Published : 14 Aug 2024, 04:45 PM
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে হত্যাকাণ্ডের ‘হুকুমদাতা’ হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে এনে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তার বিচারের দাবি তুলেছেন নিহতদের স্বজনরা।
বুধবার দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘শহীদ পরিবার ও নিপীড়িত ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে আয়োজিত মানববন্ধন থেকে এ দাবি জানানো হয়।
গত জুলাইয়ে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতনের ওই আন্দোলনে নিহত হয়েছে প্রায় তিনশ মানুষ, আহত বহু মানুষের ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালে।
মানববন্ধনে শহীদ মিনারের বেদির সামনে গুলিবিদ্ধ সন্তান বা পরিবারের সদস্যদের ছবি সংবলিত ব্যানার-ফেস্টুন হাতে দেখা যায় অনেককে।
তাদের অনেকেই কথা বলতে গিয়ে চোখে পানি ধরে রাখতে পরেননি। স্বজনহারাদের আহাজারিতে ভারি হয়ে সেখানকার পরিবেশ।
গত ১৯ জুলাই রাজধানীর বাড্ডায় গোলাগুলিতে নিহত হন রিকশা চালক হাফিজুল সিকদার। মানববন্ধনে হাফিজুলের ছবি নিয়ে মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছিলেন তার বাবা আবু বকর সিকদার।
তিনি বলেন, “আমার ছেলে ওই দিন পেট চালিতে রাস্তায় রিকশা নিয়ে বের হইছিল। কিন্তু আার ঘরে ফিরল না। একটা বুলেটে আমার দুইটা নাবালক নাতি এতিম, তার বউ এখন বিধবা।
“এই জন্য শেখ হাসিনা দায়ী। কারণ সে নির্বিচারে গুলি চালাইতে নির্দেশ দিয়েছে। আমি আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই।”
শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীদের সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে সংঘাত-সহিংসতা জায়গা করে নিলে গত ১৯ জুলাই আন্দোলনকারীর ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে পথে নামে। ওইদিন পথে পথে অবরোধ আর সংঘর্ষের মধ্যে বহু ভবনে আগুন দেওয়া হয়, ঘটে প্রাণহানিও।
ধানমন্ডির সেন্ট্রাল রোডে ১৯ জুলাই সংঘর্ষ চলাকালে ছবি তুলতে গিয়ে নিহত হন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের সাবেক ভিডিও জার্নালিস্ট তাহির জামান প্রিয়।
মানববন্ধনে এসে প্রিয়’র মা সামসি আরা জামান বলেন, “আমার ছেলে যখন গুলি খেয়েছে তখন আমি রংপুরে আন্দোলনকারীদের সাহায্য করছি। মারা যাওয়া লোকগুলোর জন্যে আমি কেঁদেছি। কিন্তু যখন শুনলাম, আমার ছেলে গুলি খেয়েছে কিন্তু তার লাশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এবং পরে যখন তার লাশ পাওয়া গেল, তখন থেকে আমি আর কাঁদতে পারিনি।
“তাহিরের জন্য আমার আফসোস নাই আর। আমার এখন অনেক সন্তান। এখন যেটা সবচেয়ে বেশি জরুরি, তা হল যারা হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছে তাদের জন্য এগিয়ে যাওয়া। আমার যদি সামর্থ্য থাকত, আমার এই অসুস্থ সন্তানদের চিকিৎসার ভার আমি নিতাম।”
মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ২২ বছর বয়সী ইমন হোসেন আকাশের মৃত্যু হয় সরকার পতনের আগের দিন গত ৪ অগাস্ট।
ছেলের ছবি হাতে নিয়ে শহীদ মিনারে এসে ইমনের মা বেবী খাতুন বলেন, “আমার একমাত্র সন্তানকে তারা গুলি করে হত্যা করেছে। অনেক খোঁজাখুঁজি পরে আজমত হসপিটালে আমরা তার লাশ পাই। আমার ছেলে লাশ এখনো চোখে ভাসে। এটা আমি নিতে পারছি না। আমি সন্তান হত্যার বিচার চাই।
গাজীপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ আব্দুল্লাহ আল মামুনের পরিবারও বিচার চাইতে এসেছিলেন শহীদ মিনারে। কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মামুনের বোন।
তিনি বলেন, “আমাদের দুই বোনের একমাত্র ভাই ছিল। আমার বাবা একজন রেমিট্যান্স যোদ্ধা। ৫ তারিখে আমার ভাইকে গাজীপুর আনসার একাডেমির সামনে গুলি করে বুক ঝাঁঝরা করে হত্যা করা হয়।’
“আমার মা পাগলপ্রায়। মা দুপুরে ভাত বেড়ে রেখেছিল, আবদুল্লাহ এসে ভাত খাবে। কিন্তু তার কাছে পৌঁছাল তার ছেলের লাশ। আমার বাবা মাসে মাসে রেমিট্যান্স পাঠায় কিন্তু এই দেশ তাকে উপহার দিয়েছে আমার ভাইয়ের লাশ।”
মানববন্ধন থেকে সাত দফা দাবি জানানো হয়।
১. গণহত্যার হুকুমদাতা শেখ হাসিনাকে অতিদ্রুত দেশে এনে বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করে বিচার করতে হবে।
২. ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামালসহ সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের মধ্যে যারা গণহত্যায় জড়িত, এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছে এবং সরকারকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতাকারীদের বিশেষ ট্রাইবুনালে বিচার করা।
৩. গণহত্যায় জড়িত আওয়ামী লীগ ও তাদের অংগসংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে হামলা ও হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে বিচার করা।
৪.শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকাশ করা, শহীদদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও মাসিক আর্থিক সহয়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা সরকারিভাবে করতে হবে।
৫. আন্দোলনে শহীদদের রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় বীরের মর্যাদা দেওয়া।
৬. বৈষম্য প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর (আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগের) গুণগত পরিবর্তন এবং
৭.জাতিসংঘের অধীনে গণহত্যার তদন্ত করে রিপোর্ট প্রকাশ করা।
মানববন্ধনে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।