Published : 13 Jun 2025, 12:00 AM
ভারতের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় আহমেদাবাদে এয়ার ইনডিয়ার লন্ডনগামী একটি উড়োজাহাজ আবাসিক এলাকায় বিধ্বস্ত হয়ে ২৪১ জনের প্রাণ গেছে।
বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজটি বৃহস্পতিবার দুপুরে আহমেদাবাদের সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে লন্ডনের গ্যাটউইক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে উড়াল দেওয়ার পরপরই দুর্ঘটনায় পড়ে।
ওই উড়োজাহাজে ২৩২ জন যাত্রী ও ১০ জন ক্রু ছিলেন। তাদের মধ্যে কেবল একজনের বেঁচে যাওয়ার তথ্য মিলেছে।
উড়োজাহাজটি আহমেদাবাদের একটি মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের ওপর আছড়ে পড়ায় ওই ভবনের আরো অন্তত আরো পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।
রাজ্য পুলিশের কর্মকর্তা বিধি চৌধুরী আগে ২৯৪ জনের মৃত্যুর খবর দিলেও পরে তা সংশোধন করেন বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
তিনি বলেন, “১১এ নম্বর আসনে বসা এক যাত্রীকে জীবিত পাওয়া গেছে। তিনি বিমানের জরুরি নির্গমন দরজার পাশেই ছিলেন।”
উদ্ধার পাওয়া যাত্রী রমেশ বিশ্বাসকুমার হিন্দুস্তান টাইমসকে বলেন, “উড্ডয়নের ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে বিকট শব্দ হয়, এরপর উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়।”
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তিনি বলেন, “চোখ খুলে দেখি চারদিকে লাশ। ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়াই। তখনই একজন আমাকে ধরে অ্যাম্বুলেন্সে তোলে।”
ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগহরিক রমেশ বলেন, তার ভাই অজয় একই ফ্লাইটে ভিন্ন আসনে বসেছিলেন। কিন্তু তাকে এখন তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না।
আহমেদাবাদ পুলিশের প্রধান জিএস মল্লিক বলেন, উদ্ধার করা মরদেহগুলোর মধ্যে উড়োজাহাজের যাত্রী ছাড়াও নিচে থাকা লোকজন রয়েছেন। গুজরাটের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপানিও রয়েছেন নিহতদের মধ্যে।
নিহতদের শনাক্তে আত্মীয়স্বজনদের ডিএনএ নমুনা দিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে বলে জানান রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিব ধনঞ্জয় দ্বিবেদী।
রয়টার্স লিখেছে, বিধ্বস্ত ভবনের চারপাশে ড্রিমলাইনারের ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা গেছে। উড়োজাহাজের লেজ আটকে আছে ভবনের ছাদে। ভিডিও ও ছবিতে দেখা গেছে, ভবন জুড়ে ধোঁয়া, আগুন এবং উড়োজাহাজের টুকরো অংশ।
এয়ার ইনডিয়া জানিয়েছে, ফ্লাইট এআই ১৭১ এর আরোহীদের মধ্যে ২১৭ জন প্রাপ্তবয়স্ক, ১১ জন শিশু এবং ২ নবজাতক ছিল।
তাদের মধ্যে ১৬৯ জন ভারতীয়, ৫৩ জন ব্রিটিশ, ৭ জন পর্তুগিজ এবং একজন কানাডীয় নাগরিক।
ফ্লাইটরেডার টোয়েন্টিফোর জানিয়েছে, ২০১১ সালে বাণিজ্যিক ফ্লাইট শুরু করা বোয়িংয়ের ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার এই প্রথম বিধ্বস্ত হল। যে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়েছে, সেটি প্রথমবার ওড়ে ২০১৩ সালে। ২০১৪ সালে সেটি এয়ার ইনডিয়ার কাছে হস্তান্তর করা হয়।
উড্ডয়নের পরপরই দুর্ঘটনা
আহমেদাবাদ বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের তথ্যের বরাত দিয়ে এনডিটিভি জানিয়েছে, রানওয়ে ২৩ থেকে বেলা ১টা ৩৯ মিনিটে উড়োজাহাজটি বিমানবন্দর ছাড়ে। এরপরই সেটি ‘মে ডে’ সঙ্কেত দেয়। এরপর আর উড়োজাহাজের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
সোশাল মিডিয়ায় আসা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, উড়োজাহাজটি উচ্চতা বাড়াতে না পেরে খুব নিচ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে এবং কিছুক্ষণ পর সেটি নিচে আছড়ে পড়ে। বিস্ফোরণের পর পরিণত হয় আগুনের গোলায়।
দুর্ঘটনার আগে বিমানটি প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে উড়েছিল এবং বেলা ১টা ৩৮ মিনিটে সেটি বিধ্বস্ত হয়। দুর্ঘটনার পর আহমেদাবাদ বিমানবন্দরের কার্যক্রম কয়েক ঘণ্টা বন্ধ রাখার পর পুনরায় চালু করা হয়।
উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয় আহমেদাবাদের বিজে মেডিকেল কলেজের হোস্টেল ভবনের ওপর। ওই ভবনের ডায়নিং হলে তখন দুপুরের খাবারের পর্ব চলছিল।
দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন ছবিতে দেখা যায় হোস্টেল ভবনটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উড়োজাহাজের ধ্বংসাবশেষ ও চাকা ভবনের যে অংশে আটকে আছে, সেখানেই হোস্টেলের ডায়নিং হল। সারি সারি টেবিলে খাবারসহ প্লেট রাখা। তবে টেবিলগুলোতে ধুলাবালির আস্তরণ জমে আছে।
আহমেদাবাদের সরকারি হাসপাতালে পুনম প্যাটেল নামের এক নারী রয়টার্সকে বলেন, “আমার ভাবি লন্ডনে যাচ্ছিলেন। এক ঘণ্টার মধ্যেই শুনি বিমান দুর্ঘটনায় পড়েছে।”
ওই মেডিকেল কলেজের এক ছাত্রের মা বলেন, “আমার ছেলে দুপুরের হোস্টেলে ছিল। সৌভাগ্যবশত সে বেঁচে আছে, দ্বিতীয় তলা থেকে লাফ দিয়ে কিছুটা আহত হয়েছে।”
ঠিক কী কারণে উড়োজাহাজটি দুর্ঘটনায় পড়ল, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে ওড়ার সময় পাখির আঘাত লাগাসহ কয়েক রকম সম্ভাবনার কথা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সংবাদমাধ্যমে।
এক মার্কিন বিমান নিরাপত্তা বিশ্লেষক রয়টার্সকে বলেন, ভিডিওতে দেখা যায়, উড্ডয়নের সময়ও বিমানের চাকা নিচে ছিল, যা স্বাভাবিক নয়।
“যদি কেউ না জানত কী ঘটছে, তাহলে ভাবত বিমানটি অবতরণ করছে,” বলেন তিনি।
বোয়িং এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা এয়ার ইনডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করছে এবং তথ্য সংগ্রহ করছে। দুর্ঘটনার খবরের পর বোয়িংয়ের শেয়ারের দর ৫ শতাংশ কমে যায়।
জেনারেল ইলেকট্রিক অ্যারোস্পেস জানিয়েছে, তারা একটি প্রতিনিধি দলকে ভারতে পাঠাচ্ছে। মার্কিন ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফটি বোর্ডও তদন্তে সহায়তা করতে একটি প্রতিনিধি দল পাঠাবে।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর জানায়, তারা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে এবং তদন্তে সহায়তা দিচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক এক্স পোস্টে লিখেছেন, “আহমেদাবাদের এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আমরা স্তব্ধ, শোকাহত। প্রকাশ করার ভাষা আমাদের নেই।”
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার একে ‘বিধ্বংসী’ দুর্ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বাকিংহাম প্যালেস জানিয়েছে, রাজা চার্লসও এ বিষয়ে নিয়মিত খোঁজখবর নিচ্ছেন।
আহমেদাবাদ বিমানবন্দর পরিচালনা করে আদানি গ্রুপ। দুর্ঘটনার পর সেখানে সাময়িকভাবে উড়োজাহাজ ওঠানামা বন্ধ রাখা হয়। পরে আবার চলাচল শুরু হয়।
আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি এক্স-এ লিখেছেন, “এয়ার ইনডিয়া ফ্লাইট ১৭১-এর ভয়াবহ ট্র্যাজেডিতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে আমরা আছি।”
বৃহস্পতিবারের এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ভারতের ইতিহাসে ৩৭ বছর আগে এই আহমেদাবাদেরই আরেকটি দুর্ঘটনার স্মৃতি সামনে এনেছে।
১৯৮৮ সালের সেই ঘটনায় ইনডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট কুয়াশার মধ্যে আহমেদাবাদের রানওয়েতে নামতে গিয়ে পাশের একটি জলাধারে গিয়ে নামে। পাইলট বুঝতে পেরে উড়োজাহাজ আবার ওপরে তুলতে চাইলেও তখন আর সময় ছিল না।
ওই ফ্লাইটের ১৩৫ জন আরোহীর মধ্যে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৩৩ জন।