Published : 04 Jul 2025, 09:40 PM
আন্তর্জাতিক সাহিত্যজগতে ইংরেজি ভাষার প্রভাব ও অবস্থান আজ এতটাই দৃঢ় যে, বিশ্বের যেকোনো ভাষায় রচিত শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যকর্মও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করতে হলে তার ইংরেজি অনুবাদ অপরিহার্য হয়ে ওঠে। নোবেল সাহিত্য পুরস্কার, বুকার, ও’ হেনরী কিংবা আন্তর্জাতিক পেন—প্রায় প্রতিটি বিশ্বমানের পুরস্কার ইংরেজিতে অনূদিত সাহিত্যকর্মের ভিত্তিতেই প্রদান করা হয়। ফলে, সাহিত্যিক পরিচিতি ও মূল্যায়নের এই পরিপার্শ্বে ইংরেজি অনুবাদ কেবল মাধ্যম নয়, বরং সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণের প্রধান প্রবেশদ্বার। জাপানি, রুশ, আফ্রিকান কিংবা ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্যও প্রথমে ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে তবেই বিশ্বের অন্যান্য ভাষায় বিস্তার লাভ করেছে। এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের সাহিত্য—যা প্রধানত বাংলা ভাষায় রচিত—আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও পাঠকের কাছে পৌঁছাতে হলে ইংরেজিতে এর উপস্থিতি ও গুণগত অনুবাদ অপরিহার্য। এই প্রবন্ধে তাই শুধুমাত্র বাংলাদেশের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে—এর বর্তমান বাস্তবতা, প্রাসঙ্গিকতা এবং ভবিষ্যৎ পথরেখা বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য কৌশল ও করণীয় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য বিশ্ববাজারে নিজস্ব স্থান তৈরি করার ক্ষেত্রে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। বাংলা ভাষার স্বাতন্ত্র্য ও গভীরতা আন্তর্জাতিক ভাষাভাষী পাঠকদের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছানো এবং স্বীকৃতি পাওয়া একটি জটিল প্রক্রিয়া। পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতীয় বাংলা সাহিত্যকে এ আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত না করে শুধুমাত্র বাংলাদেশের সাহিত্য ও তার বিশ্ববাজার প্রসঙ্গে নজর দিলে বোঝা যায় যে বাংলাদেশি সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণ এখনও অপেক্ষাকৃত সংযত ও অসম্পূর্ণ।
বাংলা সাহিত্য নিয়ে ইংরেজি ভাষায় গবেষণা
বাংলাদেশি বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ যেমন মঙ্গলকাব্য, মৈমনসিংহ গীতিকা, লালনের গান ও দর্শন, ইতোমধ্যেই ইংরেজি, চীনা, জাপানি, ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন গবেষক যেমন ক্লিনটন. বি. সিলি, র্যালফ নিকোলাস, ক্যারল সলোমন, হেনরি গ্লাসি প্রমুখ বাংলা সাহিত্য নিয়ে ইংরেজিতে গবেষণা করছেন। তবে এই গবেষণাগুলো অনেক সুসংহত ও স্বতন্ত্র পর্যায়ে নেই বরং বিচ্ছিন্ন ও অনিয়মিত। উপরন্তু বিদেশী গবেষকদের গবেষণায় মধ্যযুগীয় কিংবা ষোড়শ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলা সাহিত্যকে জনপ্রিয় করে তুলতে খুব বেশি সহায়ক হয়েছে বলে মনে করি না। অবশ্য গবেষণার উদ্দেশ্যের সাথে জনপ্রিয়তার সাযুজ্য খোঁজাও প্রাসঙ্গিক না।
অনুবাদযোগ্যতার সংকট: ভাষা, ভাব ও ভাবান্তরের দ্বন্দ্ব
বাংলা সাহিত্যের আন্তর্জাতিক প্রবেশপথে যে ক’টি প্রধান প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান, তার মধ্যে অনুবাদযোগ্যতার সীমা একটি মৌলিক সমস্যা। বাংলা ভাষার গঠনগত সূক্ষ্মতা, ধ্বনিগত রূপবৈচিত্র্য, অনির্বচনীয় কাব্যিকতা ও অন্তর্নিহিত ভাববিন্যাস ইংরেজি কিংবা অন্য আন্তর্জাতিক ভাষায় রূপান্তরের সময় প্রায়শই বিকৃত হয়, কিংবা রসহীন হয়ে পড়ে।
বিশেষত বাংলা বাক্যে অব্যয়পদের প্রচলন, অব্যয়পূর্ব জটিল ক্রিয়াপদ, এবং বাক্য বিন্যাসের ললিত ছন্দ ইংরেজি অনুবাদে নিজের স্বর হারায়। বাংলা সাহিত্যের সেমিওটিক্স—অর্থাৎ ভাষার মাধ্যমে সমাজ, সংস্কৃতি ও চেতনাবিশ্বের প্রতিফলন—পশ্চিমা অনুবাদ কাঠামোর সঙ্গে অনেকসময় সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। ফলে বাংলা সাহিত্য বিদেশি পাঠকের কাছে ‘অদ্ভুত রূপকল্প’ কিংবা ‘ঋজু অভিজ্ঞতা’ হিসেবে অভিহিত হলেও, তার মূল ভাব ও দার্শনিকতা গভীরভাবে অনুধাবন করা কঠিন হয়। এই দ্বৈতসংকট অনুবাদকের জন্য কেবল ভাষান্তরের সমস্যা নয়, বরং ভাষার পরবর্তী স্তরে তা হয়ে ওঠে অর্থান্তর, সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যার এবং মানসপট প্রতিস্থাপনের দুরূহ প্রক্রিয়া।
বাংলাদেশের অনুবাদ উদ্যোগ: সম্ভাবনার ভিতর সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশে বাংলা সাহিত্যের ইংরেজি তথা আন্তর্জাতিক ভাষায় অনুবাদ নানা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগত প্রচেষ্টায় চলমান, তবে সেগুলোর অধিকাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক, অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও পরিপক্বতাহীন। বাংলা একাডেমি, নজরুল ইনস্টিটিউট, বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থা কিংবা অনুবাদকেন্দ্রগুলোর মধ্যেও অনুবাদকে একটি দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি হিসেবে বিবেচনার প্রবণতা দুর্বল।
সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক বাজারজাতকরণ, সাহিত্য-পিআর, উৎসব-আংশগ্রহণ এবং কপিরাইট সংক্রান্ত কাঠামো দুর্বল হওয়ার কারণে অনূদিত সাহিত্যকর্ম আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। অনেক অনুবাদেই লক্ষ্য করা যায়, ভাষাগত দৌর্বল্য, উপযুক্ত সম্পাদকীয় পরিমার্জনার অভাব, কিংবা উপস্থাপনগত দুর্বলতা পাঠকের অনুরণন জাগাতে ব্যর্থ হয়।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের সাহিত্য অনুবাদে দীর্ঘদিন ধরে কলকাতা-কেন্দ্রিক প্রকাশনা সংস্থার নির্ভরশীলতা লক্ষণীয়। এর ফলে পূর্ববাংলার আঞ্চলিক ভাষা, শব্দভাণ্ডার এবং চিন্তাভঙ্গি অনেকসময় নিপাতিত বা পর্যবসিত হয়। অরুণাভ সিনহার ইংরেজি অনুবাদে ‘খোয়াবনামা’ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ—যেখানে পূর্ববঙ্গীয় আঞ্চলিক ভাষা-স্বরের দ্যোতনা নিখুঁতভাবে প্রতিফলিত হয়নি। এই সমস্যার উত্তরণে প্রয়োজন দেশীয় অনুবাদকদের দক্ষতা উন্নয়ন, আন্তঃদেশীয় অনুবাদক-লেখক যৌথ কর্মপরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক অনুবাদ সংস্থা ও সাহিত্য-মঞ্চের সঙ্গে সাংগঠনিক সংযোগ।
প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও ব্যক্তি-নির্ভর কাঠামো
বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হলো—মানসম্পন্ন অনুবাদে ধারাবাহিক উদ্যোগের অভাব, এবং একে ঘিরে প্রয়োজনীয় আর্থিক ও কৌশলগত সহায়তার সংকট। যদিও বাংলা একাডেমি বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট অনুবাদে কিছু প্রচেষ্টা নিয়েছে, তবে তা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, গবেষণা ও পাঠ-নির্ভর উন্নয়নের অভাবে স্থায়ী কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অনুবাদ কার্যক্রম ব্যক্তি-নির্ভর হওয়ায় তা প্রাতিষ্ঠানিক পরিপক্বতা অর্জন করতে পারছে না। এ কারণে পশ্চিমবঙ্গের অন্তত ত্রিশ জন লেখকের সাহিত্যকর্ম আন্তর্জাতিকভাবে অনূদিত হয়ে সুনাম কুড়ালেও বাংলাদেশের লেখকদের সাহিত্য ততটা বিস্তার ও পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি।
অধিকন্তু, বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের মধ্যে সরাসরি ইংরেজি কিংবা আন্তর্জাতিক ভাষায় লেখালেখির প্রবণতা এখনও সীমিত, যার ফলে মৌলিক সাহিত্যকর্মের অনুবাদ অপেক্ষা না করে তারা নিজেই বিশ্বসাহিত্যে প্রবেশ করতে পারতেন—সেই পথেও অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়।
সমসাময়িক সাহিত্য ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সাহিত্যিকদের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ, তাহমিনা আনাম, সেলিনা হোসেন, সৈয়দ শামসুল হক, মোহাম্মদ জাফর ইকবাল ও তসলিমা নাসরিনের সাহিত্যকর্ম বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের কাজ ইংরেজি, জার্মান ও হিন্দিতে প্রকাশিত হয়েছে। সেলিনা হোসেনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান ও রাশিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা ও উপন্যাস ইংরেজি, ফরাসি ও হিন্দিতে অনূদিত হয়েছে। মোহাম্মদ জাফর ইকবালের বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ও কিশোর উপন্যাস ইংরেজি, জাপানি ও জার্মানে অনুবাদিত হয়েছে। ড. আনিসুজ্জামানের স্মৃতিকথা ‘ক্রনিকল অফ আ লাইফ’ ইংরেজি, হিন্দি ও ফরাসিতে অনূদিত হয়েছে, আর তসলিমা নাসরিনের লেখা বহু-সংখ্যক ভাষায় অনুদিত হয়েছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশি ছোটগল্পকার মশিউল আলমের গল্প ‘দুধ’ আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছে এবং তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত হয়েছে। এসব অনুবাদ বাংলাদেশের সাহিত্যের বিশ্বব্যাপী উপস্থিতি ও স্বীকৃতির প্রতিফলন।
তাসনিমা আনাম বাঙালি বংশোদ্ভূত হলেও ব্রিটিশ নাগরিক এবং ইংরেজিতে রচনা করেন, যার কারণে তার সাহিত্যকর্ম বিশ্বসাহিত্যে কিছুটা প্রভাব ফেলেছে। অন্যদিকে, সেলিনা হোসেনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ ভারতের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর শ্রেণিতে পাঠ্য বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ভারতের অংশগ্রহণকে গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস হিসেবে মানা হয়। এছাড়া আনিসুল হকের ‘মা’ উপন্যাস বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হলেও এসব সাহিত্যকর্ম বিশ্বসাহিত্যে তাৎপর্যপূর্ণ আলোড়ন তুলতে পারেনি। এই পরিস্থিতি সমসাময়িক বাংলাদেশের সাহিত্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জের প্রতিফলন।
তুলনামূলক প্রেক্ষাপট: জাপানি, রুশ, ফরাসি ও চীনা সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণ
বাংলা সাহিত্যের আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অবস্থান ব্যাখ্যা করতে হলে জাপানি, রুশ, ফরাসি কিংবা চীনা সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণের উদাহরণ অনুপ্রেরণাদায়ক হতে পারে। জাপানি সাহিত্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে উঠে আসে ১৯৬৮ সালে যখন ইউকিও মিশিমা, হারুকি মুরাকামি ও কাওয়াবাতা ইয়াসুনারির মতো লেখকগণ সাহিত্যিক তীব্রতা ও আধ্যাত্মিক বিমূর্ততায় নতুন রূপরেখা গড়েন। কাওয়াবাতা প্রথম জাপানি হিসেবে নোবেল পুরস্কার পান (১৯৬৮)। জাপানি সাহিত্য বিশ্ব-পাঠককে নিজের সংস্কৃতির গভীরে ডুব দিতে দেয়, অনুবাদেও রেখে দেয় তার আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য। রুশ সাহিত্য—বিশেষত দস্তয়েভস্কি, টলস্টয়, চেখভ, গোর্কি—পাশ্চাত্য দার্শনিক ও সাহিত্যিক পরিসরে এক মৌলিক চেতনা এনে দেয়। অনুবাদ যেমন কনস্ট্যান্স গার্নেট করেছেন, তেমনি পরবর্তীতে পেঙ্গুইন ক্লাসিকস সিরিজের মতো উদ্যোগ রুশ সাহিত্যের চর্চাকে বিশ্বজুড়ে পরিচিত করেছে। ফরাসি সাহিত্য সার্ত্র, কামু, বোভুয়ার, ফ্লবেয়ার, বোদলেয়ার, র্যাঁবো এবং হুগোর মতো লেখকদের অনুবাদ ও গবেষণাকে ঘিরে একটি দার্শনিক পাঠ-সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা সাহিত্যের পাশাপাশি চিন্তাচর্চার একটি পরিমণ্ডল নির্মাণ করে। ল্যাটিন সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণ- ইতিহাসের পাঠ ও আধুনিক পাঠের সেতু: ভাষার সাহিত্য আন্তর্জাতিকীকরণের ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক উদাহরণ। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের ভাষা হিসেবে ল্যাটিন সাহিত্য শুরু থেকেই একটি সাম্রাজ্যিক ভাষার ভূমিকায় বিশ্বমঞ্চে প্রবেশ করে। ভার্জিলের Aeneid, ওভিদের Metamorphoses, এবং সিসেরোর বক্তৃতাগুলি শুধু সাহিত্য নয়, বরং রেনেসাঁস থেকে শুরু করে আধুনিক ইউরোপীয় মানবতাবাদ পর্যন্ত এক অখণ্ড সাংস্কৃতিক ধারার বাহক হয়ে ওঠে। ল্যাটিন সাহিত্য এক সময় চার্চ, আইন, দর্শন ও বিজ্ঞানের প্রধান ভাষা হিসেবে সর্বত্র বিরাজ করলেও, জাতীয় ভাষার উত্থানের ফলে এর ব্যবহার সীমিত হয়ে পড়ে। কিন্তু এর সাহিত্যিক ও দার্শনিক প্রভাব ইংরেজি, ফরাসি, ইতালীয় ও জার্মান সাহিত্যে আজও রয়ে গেছে।
তবে আন্তর্জাতিক সাহিত্যবোধে ল্যাটিন ভাষাভিত্তিক সাহিত্য নতুনভাবে প্রাণ পায় লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের "বুম" আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে যে সাহিত্যিক উত্থান ঘটে, তার অন্যতম অগ্রদূত ছিলেন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। তাঁর উপন্যাস One Hundred Years of Solitude (Cien años de soledad) “ম্যাজিক রিয়ালিজম” শৈলীকে জনপ্রিয় করে তোলে এবং স্প্যানিশ ভাষার সাহিত্যে এক নতুন যুগের সূচনা করে। মার্কেসের কাজ আন্তর্জাতিক পুরস্কার পায়, ১৯৮২ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পান, এবং তাঁর সাহিত্য এখন বিশ্বের বহু-সংখ্যক ভাষায় অনূদিত।
মার্কেসের সাহিত্য উদাহরণ দিয়ে দেখায়, ভাষা বা অঞ্চল যত দূরবর্তী হোক না কেন, যদি সাহিত্য বিশ্বমানবতার অভিজ্ঞতা স্পর্শ করে, তবে অনুবাদের মধ্য দিয়েও তা পাঠকের আত্মায় প্রবেশ করতে পারে। তাঁর লেখায় কল্পনা, ইতিহাস, রাজনীতি ও ব্যক্তিগত বেদনার যে অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ, তা আজ বাংলা সাহিত্যচর্চার জন্যও এক প্রেরণার উৎস হতে পারে।
এই উদাহরণগুলো আমাদের শেখায়—আন্তর্জাতিকীকরণ মানে কেবল অনুবাদ নয়, বরং সাংস্কৃতিক সংলাপ ও নন্দনতাত্ত্বিক উপলব্ধির বিস্তার। মার্কেসের সাফল্য এ কথাই প্রমাণ করে যে, গভীরভাবে আঞ্চলিক সাহিত্যও হতে পারে অভিন্নভাবে বৈশ্বিক।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও সুপারিশ
বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে সুনির্দিষ্ট ও বহুমাত্রিক পরিকল্পনা এখন সময়ের দাবি। প্রথমত, খ্যাতিমান লেখকদের ইংরেজি কিংবা আন্তর্জাতিক ভাষায় মৌলিক লেখালেখির প্রতি অনুপ্রেরণা জোগানো দরকার। দ্বিতীয়ত, বার্লিন সাহিত্য উৎসব, হ্যারে বইমেলা, লন্ডন বুক ফেয়ার ইত্যাদি মঞ্চে বাংলাদেশের সাহিত্যকর্মের সক্রিয় ও পরিকল্পিত উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। কেবল অংশগ্রহণ নয়, বরং এসব আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশি সাহিত্য নিয়ে গঠনমূলক প্রবন্ধ, আলোচনাপত্র ও সংলাপ উপস্থাপন করে সাহিত্যকে উচ্চপর্যায়ে আলোচিত করতে হবে।
বাংলা একাডেমি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এবং অন্য সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে কেন্দ্র করে সৃজনশীল অনুবাদ কেন্দ্র, অনুবাদক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, আন্তর্জাতিক সাহিত্য বিনিময় কার্যক্রম এবং লেখক-অনুবাদক সম্মেলনের আয়োজন করা যেতে পারে। বিদেশি প্রকাশকদের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি, আন্তর্জাতিক অনুবাদ গ্রন্থমালা চালু এবং সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় অনুবাদবিষয়ক তহবিল গঠনের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি, স্থানীয় ভাষার ঐতিহ্য ও আঞ্চলিক স্বরূপ বজায় রেখে এমন অনুবাদ প্রচেষ্টা চালাতে হবে, যা আন্তর্জাতিক পাঠকের কাছে বাংলা সাহিত্যের একটি পূর্ণাঙ্গ ও প্রকৃত প্রতিচ্ছবি উপস্থাপন করতে সক্ষম।
শেষ কথা
বাংলা সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণ কোনো তাৎক্ষণিক অভিযাত্রা নয়; এটি সময়, মনন, দক্ষতা ও কাঠামোগত প্রস্তুতির ফসল। বাংলাদেশের সাহিত্য যদি তার স্বর, স্বপ্ন ও সাধনার সম্মিলনকে বিশ্বের বৃহৎ পাঠসমাজের কাছে পৌঁছে দিতে চায়, তাহলে এর জন্য প্রয়োজন একটি সুদূরপ্রসারী সাংস্কৃতিক কূটনীতি, অনুবাদ-কৌশল ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা। কেবল তবেই বাংলা সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের বর্ণমালায় একটি স্বাতন্ত্র্যচিহ্ন হিসেবে দীপ্ত হবে।