Published : 10 Oct 2024, 12:18 AM
পাঁচ বছর আগে ছেলেধরা সন্দেহে তাসলিমা বেগম রেনুকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় দেওয়া রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে মামলার বাদী নির্মম এ ঘটনায় যারা সরাসরি যুক্ত ছিল তাদের সবার সর্বোচ্চ সাজার আশা করেছিলেন।
বুধবার ঢাকার মহানগর আদালতে একজনের মৃত্যুদণ্ড এবং চারজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার রায় আসার পর মামলার বাদী রেনুর ভাগ্নে সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা চেয়েছি যাদের অ্যাকটিভ পার্টিসিপেশন তাদের সবার মৃত্যুদণ্ড হবে, কিন্তু তা হয়নি। রায়ে আমরা সন্তুষ্ট নই। আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব।”
খালাস পাওয়াদের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা তাদের বিষয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করব।”
অন্যদিকে রায়ের পর দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের পাশাপাশি স্বজনরা বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তাদের কাউকে কাউকে কান্না করতে দেখা যায়। পরে রায় নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তদের স্বজনদের কয়েকজন।
তাদের দাবি, তাদের পিতা ও স্বামী ঘটনার শিকার। মারধর করতে নয় তারা গণপিটুনির শিকার ওই নারীকে বাঁচাতে গিয়েছিলেন।
২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে ছেলেধরার গুজব নিয়ে দেশে যখন তোলপাড় চলছে, সেই সময় ২০ জুলাই ঢাকার উত্তর বাড্ডার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে তসলিমা রেনুকে পিটিয়ে মারা হয়। মেয়েকে ভর্তি করানোর জন্য খবর নিতে সেখানে গিয়েছিলেন ৪২ বছর বয়সী এই নারী।
মর্মস্পর্শী ওই ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় ৫০০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন রেনুর ভাগ্নে সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু।
কী হল রায়
ঢাকার ষষ্ঠ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ মোরশেদ আলম আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
যাকে এই হত্যাকাণ্ডের হোতা বলেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সেই ইব্রাহিম ওরফে হৃদয় মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত।
আর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে রিয়া বেগম ময়না, আবুল কালাম আজাদ, কামাল হোসেন ও আসাদুল ইসলাম।
দণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা জরিমানা; অনাদায়ে আরো এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
আর এ মামলার প্রাপ্তবয়স্ক ১৩ আসামির মধ্যে শাহিন, বাচ্চু মিয়া, বাপ্পি ওরফে শহিদুল ইসলাম, মুরাদ মিয়া, সোহেল রানা, বেল্লাল মোল্লা, রাজু ওরফে রুম্মান হোসেন, মহিউদ্দিনকে খালাস দিয়েছেন বিচারক।
মামলায় ইব্রাহিম ওরফে হৃদয় মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১ লক্ষ টাকার জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডের রায় দিয়েছে আদালত।
রায়ে বলা হয়, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসাসি সাত কার্যদিবসের মধ্যে হাই কোর্ট বিভাগে আপিল করতে পারবে। তাকে রায়ের অনুলিপি বিনামূল্যে প্রদান করা হোক।
অপর চার আসামমি রিয়া বেগম ময়না, আবুল কালাম আজাদ, কামাল হোসেন ও আসাদুল ইসলামকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১ লাখ টাকার জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডের রায় দেয় আদালত।
রায়ে বলা হয়, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ৩৫(ক) ধারা অনুযায়ী তাদের কারাদণ্ড থেকে ইতোপূর্বে ভোগ করা কারাবাস বাদ যাবে।
এছাড়া মামলার রায়ে, অর্থদণ্ড আদায় সাপেক্ষে প্রদত্ত অর্থদণ্ড হতে মামলা পরিচালনার খরচ হিসেবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ২০ হাজার টাকা জমা রেখে অবশিষ্ট টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে নিহতের পরিবারের পক্ষে এজাহারকারী সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটুকে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
রায়ের বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এসব তথ্য দেন আদালতের পেশকার মো. আবুল কাশেম।
বিচারকের পর্যবেক্ষণ
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, বেলা ১১টার দিকে বিচারক তার পর্যবেক্ষণ দেওয়ার শুরুতে নিজের ল্যাপটপ উল্টোদিকে ঘুরিয়ে প্রায় ১৫ মিনিটের ভিডিও চিত্র আসামিদের দেখান। তিনি হৃদয়কে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘দেখ কী জঘন্য কাজ করেছো‘?
এসময় আদালতে ছিল আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। যখন ভিডিও চলছিল তখন পুরো আদালত স্তব্ধ হয়ে যায়। সবাই মনোযোগ দিয়ে বিচারকের পর্যবেক্ষণ শুনছিলেন।
পর্যবেক্ষণ শোনানোর সময় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হৃদয় সম্পর্কে বিচারক বলেন, “এভাবে কি কোনো সুস্থ মানুষ কাউকে পিটাইতে পারে? এটা সমাজের জন্য ক্ষতিকর।”
এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে পর্যবেক্ষণ দেওয়ার পর রায় দেন বিচারক। রায় শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন হৃদয়। যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত আসামিরা চুপ করে থাকেন।
খালাস পাওয়া আটজনের মধ্যে দুইজন পলাতক। রায় দেওয়ার সময় বাকি ছয়জন আদালতে ছিলেন। রায় শোনার পর তারা চুপচাপ আদালতের কাঠগড়া থেকে নেমে এজলাস কক্ষ থেকে বের হয়ে যান।
রায় নিয়ে আক্ষেপ সাজাপ্রাপ্তদের স্বজনদের
রায়ের পরপরই এজলাস কক্ষ থেকে নামিয়ে সাজাপ্রাপ্তদের মহানগর দায়রা আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। বিকাল ৫টার কিছুক্ষণ পর তাদেরকে পুলিশের প্রিজন ভ্যানে করে কেরাণীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। ততক্ষণ পর্যন্ত হাজতখানার পাশে অপেক্ষা করছিলেন তাদের স্বজনরা।
বিকেল ৪টার দিকে সেখানে গেলে দেখা যায় অঝোরে কাঁদছেন একজন নারী। কেউ কেউ বৃষ্টিতে ভিজেই হাজতখানার সামনে গিয়ে উঁকি দিয়ে স্বজনদের দেখার চেষ্টা করছিলেন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ইব্রাহিম ওরফে হৃদয় মোল্লাকে একনজর দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তার বড় বোন লতা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমি একলাই আইছি, হের আর কেউ নাই। আমার ভাইরে আমি ছোড বেলা থেকে বুকে-পিডে ধইরা মানুষ করছি। হের বয়স ৯ মাসের সময় আমার মা মারা গেছে, এক বছর পর বাবা মারা গেছে। এরপর আমরা নারায়ণগঞ্জে নানীর কাছে বড় হইছি। নানী অসুস্থ, বিছানায় পড়ে আছে।
“আমি ৮-৯ বছর বয়স থেকে মানুষের বাসায় কাজ করতাম। আমার ভাই ১০-১১ বছর বয়স থেকে সবজির ব্যবসা করে। হেয় নারাণগঞ্জ থেকে বাড্ডায় এসে সবজির ব্যবসা করত।”
হাজতখানার পাশে অঝোরে কাঁদছিলেন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসাদুল ইসলামের বোন খাদিজা বেগম।
তিনি বলেন, “আমার ভাইডা জীবনে কারও উপকার ছাড়া ক্ষতি করে নাই। সে জীবনে একটা বিড়ি-সিগারেট কিছু খায় নাই। পাশে তরকারির দোকান, মারার খবর পেয়ে দেখতে আসছে। এত সোজা! কারো সাথে কাইজ্জা ঝগড়া করে নাই। যে শুনছে সেই বলছে কল্পনাও করতে পারে নাই আসাদুল এইভাবে আটকাইয়া যাইব।”
তিনি বারবার বলছিলেন, “কেউ বিশ্বাস করতে পারে নাই। যেই শুনছে সেই কাঁদছে আমার ভাইয়ের জন্য।”
কথা বলার সময় এগিয়ে আসেন যাবজ্জীবনসাজাপ্রাপ্ত কামাল হোসেনের স্ত্রী পারভীন বেগম।
তিনি বলেন, “কেউ ইচ্ছা কইরা মারছে? হেরা কি কাউরে ঘর থেইক্কা ধইরা আইনা মারছে। আমাগো লগে তো কোনো শত্রুতা নাই। আমার স্বামী ওরে বাঁচাইতে গিয়া উল্টা মাইর খাইছে।
“হয়তো বলতে পারতো হের জি-পুতরে জরিমানা দিতে, আমাগো ৪-৫টা সংসার বাঁচতো, হের জি-পুতেরাও বাঁচত।”
পারভীন বলেন, তাদের দুই ছেলে এক মেয়ের মাঝে ছোট ছেলের বয়স ছয় বছর ও মেয়ের বয়স ১৩ বছর। সে বাড্ডার একটি মাদ্রাসায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। বড় ছেলে বিয়ে করে বউ ও এক ছেলে নিয়ে আলাদা থাকে। সে উত্তর বাড্ডায় মাছের ব্যবসা করে। যে মাসে যা পারে সংসারে টাকা দেয়।
পাশে ছিলেন যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আরেক আসামি আবুল কালাম আজাদের বড় ছেলে। তিনি সামাজিক অবস্থাগত কারণে ছবি না তোলা ও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার বাবা উত্তর বাড্ডা দরগা শরীফে, খানকা শরিফে থাকত, ওখান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করছে। আমি বাবার বড় ছেলে, আমি ঢাকায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স করতেছি, আমার ছোট ভাই গ্রামে ইন্টারে পড়ে, ছোট বোন এসএসসি পরীক্ষা দেবে। আমার বাবা রাজমিস্ত্রীর কাজ করে আমাদের এতদূর এনেছেন।
“মামলার রায় সম্পর্কে যদি বলি, আমার বাবা সম্পর্কে বলা হয়েছে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। ভিডিও ফুটেজে আমার বাবা তার গায়ে হাত দিয়েছেন এমন কিছু দেখা যায়নি, এমনকি কেউ তার বিরুদ্ধে এমন কোন সাক্ষীও দেয়নি। মামলায় আছে ৪০০/৫০০ মানুষ ছিল সেখানে, একজন রাজমিস্ত্রি হয়ে আমার বাবা কী করে এত মানুষের নেতৃত্ব দেন, এটা অসম্ভব। এখানে ফল বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা, রিকশাচালক, ভ্যানচালক শত শত মানুষ ছিল। আমি চাই আমার কথাগুলো বিজ্ঞ আদালতের কাছে যাক।”
বিচারকের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ”আমার বাবাসহ যাদেরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে তাদেরকে সম্পর্কে আদালত বলেছেন, ‘তাদের আগে পরে কোনো মামলা নেই, তাদের অতীতের রেকর্ড ভালো। তারা একটি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে, তারা চাইলে নিজেদের সংশোধন করে নিতে পারে। তাদের আপিল করার সুযোগ আছে।’ কিন্তু সারাজীবন কারাগারে থেকে কীভাবে নিজেকে সংশোধন করবেন সেই ব্যাখ্যা কি কেউ দেবেন?”
আরও পড়ুন
রেণুকে পিটিয়ে হত্যায় একজনের মৃত্যুদণ্ড, ৪ জনের যাবজ্জীবন
রেনুকে পিটিয়ে হত্যা: রায় পিছিয়ে ৯ অক্টোবর
রেনুর মেয়ে এখন বলে, তার মা 'আকাশের চাঁদ' হয়ে গেছে