Published : 03 Jun 2025, 12:07 PM
কিইভ যদি মস্কোর দখলে যাওয়া অংশের দাবি ছেড়ে দেয় এবং নিজেদের সেনাবাহিনীর আকার ছোট করে আনে তাহলেই কেবল যুদ্ধ থামবে বলে তুরস্কে শান্তি আলোচনায় ইউক্রেইনকে জানিয়েছে রাশিয়া।
সোমবার দ্বিতীয় রাউন্ডের আলোচনায় রুশ প্রতিনিধিদের দেওয়া অবস্থানপত্রে এমনটাই সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে বলে রুশ গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
ইস্তাম্বুলে চিরাআন প্রাসাদে এদিনের বৈঠকে যুদ্ধবিরতির নিকটতম সম্ভাবনা দেখা না গেলেও দুই পক্ষ নিজেদের মধ্যে অসুস্থ ও মারাত্মক আহত এবং বন্দি হিসেবে থাকা ২৫ বছরের কম বয়সী সৈন্য বিনিময়ের ব্যাপারে একমত হয়েছে, জানিয়েছে বিবিসি।
যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়া যেসব শর্ত দিয়েছে ইউক্রেইন তা মানতে নারাজ। এসব শর্ত মানাকে আত্মসমর্পণ হিসেবেই দেখছে কিইভ।
২০২২ সালের মার্চের পর এ নিয়ে দ্বিতীয়বার দুই পক্ষের মধ্যস্থতাকারীরা একে অপরের মুখোমুখি বসলেন।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান এ বৈঠকে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকে তুরস্কে একটি বৈঠকে বসাতে পারার ব্যাপারে আশাবাদী।
ইউক্রেইন এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা চাইছে রাশিয়াকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করাতে। কিন্তু মস্কো বলছে, বিরতির সুযোগ নিয়ে পশ্চিমারা কিইভকে আরও অস্ত্র সরবরাহ করে আদতে যুদ্ধকেই দীর্ঘায়িত করতে চায়। তাই যুদ্ধবিরতি নয়, দীর্ঘমেয়াদী সমঝোতার পক্ষে তারা।
কিইভ বলছে, পুতিন শান্তিতে আগ্রহী নন।
দুই পক্ষের আলোচনায় অগ্রগতি দেখা না গেলে ট্রাম্প মধ্যস্থতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি আগেই দিয়ে রেখেছেন।
সোমবারের সোয়া এক ঘণ্টার আলোচনায় রাশিয়া যে মেমোরেন্ডাম বা অবস্থানপত্র দিয়েছে সেটি পরে রুশ বার্তা সংস্থা ইন্টারফ্যাক্সে প্রকাশিতও হয়েছে।
ওই অবস্থানপত্রে যুদ্ধ বন্ধ ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাশিয়া যেসব শর্ত দিয়েছে তার মধ্যে আছে, ২০১৪ সালে মস্কোর নিয়ন্ত্রণে যাওয়া ক্রাইমিয়া উপদ্বীপ এবং ২০২২ সালের ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরুর পর এ পর্যন্ত তারা যে চারটি এলাকা দখলে নিয়েছে সেগুলোর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। কিইভকে এসব এলাকা থেকে বাহিনীও পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নিতে হবে।
এর পাশাপাশি মস্কোকে ‘নিরপেক্ষ’ দেশ হতে হবে, কখনোই নেটোর সদস্যপদ নিতে পারবে না। একইসঙ্গে ইউক্রেইনে রুশ ভাষাভাষীদের অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, রুশ ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দিতে হবে এবং নাৎসিবাদকে মহিমান্বিত করার যে কোনো চেষ্টাকে আইনিভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। রাশিয়ার ওপর দেওয়া সব আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারেরও দাবি জানিয়েছে।
কিইভ তাদের বিরুদ্ধে রুশ ভাষাভাষীদের ওপর বৈষম্য এবং নাৎসিবাদ সংক্রান্ত অভিযোগগুলো অস্বীকার করে আসছে।
শান্তি সমঝোতার পথে যে কোনো যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়া তার শর্তাবলীও আনুষ্ঠানিকভাবে ইউক্রেইনকে দিয়েছে। তারা দুটো বিকল্প হাজির করেছে, যার কোনোটাই কিইভ মানতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।
এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে- ইউক্রেইনকে লুহানস্ক, দোনেৎস্ক, জাপোরিঝিয়া ও খেরসন অঞ্চল থেকে সব সেনা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। এই চার অঞ্চলের মধ্যে লুহানস্ক এখন পুরোপুরিই রাশিয়ার দখলে; বাকি তিনটিরও ৭০ শতাংশের মতো অঞ্চল মস্কোর সেনাদের কব্জায়।
দ্বিতীয় বিকল্পের ক্ষেত্রে রাশিয়ার প্যাকেজ শর্ত হচ্ছে, ইউক্রেইনকে নতুন করে সেনা পুনঃমোতায়েন পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে এবং বিদেশি বন্ধুদের কাছ থেকে সামরিক সহায়তা, উপগ্রহ যোগাযোগ ও গোয়েন্দা তথ্য নেওয়া স্থগিত রাখতে হবে। পাশাপাশি কিইভকে মার্শাল ল’ বা জরুরি আইন তুলে নিতে হবে এবং ১০০ দিনের মধ্যে পার্লামেন্ট ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হবে।
ইউক্রেইনের প্রতিনিধি দলের প্রধান, তাদের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রুস্তম উমেরভ বলেছেন, তারা রাশিয়ার দেওয়া নথিগুলো পর্যালোচনা করছেন।
শান্তি আলোচনায় ইউক্রেইনরও একটি রোডম্যাপ দিয়েছে, যা দেখেছে রয়টার্স। এতে বলা হয়েছে, কোনো শান্তি চুক্তি হলে তারপরই তারা তাদের সামরিক সক্ষমতার রাশ টানবে। মস্কোর দখলে যাওয়া অঞ্চলগুলোর জন্য কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি থাকবে না, উল্টো তাদের কাছ থেকে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণও চাইছে কিইভ।
রুশ প্রতিনিধিদলের প্রধান ভ্লাদিমির মেদিনস্কি বলেছেন, মস্কো যুদ্ধক্ষেত্রের বিভিন্ন অংশে ‘সুনির্দিষ্ট দুই-তিনদিনের যুদ্ধবিরতির’ প্রস্তাব দিয়েছে, যেন দুই পক্ষই তাদের নিহত সেনাদের মরদেহ সংগ্রহ করতে পারে।
শান্তি আলোচনার পর আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে রাশিয়া তাদের কাছে থাকা ৬ হাজার ইউক্রেইনীয় সেনার মরদেহ কিইভকে হস্তান্তর করবে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
উমেরভ বলেছেন, ইউক্রেইন জুন শেষ হওয়ার আগে আরও বৈঠকের প্রস্তাব দিয়েছে। কিইভ বিশ্বাস করে, কেবল জেলেনস্কি ও পুতিনের মধ্যে বৈঠকেই অনেক কিছুর সমাধান হতে পারে।
এদিকে ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট পরে জানান, তার প্রতিনিধিরা তুরস্কে রুশ প্রতিনিধিদের কাছে ৪০০ শিশুর একটি তালিকা হস্তান্তর করেছে, যাদেরকে রাশিয়া অপহরণ করেছে। এর মধ্যে রুশ প্রতিনিধিদল কেবল ১০ শিশুকে হস্তান্তরে কাজ করতে রাজি হয়েছে।
রাশিয়া বলেছে, তারা কাউকে অপহরণ করেনি। সুরক্ষার জন্য তারা অনেক শিশুকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নিয়েছে।
দুই পক্ষের মধ্যে এই রাউন্ডের আলোচনার আগের দিনই ইউক্রেইন রাশিয়ার কৌশলগত বোমারু বিমান ধ্বংসে ‘স্পাইডারস ওয়েব’ অভিযান চালিয়েছে।
এই অভিযানে ১১৭টি ড্রোন ব্যবহৃত হয়েছে এবং সেগুলো সাইবেরিয়া এবং রাশিয়ার আরও উত্তরে থাকা একাধিক বিমানঘাঁটিতে থাকা পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম এমন দূরপাল্লার ৪১টি বিমান ধ্বংস করেছে বলে দাবি কিইভের।
উপগ্রহের ছবিতেও রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতির চিহ্ন মিলেছে। তবে কিইভ যতটা বাড়িয়ে বলছে, অত ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে ইঙ্গিত রুশ কর্মকর্তাদের।
গত মাসের মাঝামাঝি দুই পক্ষের মধ্যে ইস্তাম্বুলে তিন বছর প্রথম সরাসরি শান্তি আলোচনা হয়। সেখানেও যুদ্ধবিরতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট অগ্রগতি দেখা যায়নি। ওই বৈঠকের পর দুই পক্ষ একে অপরের সঙ্গে ১ হাজার করে যুদ্ধ বন্দি বিনিময় করেছিল।