Published : 24 May 2025, 05:23 PM
দীর্ঘকাল ধরে হার্ভার্ডের সঙ্গে চীনের যে সম্পর্ককে ‘সম্পদ’ হিসেবে দেখা হতো, ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়টির বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে বেইজিংয়ের প্রভাব বিস্তারমূলক কর্মকাণ্ডকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ আনার পর সেই সম্পর্কই এখন রাজনৈতিক দায়ে পরিণত হয়েছে।
এন্টিসেমেটিজম লালন এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টিকে সহযোগিতার অভিযোগে বৃহস্পতিবার ট্রাম্প প্রশাসন হার্ভার্ডের বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষমতা বাতিলে পদক্ষেপ নেয়। এ সিদ্ধান্ত চীনা নাগরিকদের ওপরও বড়সড় প্রভাব ফেলবে; কেননা, ম্যাসাচুসেটসের ক্যামব্রিজে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়টির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে তাদের ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর এক পঞ্চমাংশই এসেছে চীন থেকে।
শুক্রবার হার্ভার্ড কর্তৃপক্ষ মামলা করলে মার্কিন এক বিচারক বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষমতা কেড়ে নিতে ট্রাম্প প্রশাসনের পদক্ষেপ সাময়িকভাবে আটকে দেন।
তবে হার্ভার্ডে চীন সরকারের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ নতুন নয়। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্বন্ধে জানতে, নিরাপত্তা আইনকে পাশ কাটাতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর সমালোচনা চাপা দিতে বেইজিং হার্ভার্ডের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগাচ্ছে বলে অনেক মার্কিন আইনপ্রণেতা, বিশেষ করে রিপাবলিকানরা দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছেন, বলছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
“অনেকদিন ধরেই, হার্ভার্ড নিজেদেরকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির হাতে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ দিয়ে আসছে। তারা ক্যাম্পাসে সিসিপি (চীনা কমিউনিস্ট পার্টি) পরিচালিত হয়রানির ব্যাপারে চোখ বুঝে ছিল,” শুক্রবার এমনটাই বলেছেন হোয়াইট হাউজের এক কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে রয়টার্স যোগাযোগ করলেও তাৎক্ষণিকভাবে হার্ভার্ডের কাছ থেকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য পায়নি।
এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়টি তাদের বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষমতা কেড়ে নেওয়াকে আইন ও মতপ্রকাশের অধিকারের ‘নির্লজ্জ লঙ্ঘন’ অভিহিত করেছিল।
গবেষণা সহযোগিতা থেকে শুরু করে চীনকেন্দ্রিক অ্যাকাডেমিক সেন্টার, হার্ভার্ডের সঙ্গে বেইজিংয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে দশকের পর দশক ধরে। এই যোগাযোগ হার্ভার্ডকে ব্যাপক আর্থিক সহায়তা, আন্তর্জাতিক প্রভাব ও বিশ্বব্যাপী মর্যাদাও এনে দিয়েছে।
স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ
এক বিবৃতিতে ওয়াশিংটনের চীন দূতাবাস বলেছে, “চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শিক্ষা বিনিময় ও সহযোগিতা পরস্পরের জন্য লাভজনক এবং এগুলোকে কলঙ্কিত করা উচিত নয়।”
হার্ভার্ডে চীনা শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চীনের বিস্তৃত যে সম্পর্ক এর মধ্যে বেআইনি কিছু নেই। তবে এই সম্পর্কের জটিল বিন্যাস এবং অস্বচ্ছতাই মূলত সমালোচনার লক্ষ্য।
যেমন ধরা যাক, হার্ভার্ড ২০২০ সালের পরও শিনজিয়াং প্রোডাকশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কর্পসের (এক্সপিসিসি) কর্মকর্তাদের স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। অথচ ২০২০ সালেই যুক্তরাষ্ট্র শিনজিয়াংয়ে উইঘুর এবং অন্যান্য মুসলিম গোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আধাসামরিক ওই প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মন্ত্রণালয় বলছে, হার্ভার্ডের সঙ্গে এক্সপিসিসির যোগাযোগ ‘এই ২০২৪ সাল পর্যন্তও’ ছিল।
চীন শিনজিয়াংয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সব অভিযোগ অস্বীকার করলেও ট্রাম্প ও জো বাইডেন উভয় প্রশাসনই ওই অঞ্চলে বেইজিংয়ের পদক্ষেপকে ‘গণহত্যার’ দৃষ্টিতেই দেখেছে।
আরেকটি ঘটনাও অনেককে উদ্বিগ্ন করেছে। মার্কিন ব্যবসায়িক তথ্যদাতা প্রতিষ্ঠান স্ট্র্যাটেজি রিস্কস তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, ২০১৪ সালে হার্ভার্ডকে ৩৫ কোটি ডলারের অনুদান পেতে সহায়তা করা রনি চ্যান মূলত চায়না-ইউনাইটেড স্টেটস এক্সচেঞ্জ ফাউন্ডেশনের সদস্য। রনি চ্যানের কারণেই টিএইচ চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথের নামকরণ হয়।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সংলাপকে উৎসাহিত করা হংকংভিত্তিক চায়না-ইউনাইটেড স্টেটস এক্সচেঞ্জ ফাউন্ডেশন যুক্তরাষ্ট্রের আইনে বিদেশি পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তালিকাভুক্ত। অর্থ্যাৎ, এখানে কাজ করা মার্কিন লবিস্টদের অবশ্যই তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে জানাতে হয়।
এমন একটি প্রতিষ্ঠানের একজন সদস্যের হার্ভার্ডের ওপর প্রভাব ঘিরে ওয়াশিংটনের অনেকের চোখ কপালে উঠে যাওয়াই স্বাভাবিক।
দোষী সাবেক অধ্যাপক
হার্ভার্ডের সাবেক অধ্যাপক চার্লস লিবারের বিরুদ্ধে আগের ট্রাম্প আমলের ‘চায়না ইনিশিয়েটিভে’ তদন্ত হয়েছিল। বিশেষ করে অ্যাকাডেমিক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে মেধাসত্ত্ব চুরি ও চীনা গুপ্তচরবৃত্তি মোকাবেলায় ২০১৮ সালে ট্রাম্প এ কর্মসূচি নিয়েছিলেন।
চীনের সঙ্গে আর্থিক সম্পর্ক নিয়ে মিথ্যা বলার দায়ে ২০২১ সালে লিবার দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল। এ বছরের এপ্রিলে তিনি চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণকালীন অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছেন।
বর্ণবাদী বৈষম্য উসকানো এবং আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সহযোগিতায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে এ শঙ্কায় বাইডেন প্রশাসন পরে ওই ‘চায়না ইনিশিয়েটিভ’ বাতিল করে দিয়েছিল।
ইদানিং ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় পার্টির আইনপ্রণেতারাই ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর বেইজিং-ঘনিষ্ঠ শিক্ষার্থী সংঘের নজরদারি নিয়েও উদ্বিগ্ন।
২০২৪ সালের এপ্রিলে এক অনুষ্ঠানে চীনা রাষ্ট্রদূত শি ফেংয়ের বক্তব্যে বিঘ্ন ঘটানোর পর হার্ভার্ডের এক শিক্ষার্থীকে জোর করে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়েছিল চীনা এক এক্সচেঞ্জ শিক্ষার্থী।
তবে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে এসে হার্ভার্ডকে প্রশাসনের ব্যাপক চাপের মুখে পড়তে হয়েছে। এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়টির বিরুদ্ধে বড় আকারের বিদেশি ডোনেশন ও যোগাযোগ সংক্রান্ত ভুলভাল ও অপূর্ণাঙ্গ তথ্য দেওয়ার অভিযোগ এনে হার্ভার্ডের কাছে তাদের বিদেশি অর্থায়ন সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ রেকর্ড চেয়েছিল।
তবে এসব নিয়ে চীন বিশেষজ্ঞ অনেকেই বেশ বিরক্ত।
“চীন সরকার তাদের সীমান্তের বাইরেও যে ভিন্নমতাবলম্বীদের চুপ করিয়ে দেওয়ার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে তা নিয়ে উদ্বেগ যৌক্তিক, গুপ্তচরবৃত্তি নিয়েও উদ্বেগ যৌক্তিক, কিন্তু এজন্য বিদেশি ভর্তিতেই নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে? কেবল চীনা শিক্ষার্থী নয়, সব বিদেশি শিক্ষার্থী? এটার কারণ বোঝা সাধ্যের অতীত,” বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার গবেষক ইয়াকিউ ওয়াং, যিনি শিক্ষার্থী থাকা অবস্থাতেই চীন ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে এসেছিলেন।
হার্ভার্ডে বিদেশি ভর্তি বন্ধে ট্রাম্পের পরিকল্পনা আটকাল আদালত