডগলাস ব্রিঙ্কলি।
“এটিই সবচেয়ে বড় পড়কাস্ট: ওভাল অফিস লাইভ,” বলেছেন তিনি।
তবে ঘন ঘন সেশন করলেও সেগুলোতে ঢুকতে হয় ট্রাম্পের শর্ত মেনেই।
গত সপ্তাহে রিপাবলিকান এ প্রেসিডেন্ট এমন এক পদক্ষেপ নেন, যা এর আগে কখনোই দেখা যায়নি। তিনি এসোসিয়েটেড প্রেসের সাংবাদিকের হোয়াইট হাউজে ঢোকায় নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বসেন। কারণ, নিউ ইয়র্কভিত্তিক এ বার্তা সংস্থা নির্বাহী আদেশে ট্রাম্প যে জলসীমাকে ‘আমেরিকা উপসাগর’ নাম দিয়েছেন তা না মেনে আগের মতো ‘মেক্সিকো উপসাগর’-ই লিখে যাচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় গণমাধ্যমটির সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা।
হোয়াইট হাউজ করেসপন্ডেন্ট এসোসিয়েশন এবং রয়টার্সসহ অন্যান্য গণমাধ্যম কোনো গণমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতির ওপর ভিত্তি করে এভাবে বিধিনিষেধ আরোপে তুমুল আপত্তি জানিয়েছে।
টেলিভিশনে এক সময় রিয়েলিটি শো চালাতেন ট্রাম্প, নাটুকেপনা পছন্দ করেন বলে তার খ্যাতিও আছে।
তিনি এখন ওভাল অফিসের সেশনগুলোকে বিনামূল্যে কভারেজ পাওয়ার সুযোগ হিসেবে দেখছেন, তার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত একটি সূত্র এমনটাই বলেছে। এই সেশনগুলোতে তিনি ধুমধাম নানান বিষয়ে কথা বলতে পারছেন, করতে পারছেন আলটপকা মন্তব্য।
যেমন বৃহস্পতিবার, ডেস্কের পেছনে বসে ট্রাম্প ঘোষণা দিলেন তার সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কথা হয়েছে, তারা এখন ইউক্রেইন যুদ্ধ বন্ধে একটি শীর্ষ সম্মেলনের পরিকল্পনা করছেন, যেটি হতে পারে সৌদি আরবে। তার এ ঘোষণা মুহূর্তের মধ্যে ইউরোপের নেতাদের চোখ কপালে তুলে দেয়।
এর সপ্তাহখানেক আগে ট্রাম্প গাজা থেকে ১৭ লাখ ফিলিস্তিনিকে স্থায়ীভাবে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানান। বলেন, ইসরায়েলি সামরিক আগ্রাসনে ধ্বংসপ্রায় ভূখণ্ডটির বাসিন্দাদের সামনে এ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।
রয়টার্স জানিয়েছে, ওভাল অফিসে ট্রাম্পের অধিকাংশ মিডিয়া সেশনই হয়েছে হুট করে। প্রেসিডেন্টের দৈনন্দিন সূচিতে ওই সময়ে হওয়া অনুষ্ঠানগুলোর পাশে সাধারণত লেখা থাকতো ‘ক্লোজড প্রেস’, অর্থ্যাৎ গণমাধ্যমের প্রবেশাধিকার নেই।
কিন্তু দেখা যায়, অনুষ্ঠানের কয়েক মিনিট আগে সহযোগীরা সাংবাদিকদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে ট্রাম্প অনুমতি দিয়ে বসেন। তখন সাংবাদিকদের পড়িমরি ছুটতে হয়।
গত সপ্তাহের মঙ্গলবারে ট্রাম্প স্বল্প সময়ের নোটিসে পুলের সাংবাদিকদের ওভাল অফিসে ডেকে আনেন, জর্ডানের বাদশা আবদুল্লাহকে গাজা থেকে আরও ফিলিস্তিনি শরণার্থী নিতে তার অনুরোধ করার দৃশ্য রেকর্ড করাতে। বাদশা অবশ্য তাতে খুব একটা টলেননি, তিনি ঠিকই ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে তার দেশের ‘অবিচল অবস্থানের’ কথাই তুলে ধরেন।
টিভি শো যেভাবে আকর্ষণ ধরে রাখে, পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষায় রাখতে পছন্দ করে, ট্রাম্পও তেমনি তার সেশনগুলো শেষ করতে চান টানটান উত্তেজনা দিয়ে। ঠিক যেমনটা করেছেন বুধবারও। এদিন তিনি জানান, শুল্ক নিয়ে শিগগিরই আরেকটি ঘোষণা আসতে যাচ্ছে।
“চাইলে এটা আমি আজই দিতে পারি; আজ হলে এখনও করতে পারতাম। আপনারা কি হতবাক হয়ে যেতে চান?,” ওভাল ‘স্টুডিও’ থেকে এমন নাটুকে ভঙ্গিতেই বলেন ট্রাম্প।